আমার সোনার ‘বাঘ’ চাই…
দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম। পড়ছেন কাজিরাঙার বর্ণময় কাহিনি। আজ তৃতীয় পর্ব। লিখছেন মণিদীপা কর।
কথায় আছে বাঘের দেখা আর সাপের লেখা ভাগ্যে না থাকলে মেলে না। না, ১২ বছর ধরে জঙ্গলে ঘুরলেও সে ভাগ্য খুব বেশি হয়নি। এর আগে দুবার বাঘ দেখার সৌভাগ্য হলেও, ছবির ভাগ্য আমার খুবই খারাপ। এবারে কাজিরাঙা আসার আগে থেকেই মনটা কেমন বাঘ বাঘ করছিল। শুধু বাঘ বললে কম বলা হবে। বারবারই মনের কোণে গোল্ডেন টাইগারের আশা উঁকি দিচ্ছিল। যদিও, আসার আগেই জেনে নিয়েছিলাম, এই মরশুমে সেই সোনার স্বপ্ন কাউকেই ধরা দেয়নি।

প্রথমদিন বিকেলে ইস্টার্ন জোন থেকে ফিরে জানলাম, সেন্ট্রাল জোনে তার প্রথম দর্শন হয়ে গিয়েছে। ফেসবুকে তার ছবিও দেখলাম। আফশোস হল, আমরা যদি ইস্টার্ন না গিয়ে সেন্ট্রাল জোনে আগে যেতাম। তবে, প্রফুল্লদা আর তকিব ভরসা দিল, গোল্ডেন টাইগার একবার দেখা দিলে, একই জায়গায় পরপর ২-৩ দিন সাইটিং হয়। ফলে, পরদিন বিকেলে আমাদের গন্তব্য হলো সেন্ট্রাল জোন। সত্যি কথা বলতে কী, একেবারেই তর সইছিল না। আমরা সকালেই যেতে চাইলে ওরা জানাল, সকালে বাঘের তেমন মুভমেন্ট হয় না। তাই সকালে বুড়াপাহাড় ঘুরে এসে লাঞ্চ সেরেই ছুটলাম সেন্ট্রাল বা কোহরা রেঞ্জ। প্রফুল্লদা অবশ্য এন্ট্রি পাশ আগেই করে রেখেছিল।
গেট দিয়ে ঢোকার সময় বুঝে গেলাম, কাজিরাঙায় সিংহভাগ পর্যটকের ভিড় এই রেঞ্জ-এ। একেবারে গাড়ির মিছিল। ঢোকার পথে হগ ডিয়ার, গ্রে হেডেড ফিশ ঈগলের মাছ ধরে খাওয়া, এমনই নানা দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করতে করতে এগোচ্ছি। আমাদের অন্য গাড়িটি নিয়ে তকিব কখন যে আমাদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেছে, খেয়াল করিনি। রাস্তার একধারে কাছেই একটা ছোট গাছে ইন্ডিয়ান রোলার, আর অন্যদিকে একটু দূরে একটা শিমুল গাছের মগডালে পল্লাস ফিশ ঈগল। ছবি তুলছি। হঠাতই দেখলাম সামনের কাঠপোড়া ওয়াচ টাওয়ারের উপর থেকে তকিবের হাতছানি। জঙ্গলে এই ইঙ্গিতের অর্থ আমাদের জানা। পড়ি কি মরি করে উপরে উঠে জানলাম, তিনি একবার দর্শন দিয়ে ঘাসের বনে বিশ্রাম নিচ্ছেন।

একদিকে উৎকণ্ঠার পারদ চড়ছে, অন্যদিকে অল্পের জন্য মিস করে যাওয়ার আফশোস। মন বলছে, আবার দেখা দেবে। কিন্তু ভরসা করার সাহস পাচ্ছি না। ওয়াচ টাওয়ারে তখন উপচে পড়া ভিড়। কোনও রকমে একটা জায়গা নিয়ে দাঁড়ালাম। তবে, নিশ্চিত করে বুঝতে পারছি না, তিনি বের হলে ঠিক কোনখানটা দিয়ে হাঁটবেন। কারণ দর্শনস্থল আমাদের থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে। মাঝখানে মিহিবিল। ওয়াচ টাওয়ারে যেমন কয়েকজন ওয়াইল্ড লাইফ ফোটাগ্রাফার রয়েছেন, তেমনই বেশিরভাগই ছুটি কাটাতে আসা পর্যটক। দীর্ঘ প্রতিক্ষা তাঁদের সয় না, তাও আবার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য। অধিকাংশই একে একে চলে গেলেন। আমাদের দলেও অনেকের মনেই ধূমায়িত অসহিষ্ণুতা। তাঁরা এক জায়গায় সময় নষ্ট না করে বাকি জঙ্গলটা ঘুরতে চান। গণতন্ত্রকে মান্যতা দিয়ে একটা গাড়ি নিয়ে তাঁদের বেরিয়ে পড়তে বললাম। সঙ্গে গেল প্রফুল্লদা। কিন্তু আমরা ঘাঁটি ছাড়ছি না। বিশেষ করে যেখানে একবার বাঘের মুভমেন্ট হয়েছে, সেই জায়গা ছেড়ে যাওয়ার প্রশ্নই নেই। দরকার পড়লে পুরো সাফারির সময়টাই থেকে যাব।

সবাই বেরিয়ে গেলে আমাদের প্রহর গোনার শুরু। এবার তকিবের P900-এর ভিডিও দেখে বাঘ দর্শনের সম্ভাব্য জায়গাটা অনুমান করে নিলাম। কিন্তু এবার চিন্তা, আমার ছোট লেন্স-এ অত দূর থেকে তার ছবি আসবে তো? প্রহর গোনার ফাঁকে ফাঁকেই শিমূলের ডালে পল্লাস ফিশ ঈগলের ছবি লেন্সবন্দি করছি। সেই ছবি দেখে দূরত্ব হিসাব করে তকিব আশ্বস্ত করল, বাঘের ছবিও আসবে। পাশে আমার ছোট্ট ছেলেটাও বাঘের ছবি তুলতে ওর ছোট্ট ক্যামেরা তাক করছে দেখে বললাম, এই ক্যামেরায় ছবি আসবে না। তুমি চোখে দেখো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দূরের ডানদিকের ঘাস নড়ে উঠল। কারুর নিঃশ্বাস পড়ছে না। ঝড়ের বেগে কেবল শাটার পড়ার শব্দ। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের স্বর্ণাভ-রাজ দর্শন। তাতেই আমাদের জীবন স্বার্থক। অশুদ্ধ বাংলায় তকিবের প্রশ্ন, মণিডীপা ডিডি ছবি হয়েছে ? বললাম তুলেছি, কী হয়েছে জানি না। ডিসপ্লে হাতড়ে দেখলাম, খারাপ কোয়ালিটির হলেও, পূর্ণ অবয়বে সোনার বাঘ ক্যামেরায় ধরা দিয়েছে। আমরা তাতেই খুশি। এবার ওয়াচ টাওয়ার ছেড়ে বেড়িয়ে পরলাম যদি আরও কিছুর দেখা পাওয়া যায়। পেলামও। একটু এগিয়েই পথের বাঁ-ধারে ২০-২৫ টা হাতির একটা দল। দলে দাঁতাল পুরুষ, স্ত্রী, বাচ্চা সবাই আছে। শুঁড় দিয়ে পাকিয়ে এলিফ্যান্ট গ্রাস মুখে পুরছে।

ক্ষুধা, তৃষ্ণা, মল-মূত্র ত্যাগের মতোই অন্য এক জৈবিক চাহিদার সাক্ষী হতে হতেও পারলাম না। বসন্তের বিকেলে এক মিলনাতুর হস্তি যুগলের আবেগকে তোয়াক্কা না করে ভিড় জমাল রাশি রাশি জিপসি। সেই মুহূর্তে মনে হল, জঙ্গল সাফারির জন্য পর্যটকদের একটা এলিজিবিলিটি টেস্ট নেওয়া উচিত। কেবল টাকা দিতে পারলেই সকলকে জঙ্গলে ঢোকার অনুমতি দেওয়া উচিত নয়। সাইটিং, ছবি–সবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু বন্যপ্রাণীদের জন্য যে একটা স্বস্তির দূরত্ব বজায় রাখা জরুরি, সে বোধটা থাকাও আবশ্যক ! একরাশ বিরক্তির মেঘ সোনার বাঘ দেখার আনন্দকে কিছুটা ম্লান করে দিল। সূর্যের পড়ন্ত রোদ মনে করিয়ে দিল, আমাদের ফেরার সময় হয়ে গিয়েছে। ফেরার পথে আবারও বন্য শূয়োর, গন্ডার, হগ ডিয়ার দর্শন। ভালো লাগার বিষয় এটাই, তারা তাদের মতো করেই আমাদের বিরক্তি কমাবার চেষ্টা করে গেল। সেখানে কোনও খামতি পেলাম না। (চলবে)
ছবি : লেখক