অনীকদার কাজের প্যাশন আমাকেও উদ্বুদ্ধ করেছে
বিনোদন প্লাস-কে দেওয়া একান্ত সাক্ষৎকারে জীতু কামাল। জানিয়েছেন তাঁর অপরাজিত হয়ে ওঠার কাহিনি। সাক্ষাৎকারভিত্তিক অনুলিখন অজন্তা সিনহা
ছবিটা আমি করবো, সেটা প্রথমে সেভাবে ঠিক ছিল না। এটা করার কথা ছিল অন্য একজন অভিনেতার। আমার কমবয়েসী সত্যজিৎ রায়ের চরিত্রটি করার কথা ছিল। দু একটা দিন শুটিং থাকবে, এইরকম। অনীকদা আমাকে আগে থেকেই ভাবার সময় দিয়েছিলেন, বলেছিলেন ভেবে দেখো, তুমি করবে কিনা। আমি একদিন সময়ও নিয়েছিলাম। তারপর আমার যাঁরা শুভাকাঙ্ক্ষী, আমার স্ত্রী, আমার নাট্যগুরুদের কাছে কথা বলি। প্রত্যেকেই বলেন, এ ছবিটা তোমার করা উচিত। সেখান থেকেই উৎসাহ পাই ও সিদ্ধান্ত নিই কাজটা করবো।
কিন্তু অনীকদাকে বলি, আমার একটা শর্ত আছে, আমি এই চরিত্রটার জন্য কোনও রেমুনারেশন নেব না। একদিন বা দেড়দিন যাবো, কিছু শট দেব, তার জন্য আবার রেমুনারেশন! এই পরিস্থতিতে আমাকে লুক টেস্টে ডাকা হলো। সেদিন আমার একটা হেকটিক সিডিউল ছিল। সকালে একটা এড শুট, মেগারও শুটিং ছিল। এবং কোভিডের কারণে নানা বিধিনিষেধ–রাত ন’টার মধ্যে শুটিং শেষ করে দিতে হবে ইত্যাদি। আমি মেগার শুটিং থেকে ওখানে গেছি। আমাকে আবার শুটিংয়ে ব্যাক করতে হবে। নাহলে তারা খুব বিপদে পড়ে যাবেন। আমি অনীকদাকে বলি আমাকে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিতে হবে।
উনি মেনে নিলেন। ১০/১৫ মিনিটের মধ্যে, ৪/৫ টা কস্টিউম পরিয়ে ছবি তোলা হলো। এতটাই তাড়া ছিল যে ফোটো ল্যাবে গিয়ে সেই ছবির একটিও দেখিনি। তবে,এটা লক্ষ্য করেছিলাম, প্রথম আমি যখন স্টেজে, যেখানে ফোটো শুট হচ্ছিল, ওই লুক নিয়ে দাঁড়াই, তখন সেখানকার লোকজনের প্রতিক্রিয়া, অদ্ভুত একটা ভুত দেখার মতো তাকিয়ে আছে সবাই আমার দিকে। এটা বেশ মনে দাগ কাটার একটা বিষয় ছিল। সারাদিনের সব কাজ সেরে বাড়িতে ফিরে বসে আছি। অনীকদার মেসেজ, কয়েকটা ছবি আর সঙ্গে লেখা–জাস্ট হ্যাভ আ লুক। পারলে বড় স্ক্রিনে দেখো। আমি তখন সেটাই করলাম, স্ক্রিন ভিওয়ার টিভির সঙ্গে জুড়ে ছবিগুলো দেখলাম।
দেখে অনীকদাকে বললাম, এগুলো তো আমি সত্যজিৎবাবুর যে ছবিগুলো ফলো করে পোজ দিয়েছি, সেগুলো। আমাকে আমার ছবি পাঠাও। উনি বললেন ইডিয়ট, দ্যাটস ইউ!! অত্যন্ত স্নেহের সুরেই বলেছিলেন, বলা বাহুল্য। আমি তখন ভাবলাম, ও, এটা আমি? এটা ছিল আমার প্রথম অনুভূতি। আমার স্ত্রীও চিনতে পারেনি। ও বলেছিল, ‘রেয়ার পিকচার অফ রে’ । তখন আমিও ওকে একই জবাব দিই, ইডিয়ট, এটা আমি!! (হাসি) এটা নিঃসন্দেহে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার। এ এক চিরকালীন অনুভূতি, যা চলার পথের পাথেয় হয়ে গেল।
এর আগেও হয়তো নানা কারণে দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে। কিন্তু এই ছবিটার জন্য আমি প্রথম যখন অনীকদাকে মিট করি, ওঁর মধ্যে একটা অদ্ভুত প্যাশন কাজ করছে দেখেছিলাম। সেটা আমি একইভাবে দেখেছি আমার থিয়েটার গুরু গৌতম মুখোপাধ্যায়ের মধ্যে। তাঁর গ্রুপেই আমার মানুষ হওয়া। আমার প্রশিক্ষণ পাওয়া। এখনও, এই ছবির ক্ষেত্রে–আমি যখন যখন ওঁর কাছে কিছু জানতে বা বুঝতে চেয়েছি, কী করণীয়, গৌতমদা যা যা পরামর্শ দিয়েছেন, আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। আমি এখনও মঞ্চে ঢোকার সময়, আমার তিনজন গুরু–একজন শিবঠাকুর–উনি খুবই পছন্দের, একজন প্রয়াত দেবীদাস ভট্টাচার্য এবং গৌতম মুখোপাধ্যায়। এঁদের নাম স্মরণ করে আমি আজও কাজ করতে যাই।
গৌতম মুখোপাধ্যায়ের মধ্যে আমি দেখেছিলাম, ওই কাজ করার একটা আর্জ, একটা তীব্র খিদে। কাজ নয়। ওটা বেঁচে থাকার খিদে। ওটা না করলে উনি বাঁচবেন না। গৌতম মুখোপাধ্যায়কে যদি বলা হয়, ওঁর কাছ থেকে নাটক কেড়ে নেওয়া হবে–বাঁচবেন না। যিনি ওই একটা ঘরের মধ্যে শুধু একরাশ বইখাতার মধ্যে ডুবে থাকেন। বাড়ির দুটি ফ্লোরে শুধু বই। বলেন, আমি মরলে জ্বালাতে কাঠ লাগবে না। এই বইগুলোই ধরিয়ে কাজে লাগাবি। এগুলো তো অকেজো হয়ে যাবে আমি চলে যাওয়ার পর। তোরা তো আর আসবি না! এই কথাগুলো খুব হন্ট করে আমায়।
সেই রকমই কাজের প্যাশন আমি অনীকদার মধ্যে দেখলাম। জীবনের সমস্তটা দিয়ে ছবিটা করছেন। যাঁকে বোঝাটা একটা বড় ব্যাপার। হয়তো খুব বকাঝকা করছেন। মনে হতে পারে খুব রাগী মানুষ। কিন্তু ওঁর ইনার সোল একেবারে আলাদা। জীবনের শেষটুকু দিয়ে চরিত্রটাকে নির্মাণ করতে চাইছেন। আমাকে যদি টেনশনের কথা বলা হয়, আমি এটাই বলবো, একটু টেন্সড আমি ছিলাম। মনে হয়েছিল, যেটা অনীকদা আমার কাছে চাইছেন, সেটা ফিরিয়ে দিতে হবে। এ যেন অলিখিত এক কন্ট্রাক্ট। না দিলে উনি খুব ব্যাথা পাবেন।
প্রোডিউসার হাসান সাহেবের কথাও বলবো। তাঁর সঙ্গে মিট করে মনে হয়েছিল ও বাবা প্রোডিউসারও এরকম হতে পারেন । তিনি শুধুমাত্র টাকা নিয়ে কথা বলছেন না। বলছেন, ইউ আর দ্য ব্ল্যাক হর্স অফ মাই প্রোডাকশন। আমাকে তোমার ঘোড়ায় চড়িয়ে পৌঁছে দিও। জিনিসটা শেষ পথে ছেড়ে, ফেলে চলে যেও না । অদ্ভুত একটা আনন্দ হয়েছিল। আমি এমন লোকদের পছন্দ করি, যাঁরা আমাকে এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করবেন। যাঁরা ভুলগুলো দেখে বলবেন, এটাও ঠিক করা যায়। বলবেন না, তুমি পারবে না, বাড়ি চলে যাও। এই পিতৃতুল্য অনুভূতি আমি গৌতম মুখোপাধ্যায়ের কাছে পেয়েছিলাম।
কালই ছবির প্রচারে শরৎসদনে গিয়েছিলাম। মনে পড়লো এখানে আমরা গ্রুপ থেকে ‘কাবুলিওয়ালা’ নাটক করেছিলাম। গৌতমদা আমায় যা সব গালি দিয়েছিলেন, তা এখনও সৃষ্টিই হয়নি। কাল মঞ্চে উঠে আমি যেন গৌতমদাকে দেখতে পেলাম। মনে হচ্ছিল দূর থেকে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। মিটিমিটি হাসছেন। বিশ্বাস করো, এই এখনও বলতে বলতে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে আমার। সেইদিনটা না হলে আজ আমি এই দিনটাতে পৌঁছতে পারতাম না। সেদিন তিনি আমায় গালাগাল দিয়ে সারাটা স্টেজ করালেন। তারপর বাড়ি গিয়ে আমায় আমের টকডাল আর আলুর চোখা দিয়ে ভাত মেখে খাওয়ালেন। আমার রাগ ভাঙ্গাবার জন্য মুখের সামনে ধরলেন। আমি মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছি। তখন তো আমি খুব রেগে গেছি। আসলে রাগ নয় অভিমান। সেই আন্তরিক জায়গাটা আমি এই হাউসে পেয়েছি। অনীকদার তাগিদটাও একটা ভালো ছবি বানানোর। এ এক অনন্য অনুভূতি।
এই প্রসঙ্গে বলি, ত্রিপুরা থেকে এক সাংবাদিক বন্ধু সেদিন ফোন করে বললো রবীন্দ্রনাথ ও সত্যজিৎ রায় দুজনেই খুব সেন্সিবল মানুষ। বাঙালির আইকনিক চরিত্র। তোর ভয় লাগেনি কাজটা করতে? ওকে যেটা বললাম, আমরা রবীন্দ্রনাথ ও সত্যজিৎ রায়কে সেন্সিবল বলি। কিন্তু যখন নিজের ফেসবুক ওয়ালে নিজের মতবাদ রবীন্দ্রনাথের নামে চালাই, তখন সেন্সিবিলিটি কোথায় যায়? তখন আপামর বাঙালি তো প্রতিবাদে নামে না! আর সত্যজিৎ রায় বলতেই আমরা কী জানি–পথের পাঁচালি, হীরক রাজার দেশে, ফেলুদা, অস্কার, লম্বা, ইংরেজিতে খুব ভালো কথা বলেন, একজন রাশভারী মানুষ। এটুকুই আমাদের চর্চা। আমিও নিজেকেও এদেরই অন্তর্ভুক্ত করছি। আর এতই যদি সেন্সিবিলিটি, তবে, পঠনপাঠনে কেন সত্যজিৎ রায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে না?
আমরা আসলে বিষয়টা আত্মস্থ করি না। আমরা ওঁদের গ্ল্যামারটা ব্যবহার করি। বাইরের শো-অফটা বেশি আমাদের। কে বলতে পারে, একটা ক্লাস ওয়ান/টু তে পড়া ছেলে বড় হয়ে চিত্র পরিচালক হবে না। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য স্টাডি মেটেরিয়াল আছে। এটার জন্য কেন নয়? তাছাড়া, উনি একাধারে বহু গুণ ও প্রতিভার অধিকারী। সেগুলোও তো জানা দরকার নতুন প্রজন্মের। আমি আমার নিজের মতো করেই সত্যজিৎ রায়কে বোঝার চেষ্টা করেছি। যাঁকে আমি পুজো করি, সেটা ওই ঘরে তাঁকে বন্ধ করে, দিনে একবার নকুলদানা আর বাতাসা দিয়ে করা নয়। সেই পুজো তিনি নেন না। আমি তাঁকে ঘরে না রেখে মনে বহন করি। সত্যজিৎ রায়কে এভাবেই বহন করেছি আমি নিজের সঙ্গে।
একটা মজার কথা মনে পড়লো, এই খ্যাতনামাদের প্রতি আমাদের ভক্তির প্রাবল্য নিরিখে। আমি সেদিন ফেসবুকে আমার ওয়ালে একটা কবিতা পোস্ট করি, সেটা রবীন্দ্রনাথ সত্যজিৎ রায়কে লিখেছিলেন। আমি সেখানে কোনও নামের উল্লেখ করিনি। সেটা দেখে একজন বললো, বাহ আজকাল কবিতাও লিখছ। ভালোই তো লিখেছ। আমি প্রথমে বুঝতেই পারিনি। ভাবছি কোনও সংবাদপত্রে কিছু বেরিয়েছে। জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় দেখেছ। উনি বললেন কেন ফেসবুকে। ইনি কিন্তু একজন বিদ্দতজন বলে খ্যাত। এই হলো অবস্থা। একটা তথ্য এখানে উল্লেখ জরুরি। এই চিঠিটা আমাদের ছবিতেও ব্যবহার করা হয়েছে।।
আমার দুর্ভাগ্য, ওয়ার্কশপ করার সময়ই পাইনি। যদিও এটা খুবই পছন্দ করি আমি, সে কাজ বড় হোক বা ছোট। আসলে পুরো ব্যাপারটাই ছিল আকস্মিক। কিছুটা অনিশ্চয়তাও তার সঙ্গে। একবার বা দেড়বার অনীকদার কাছে গিয়ে যতটা জানা। সত্যজিৎ রায় বা এই স্ক্রিপ্ট সম্পর্কে বোঝার ব্যাপারটা তখন, একবিন্দু জলের মতো হয়ে যাচ্ছে একটা সমুদ্র। আমি ঠিক করি কিছু করতে হবে নিজেকেও। বাড়িতে প্রিপারেশন নিতে শুরু করলাম। দরজার মধ্যে লেখা। সত্যজিৎ রায়ের একটা মুখ আঁকা। ফোকাস লেখা। অনুশীলন লেখা। কোথায় কী ইউটিউবের ভিডিও, সেগুলো নাম্বারিং করে রাখা। বাড়ির টিভির কেবল লাইন কেটে দিলাম। সেগুলো সারাক্ষণ টিভিতে চলতে লাগলো। দেখি। শুনতে থাকি, ঘরের যেখানেই যাই।
মনে পড়ছিল, আমার গুরু বলেছিলেন, বাচ্চা যখন বড় হয়, তার শেখা শুরু হয় শোনা থেকে, যেটা বলা বা দেখার থেকে বেশি। আমি ওই পদ্ধতিটা প্রয়োগ করেছিলাম। স্ত্রীকে পাঠিয়ে দিলাম ওর বাড়িতে । বললাম ২২/২৩ দিন আমাকে একা ছেড়ে দাও। সেও খুব কোঅপারেটিভ, ওভার ফোন ভিডিও কলে কিউ দিত। এই সাপোর্টগুলো পেয়েছি ওর কাছে সব সময়। আর দিনের যখনই দরকার, অনীকদাকে ফোন করেছি। এমনও হয়েছে মাঝরাতে ফোন করেছি। করে ফেলতাম আসলে। সময়ের খেয়াল থাকতো না। হয়তো সন্ধ্যা থেকে পড়ছি স্ক্রিপ্ট। জিজ্ঞেস করলাম, এই শব্দটা কেন সংলাপে রেখেছেন। উনি কিন্তু বিরক্ত হননি কখনও। উত্তর দিতেন। পরে বলতেন, তুমি টেনশন করছো। শুয়ে পড়ো।
থিয়েটারের অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই আমার প্রস্তুতিতে সাহায্য করেছে। প্রথমে ব্যাকস্টেজে কাজ করতাম–মূলত লাইট, মিউজিক। বিভিন্ন দলে ঘুরে কাজ করতাম। তারপর গৌতমদা আমায় অভিনয়ে নিয়ে এলেন। এবার আবার ‘কাবুলিওয়ালা’ প্রসঙ্গ। আমি তখন প্রম্পটার ছিলাম। তো একবার যিনি কাবুলিওয়ালা করছিলেন, তিনি আক্ষরিক অর্থেই ডুবিয়ে দেন। তখন আমি কাজটা করি। চাপে পড়েই করি। তিনি ডোবান। আমার উত্থান হয়। সেই আমার প্রথম মঞ্চের সামনে আসা। নাটকে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা, কাজ করতে করতে বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, গৌতমদার গুঁতো খাওয়া সবই কাজে লেগেছে। একটা শিক্ষা দিয়েছিলেন, চরিত্র হয়ে ওঠো। বলতেন, এমন নয় তুমি হাঁটলেই, কথা বললেই চরিত্র তৈরি হবে। তুমি কীভাবে চরিত্রটির হাঁটাচলা, কথা বলা দেখতে পাও, সেটা আগে অনুভব করো।
সত্যজিৎ রায়ের ক্ষেত্রে বাঙালি ওঁর এই হাঁটাচলা, কথা বলার স্টাইল জানে। কথার ভাবার্থ না বুঝলেও, জানে। জানে তাঁর জামাকাপড় বা অন্যান্য বিষয়ে। আমি সেটাকেই একটা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করলাম। অহরহ ভাবতাম, আমি যদি এটা করি, যদি এভাবে চলি। আমি বাড়িতেও ওই পোশাক পরে থাকতাম। হাতের মধ্যে জ্বলন্ত সিগারেট রেখে অনর্গল কথা বলার চেষ্টা করতাম। মুখে সিগারেট রেখেও কথা বলতাম। উনি যেটা শুটিংয়ে করতেন। এটাই–আমার মনে হতো আমাকে চরিত্র হয়ে উঠতে হবে। এটা নয় স্পটে পৌঁছে মেকআপ করার পর কেমন লাগবে দেখতে। তাতে শুধু লুকটাই হবে। ভয়েস কী হবে, সেটাও না হয় সাউন্ডয়ের কাছে থাকবে।
এখানেই বলবো, ম্যানারিজম হলো আসল। আমি বলবো, চলবো, কথা বলবো–সেটা মাথায় রেখে। কথার স্ক্যানিং–সেগুলো ভাবতে হয়েছিল। ভাবতেই হবে। মেকআপ নিয়ে আমি সত্যজিৎবাবু হতে পারি। কিন্তু ভিতরের জীতুবাবুকে কি করে তখন সরাবো ? ওইটাকে সরাতে হয়েছিল। তারজন্য এখন আমি মেকআপ ছাড়াও যখন যাচ্ছি কোথাও–এই তো কালকেই একটা অনুষ্ঠানে লোকজন বলছিল, সত্যজিৎ রায়ের মতো লাগছে। তার কারণ, ওইমতো হাঁটছি, চলছি। এই ‘মতো’ ব্যাপারটার মানে হলো, আমি আসল মানুষটা নই সবাই জানে। কিন্তু তারা সেই মানুষটার সঙ্গে রিলেট করতে পারে। সেই মোহটা এখানে তৈরি হচ্ছে। সেই রকমই কথা বলা, চোখ নাড়ানো–এগুলো তো আর নিছক অভিনয় দিয়ে হয় না।
শুটিংয়ের অভিজ্ঞতা বলা খুব মুশকিল। আমি একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম তখন। আমার কাছ থেকে চব্বিশটা দিন যে কিভাবে চলে গেছে, বলতে পারবো না। এ ব্যাপারে সবাই খুব সহযোগিতা করেছে। একা থাকতে চাইতাম। এমনকী অনীকদাও খুব আলতো করে, কখনও ইশারায় ডাকতেন। ইউনিটের সকলেই বুঝতেন জায়গাটা। একটা ঘটনা। একদিন সেটে বসে আছি। হঠাৎ দেখছি বিখ্যাত সাংবাদিক সম্বিৎ বন্দোপাধ্যায়। উনি সত্যজিৎ রায়ের প্রচুর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। টিভিতে দেখেছি। তো, যেহেতু আমি একটা ঘোরের মধ্যে আছি। ভাবছি এটা বাস্তব, না সেই ঘোর লাগা মুহূর্ত! ভুল দেখছি না তো? পরে উৎসবদা, আমাদের এসোসিয়েট ডিরেক্টর আমার ঘোর কাটালেন। তারপর সেই টেক, যেখানে উনি সত্যজিৎ বাবুকে প্রশ্ন করছেন ক্যামেরাম্যান নতুন, এত নতুন শিল্পী নিয়ে কাজ করছেন, ভয় করছে না আপনার– ইত্যাদি ইত্যাদি! দেড়পাতার একটা ডায়ালগ ছিল। সেটা যে কিভাবে প্রথম শটে উতরালো এবং উনি হাততালি দিলেন। তারপর কানের কাছে এসে বললেন, যে পথে আছো, সঠিক পথ। সেটা আমার জীবনের অন্যতম সেরা প্রাপ্তি। একে মনের মণিকোঠায় চিরদিন রেখে দিতে চাই।
এটা ঠিক এই চরিত্রটা আমার কেরিয়ারে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তাই বলে, বাকি কাজগুলোকে আমি ফেলনা বলতে পারছি না। আগের যেসব পরিচালক আমাকে সুযোগ দিয়েছেন, বা ভবিষ্যতেও দেবেন, তাঁরাও কিন্তু আমার ওপর ভরসা করেন। ভরসা করেন বলেই কাজ পেয়েছি। আমার পরিচিতি তৈরি হয়েছে। এই পরিচিতিটা তৈরি না হলে আমাকে অনীক দত্তই বা কি করে খুঁজে পেতেন? ভরসাই বা করতেন কেন ? এই চরিত্রটা করতে আমাকে হয়তো একটু বেশি ভাবতে হয়েছে। সময় দিতে হয়েছে। এটা মনে রাখতে হয়েছিল, এই চরিত্রটা এমন, যেটা শুধু বাঙালির আবেগ নয়, বাঙালির গর্বকেও বিশ্বে পৌঁছে দিয়েছে। আমি যদি সেটাকে বিকৃত করে ফেলি, তবে, বাইরেও আমাদের সংস্কৃতির অপমান করবো।
এই কারণেই সেই সময় আমি মেগা বা অন্য ছবির কাজ করিনি। অনেক সময়ই আমাদের অভিনেতাদের পাশাপাশি ২/৩ টে ছবিতে কাজ করতে হয়। পেশার তাগিদেই হয়তো। সেটা এক্ষেত্রে সম্ভব ছিল না। প্রতিদিন শুটিং শেষেও আমি ঐ মানুষটার মধ্যেই ডুবে থেকেছি। একজন মানুষ কাজের জায়গা থেকে বাড়ি ফিরে তো আর অন্য মানুষ হয়ে যায় না! শ্যাম বেনেগল আমাদের ছবিটা পছন্দ করেছেন, এটা খুবই আনন্দের। মুম্বইয়ে স্ক্রিনিংয়ের সময় কাছ থেকে ওঁকে দেখে খুব রোমাঞ্চিত হই। আমি চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল কাকে সামনে দেখছি! যাঁর ‘আরোহণ’ ছবি দেখে আমি জীবনের পথ চলা শুরু করি। উদ্বুদ্ধ হই।
আমি এত ভেবে কাজটা করিনি যে, এটাই আমার কেরিয়ারের ট্রেন্ড হয়ে যাবে। বিখ্যাত মানুষদের নিয়ে সিনেমা আগেও তৈরি হয়েছে। এটা ঠিক, আমি চরিত্র নির্বাচনে সবসময়ই খুব ভেবে সিদ্ধান্ত নিই। এটাও ঠিক সত্যজিৎ রায়ের যে ইমেজ, তাঁর গ্রহণযোগ্যতা, আভিজাত্য, সেটা হয়তো সবসময় পাবো না। এই জাতীয় ছবি সবসময পাবো, সেটাও বাস্তবে অসম্ভব। একজন অভিনেতার কাম্যও নয় সেটা যে, একই ধরণের কাজ করা। অন্য চরিত্রের ক্ষেত্রেও আমি সেটাই করি, যেটা করে আমি নিজে মজা পাবো। দীর্ঘদিন বাস করতে পারবো যার সঙ্গে। ভাবনার খোরাক পাবো এমন।
অপরাজিত: দ্য আন ডিফিটেড
অনীক দত্ত পরিচালিত এই ছবি নিয়ে সারা বিশ্বের বাঙালি দর্শক উদ্বেলিত। স্বাভাবিক। সত্যজিৎ রায় বাঙালি আবেগ ও শ্রদ্ধার অনেকটা জুড়ে। আর তাঁর আইকনিক ছবি ‘পথের পাঁচালি’ ! সেই ‘পথের পাঁচালি’ নির্মাণের নেপথ্য কাহিনি এর বিষয়। আদতে, এ ছবি নির্মাণের অপরাজেয় কাহিনিই ‘অপরাজিত: দ্য আন ডিফিটেড’। এ ছবি এক সময়ের দলিল। যে সময় বাংলা সিনেমার বিবর্তনকে প্রকাশ করে। এক সৃজনশীল মানুষের সিনেমার প্রতি নিবেদন ও এই শিল্পকে উৎকর্ষতার চরমে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে। আজ এ ছবির হল রিলিজ। ইতিমধ্যেই যা স্ক্রিনিং হয়েছে, দর্শক উচ্ছসিত। স্বয়ং শ্যাম বেনেগলের মতো পরিচালক ‘অপরাজিত: দ্য আন ডিফিটেড’ দেখে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। স্বভাবতই দূরের বাঙালি অপেক্ষা করছেন এর ডিজিটাল রিলিজের। অনীক দত্ত তাঁর মনন ও মেধার যে বিন্দুতে দাঁড়িয়ে এ ছবির পরিকল্পনা করেন, সেটা শুধু কুর্নিশযোগ্য নয়, ভাবনার খোরাক যোগানোরও। সঙ্গে চ্যালেঞ্জিংও তো বটেই ! মুখ্য চরিত্রে জীতু কামাল, সায়নী ঘোষ প্রমুখ। অপরাজিত রায় হয়ে ওঠায় নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন জীতু। ছবিতে সত্যজিৎ জায়া, বিজয়া রায়ের ছায়ায় তৈরি বিমলা রায়ের চরিত্রে দেখা যাবে সায়নী ঘোষকে। প্রযোজনা ফিরদৌসুল হাসান ও প্রবাল হালদার।