আশপাশ খুঁজলেই পাবেন আপনার নিজের দিকশূন্যিপুর
দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম প্রতি সপ্তাহে। এই সপ্তাহের গন্তব্য বেশ খানিকটা অন্যরকম। প্রিয় পাঠক, দিকশূন্যিপুরের উদ্দেশ্যে হারিয়ে যেতে চাইলে এমন এক ট্রিপের পরিকল্পনা আপনারাও করতে পারেন। পড়ুন অজন্তা সিনহার কলমে।
একটু আগেই অস্তরাগের অপরূপ আলো মেখে নিয়েছে আকাশ। আকাশ সেই নরম আলো দান করেছে আশপাশের প্রাচীন গাছ, ফসলের ক্ষেত, কাছে দূরে দাঁড়ানো ঘরবাড়ি, পুকুরের মৃদু ঢেউ তোলা জলে। এমন মহার্ঘ গোধূলি দেখা আমাদের মতো কেজো লোকেদের ভাগ্যে নিয়মিত জোটে না। মুগ্ধমায়ায় বিস্মরিত হই বাস্তব। হৃদয়পাত্র পূর্ণ হয়ে ওঠে প্রকৃতি ও পরিবেশের অনির্বচনীয় দানে। মনে মনে কৃতজ্ঞ হই যাঁর প্রতি, শুরুতেই তাঁর কথা একটু বলে নেওয়া ভালো। বন্ধু, সাহিত্যিক ছন্দা চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার কত বছরের সম্পর্ক আজ আর মনে করতে পারি না। তার পরিবারের একজন করে নিয়েছে সে আমায় কবে থেকে, সেও এখন প্রায় ভুলে যাওয়া অতীত। আমি কলকাতা ছেড়ে উত্তরবঙ্গে চলে আসার পর সবথেকে যার সঙ্গে আমার নিত্য যোগাযোগ, সে হলো ছন্দা।
আমাদের সম্পর্ক আজ যাপনের এমন প্রান্তে, যেখানে দাঁড়িয়ে সহজেই তার কাছে আমার দাবি/আবদার পেশ করতে পারি আমি। বীরভূমের নিতাইপুরে ছন্দাদের একটি ফার্মহাউস আছে আগেই জানতাম। তার অনেক গল্পও শুনেছি। যাওয়ার লোভও হয়েছে। কলকাতায় থাকাকালীন বহুবার সেখানে যাবার কথা উঠলেও নানা কারণে হয়ে ওঠেনি। গত সপ্তাহে কলকাতায় কার্যসূত্রে গিয়ে হাতে দুদিন সময় পেয়েই ছন্দার কাছে নিতাইপুর যাওয়ার আবদার পেশ করে দিলাম। অতঃপর এখন এই অপূর্ব গোধূলিবেলায় আমি নিতাইপুরে, গ্রাম্য প্রকৃতির স্বপ্নময় পরিবেশ চেটেপুটে নিচ্ছি দু’চোখ ভ’রে। এই ট্রিপে আমি ও ছন্দা ছাড়া আছে তার ছোট ভাই তুষারকান্তি ঠাকুর, আপনজনেদের কাছে মিঠু। সেই নামেই আমিও তার কথা বলবো।
সে এক চলন্ত উচ্ছ্বাস ! নিরুৎসাহী, নিরুত্তাপ মানুষকে উৎসাহের আগুনে তাতিয়ে তুলতে জুড়ি নেই তার। আমাদের মতো ষাটোর্ধ মানুষকে কিছুতেই আরাম করতে না দিয়ে, পৃথিবীর রূপ-রস-রঙ আস্বাদনে টেনে নিয়ে যাওয়াই যেন তার ব্রত ! এই ট্রিপের আনন্দময় মুহূর্তগুলি গড়ে তোলার অন্যতম কারিগর আমার এই পাগল ভাই। তার কথা বাদ দিয়ে এই রচনা তাই অসম্পূর্ণ। এই যে কেজো আমি নিতাইপুরে এসেও ঘরের মধ্যে মুখ গুঁজে আগামী এসাইনমেন্টের লেখা লিখছি নিতান্ত বাধ্য হয়ে, তাকে ডেকে হেঁকে ঘরের বাইরে এনে প্রাক-পূর্ণিমার চাঁদ দেখিয়ে মোহিত করে দেওয়া, মিঠু না থাকলে, এ অসম্ভব ছিল।
এবার একটু চাঁদের কথা বলি। ডিসেম্বরের কুয়াশামাখা চরাচর ঢেকেছে কী অপরূপ নরম আলোয়। অনেকটা ছড়ানো জমির ওপর দাঁড়ানো এই বাড়ির চারপাশে প্রচুর গাছপালা, অনেকটা সবুজ ঘাসের জমি আর ছোট্ট একখানা বাঁধানো পুকুর। এখন সেই সবেরই ওপর দিয়ে পিছলে যাচ্ছে চাঁদের আলো। মুগ্ধতা সঙ্গী করে ঘরে ফিরি। ক্লান্তি ছিল কিছুটা। আজ সকালেই সারা রাত ট্রেন জার্নি করে শিলিগুড়ি থেকে কলকাতা এসেছি। তারপর আবার প্রায় চার-পাঁচ ঘণ্টা গাড়িতে এখানে আসা। অতএব ডিনার ও বিশ্রাম। ছন্দার পরিবারের একটি অংশ কলকাতায়। কয়েকজন এখানে। সকলেই অপরিসীম অতিথিবৎসল। যত্নের আধিক্য প্রবল। আমি স্বভাব পেটুক মানুষ। এখানে এসে যাকে বলে, নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখাই কঠিন হয়ে পড়ে। তবে, যেটা আসল কথা, উপকরণ নয়, সে তো আছেই। আপ্লুত হই এঁদের আন্তরিক ব্যবহারে।
ঘুম ভাঙ্গলো পাখির ডাকে। ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় আসতেই মন ভালো হয়ে গেল সামনের দৃশ্যপটে। প্রথম আলোর চরণধ্বনি ততক্ষণে অশ্রুত সঙ্গীতে পরিণত–গাছের ফাঁকে ফাঁকে সোনালি আলোর কণা বিচ্ছুরিত। শান্ত জনপদে শুধু পাখিদের মধুর কলতান। মনে মনে বলি, এমন পবিত্র প্রভাত রোজ কেন হয় না ? মনই উত্তর দেয়, রোজ হয় না বলেই তো এমন পবিত্র ও দুর্লভ এই ক্ষণ ! ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলে। আজ আমাদের শান্তিনিকেতন যাওয়া। দ্রুত স্নান ও ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়ি। বাতাসে হালকা হিমের পরশ। লালমাটির দেশ ততক্ষণে একটু একটু করে জেগে উঠেছে। পথের দু’ধারের গ্রাম-জীবনে কর্মচাঞ্চল্য। দু’পাশে প্রাচীন গাছের সারি–বট, অশ্বত্থ আর কত নাম না জানা গাছেরা দাঁড়িয়ে। প্রচুর খেজুর গাছ রয়েছে দেখলাম এদিক-ওদিক। মনে পড়লো, রাতে খাওয়া খেজুরের গুড়ের অপূর্ব আস্বাদ। এই যাত্রায় প্রথমেই দর্শন হলো আমার কুটির। কোপাইয়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে এই অসাধারণ হস্তশিল্পকেন্দ্র। ভিতরে অনেকটা ছড়ানো জায়গা। এক পাশে রবীন্দ্রনাথের মূর্তি দন্ডায়মান। লাল দোতলা ভবনে অপূর্ব কারুকাজ মন্ডিত নানা সামগ্রী–শাড়ি, পোশাক, ব্যাগ, চাদর কী নেই সেখানে ! এই কারুকাজের মধ্যে বাটিক ছাড়াও রয়েছে আরও রকমারি ডিজাইন।
শান্তিনিকেতনে ছন্দার পড়াশোনা। জীবনের অনেকটা সময় সে কাটিয়েছে এখানে। ফলে, মাঝে মাঝেই নষ্টালজিক হয়ে পড়া তার। ওদের পৈতৃক বাড়ি কীর্ণাহার, বর্ধিষ্ণু এই গ্রামে আমি ছন্দার সঙ্গেই আগেও একবার এসেছি, এবারও যাওয়া হলো। কীর্ণাহার প্রসঙ্গে পরে আসছি। আগে শান্তিনিকেতনের কথা। ছন্দা আর মিঠু, দুই ভাইবোন গাড়িতে যেতে যেতে এদিক ওদিক দেখে বারে বারেই ফিরে যাচ্ছিল পুরোনো দিনে। আমিও ওদের কথার শরিক হয়ে শুনছিলাম শান্তিনিকেতনের পুরোনো গল্প। শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, সেদিন যা ছিল, আজ তার সবই কী গিয়েছে হারিয়ে? জানলাম, ঐতিহ্যবাহী পৌষমেলা চরিত্র বদলের সঙ্গে সঙ্গে স্থানও বদলেছে। পুরোনো মানুষদের হৃদয়ে এই সবই কোথাও এক গোপন ক্ষতর সৃষ্টি করে।
আমার তেমন কোনও স্মৃতি নেই। প্রাণের ঠাকুর রবীন্দ্রনাথকে প্রাণে রেখেই চলেছি জীবনপথ। শান্তিনিকেতনে কার্যকারণে দু’বারই মাত্র আসা। তারও যা স্মৃতি, সেই বিন্দুতে দাঁড়িয়ে আজকের কোপাই বা সোনাঝুরি দেখলে, প্রাপ্তি শুধুই বিষন্নতা। অন্যদিকে অনেক আশা করে এলেও আশ্রমের মূল অংশের কিছুই দেখা হলো না। ভিতরে যাওয়ার নিয়মে তালা পড়ে গেছে। অতএব বাইরে, পথে পথে ঘুরে যতটুকু নির্যাস সংগ্রহ করা যায়, তাতেই খুশি থাকতে হলো। নানা কারণে ধ্বংসের পরেও রয়েছে প্রচুর গাছ। আছে পাখিদের কলকাকলি। তাদের সঙ্গে মোলাকাত অনেক না পাওয়ার মাঝেও অমূল্য প্রাপ্তি হয়ে থাকে। একদিন এরাও ছিল চারাগাছ। ছিল পাখপাখালির পূর্বপুরুষরা। গুরুদেব হয়তো পথ চলার অবকাশে ছুঁয়ে গেছেন ওদের। ভালোবেসেছেন। সকলেই জানেন, শান্তিনিকেতন অনেকদিন আগেই বিচ্যুত হয়েছে রবীন্দ্র আদর্শ ও দর্শনের পথ থেকে। রাজনীতির ঘোটালা তাকে অশান্তিনিকেতন তকমাও দিয়েছে। তবু, বাতাসে আজও কান পাতলে শোনা যায়, সেই মহামানবের অমৃতময় বাণী। অবশ্য শুনতে চাইলে, তবেই।
ঘুরতে ঘুরতে পথের ধারে আরশাদের মনোহারি পসরায় সাজানো ভ্যানগাড়িটি দেখে এক লহমায় ফিরে গেলাম শৈশবে। এসব দৃশ্য বিরল এখন। ছবি তুলবো বলতে, একটু বিরক্ত হয়েই পোজ দেয় সে। স্বাভাবিক, তার আগ্রহ বিকিকিনিতে। আমি নিরুপায়। নানা কাজ নিয়ে এসেছি। এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছি। ভঙ্গুর সামগ্রী নিয়ে চলাফেরা করা মুশকিল। সে হোক, বিরক্ত হয়েও আরশাদ ও তার বাহারি চলমান দোকান থেকে গেল আমার ফোন ও মন ক্যামেরায়। ছন্দার পরিবারের আর এক সদস্যের বাড়ি কাছেই, বোলপুর শহরে। দারুণ গুণী তরুণী এই কন্যাটির সঙ্গে আলাপিত হয়ে মন ভরে গেল। তাকে নিয়েই সবাই মিলে লাঞ্চ বোলপুর ট্যুরিস্ট লজে। চমৎকার ব্যবস্থা। পরিচ্ছন্ন ও পেশাদারী পরিষেবা। খেতে খেতে মিনি আড্ডা। এবার যাব কীর্ণাহার। সূর্য মাথার ওপরে। বাতাসে ঠান্ডার লেশমাত্র নেই। পিচ রাস্তা ধরে গাড়ি চললো আমাদের। দুপাশে ছোট ছোট গ্রাম, ধানক্ষেত আর গাছপালা। কীর্ণাহার পৌঁছে কিছুক্ষণ কাটিয়ে ফিরলাম নিতাইপুর। এতক্ষণে মালুম হলো ঠাণ্ডা। আপাতত চা পান। কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক আড্ডা। তারপর টাটকা শাকসবজি সহযোগে গরম গরম খিচুরি, সঙ্গে অমলেট আর পোস্তবড়া–জমে গেল ডিনার। আবহে রাতচড়া পাখির ডাক। স্তব্ধতা ছড়ায় বাতাসে। ঘুম নামে চোখে।
পরদিন দ্রুত স্নান ও হালকা লাঞ্চ সেরে বেরিয়ে পড়া কলকাতার পথে। দুটি দিন কেটে যায় স্বপ্নের মতো। পারিবারিক আদর-আপ্যায়ন থেকে প্রকৃতির সান্নিধ্য, সকাল সন্ধ্যা সুযোগ পেলেই নির্ভেজাল আড্ডা, সন্ধ্যায় মুড়ি মাখা আর গরম চা–এসব ভোলার নয়। যাঁরা জানেন, তাঁরা জানেন এই অঞ্চলের মুড়ির খ্যাতি। লোভীর মতো মুড়ি খেয়েছি দুদিন। আর খেয়েছি জিভে লেগে থাকা স্বাদের মিষ্টি। সুগারের আতঙ্ক ঝেড়ে ফেলেই খেয়েছি। এইসব নিয়মভাঙার খেলা খেলতেই তো দিকশূন্যিপুরে যাত্রা। বলতে দ্বিধা করবো না, প্রকৃতির ঘেরাটোপে পল্লবিত নিতাইপুরের এই বাড়িটি আমায় দু’টি দিন যথার্থই নিয়ে গেছিল দিকশূন্যিপুরে। বাড়তি পাওনা, বাড়ির মানুষগুলির অকৃত্রিম সমাদর। এই কলমে সচরাচর আমি বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র নিয়েই লিখি। এবারে একটু ব্যাক্তিগত আলাপচারিতা। খুঁজলে আপনারাও আশপাশের চেনা মহলে পেয়ে যাবেন এমন দিকশূন্যিপুরের ঠিকানা।