উপত্যকায় এক মায়াবী জ্যোৎস্নায় মাখামাখি রাত
দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম। এই সপ্তাহে চলুন যাই কমলালেবুর দেশে অজন্তা সিনহার সঙ্গে।
জানালা দিয়ে সকালের মিঠে রোদ ঢুকে পড়েছে কামরায়। ডিসেম্বরের শেষ। ঠান্ডা জব্বর। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে ঢোকার মুখে দুটি স্টেশনের মাঝে দাঁড়িয়ে ট্রেন। আবহাওয়ার কারণেই বোধহয় ট্রেন এমন বেজায়গায় হঠাৎ থেমে যাওয়ার পরেও তত বিরক্ত নন যাত্রীরা। রোদের আমেজ চেটেপুটে নিচ্ছেন সকলেই। আমার অবস্থা অবশ্য বেশ খারাপ। ট্রেনে ওঠার আগে পুরো দিনটা অফিসে কাটিয়েছি। এরই মধ্যে গাড়ির ড্রাইভার বেশ কয়েকবার ফোন করেছে। দার্জিলিং মেল পৌঁছনোর নির্ধারিত সময়েই নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে পৌঁছে গেছে সে। অপেক্ষায় বিরক্ত হওয়ার কথা তারও। তবে,পাহাড়ের মানুষজনের ধৈর্য কিছু বেশি। প্রতিবারই ফোনে ট্রেন থেমে থাকা ও সেই জনিত লেটের খবর শুনে হেসে বলে, ঠিক আছে ম্যাডাম, আপ আরামসে আইয়ে।
ট্রেন ঢুকতে ঢুকতে বেলা দশটা বাজলো। অর্থাৎ পাক্কা দুঘন্টা লেট। পরিষ্কার আকাশে রোদ ঝলকাচ্ছে। মালপত্র নিয়ে দ্রুত গাড়িতে উঠি। ড্রাইভার ভিড় এড়াতে শিলিগুড়ি শহরের ভিতরের পথ এড়িয়ে বাই পাস ধরে। ফলে তুলনায় তাড়াতাড়ি সেবক রোডে পৌঁছে যাই আমরা। কিছুক্ষণ যেতেই মহানন্দা রেঞ্জ শুরু। ছায়াঘন ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক সোজা চলে গেছে। কিছু দূর যাওয়ার পর তিস্তা। শীতে শীর্ণ জলের রেখা। তবু সে তিস্তা। আকর্ষণ যার কমে না কিছুতেই। দুদিকে পাহাড়ের শ্রেণী রেখে আঁকাবাঁকা গতিতে এগিয়ে চলেছে উত্তরবঙ্গের অন্যতম আকর্ষণ এই নদী। তিস্তাকে পাশে রেখে বেশ কিছুটা যাব এবার। এই অবকাশে জানাই, এবারের গন্তব্যের নাম। চলেছি কমলালেবুর দেশে, যার ভৌগোলিক নাম সিটং।
দার্জিলিং-এর খ্যাতি নানা বিষয়ে। যার মধ্যে একটি এই কমলালেবু। মজার কথা হলো, দার্জিলিং-এর বিখ্যাত কমলালেবুর সিংহভাগই উৎপন্ন হয় সিটং-এ। এবার বড়দিনের ছুটিতে চলেছি সেই কমলার বাগানে, সিটং উপত্যকায়। রাম্বি বাজার পর্যন্ত টানা চললাম। পথের একধারে খাড়া পাহাড়। একধারে তিস্তা। রোদ ক্রমশ চড়া হচ্ছে। রাস্তা মূলত চড়াইগামী। রাম্বি বাজার বেশ জমজমাট জায়গা। মনটা চা চা করছে অনেকক্ষণ। সুরজকে (গাড়ির ড্রাইভার) বলতেই একটি ছোট দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করালো সে। বেশ ছিমছাম ও পরিচ্ছন্ন। চায়ের সঙ্গে এক প্লেট মোমোও খাওয়া হলো। সাধারণ ভেজ মোমো, শুনলাম বাঁধাকপি দিয়ে বানিয়েছে। কিন্তু অতীব সুস্বাদু। সুরজকে ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়িতে উঠি। জানতে পারি যাওয়ার পথে মংপু পড়বে। আমার তাড়া না থাকলে, সে একবার ঘুরিয়েও দেবে। তাড়া ? এমন কোন বাঙালি বা ভারতীয় আছে, যে জীবনে বারবার তাঁর দরজায় যাওয়ার সুযোগ ছাড়বে ! আমি তো একেবারেই নই। পাঠক নিশ্চয়ই জানেন মংপুর গুরুত্ব। তবু বলি, এ হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উত্তরবঙ্গ আবাসের একটি।
মংপুতে এর আগেও এসেছি। সেটা ছিল ঘোর বর্ষা। এটা শীত। মরশুমের নিয়ম মেনেই ঝরাপাতার দল আলপনা এঁকেছে রবি ঠাকুরের পাহাড়ী আস্তানার বাগানে। একই সঙ্গে বাগান আলো করেছে চেনা গাঁদা আর কিছু অচেনা বাহারী ফুল। সঙ্গে পাতাবাহারও হাজির। রবীন্দ্রনাথের এই শৈলাবাস দেখতে আসেন সারা বিশ্বের মানুষ। আমিও তাদেরই একজন। দ্বিতীয়বার এসেও তাই সমান রোমাঞ্চ অনুভব করি। এবার যেতে হবে। একরাশ ভালো লাগা নিয়ে বেরিয়ে আসি। গাড়ি ভবনের গেটের বাইরেই ছিল। সেখানে তখন প্রথম দুপুরের রোদ্দুর তাপ ছড়িয়েছে। গাড়ি গেটের বাইরে বের হচ্ছে। যেতে যেতে দেখি প্রাচীন গাছ, সিনকোনা বাগান, সিনকোনা প্রসেসিং সেন্টার। দেখে আবার রওনা। মংপু থেকে সিটং সাড়ে আট কিলোমিটার। সুরজের তথ্যে আশ্বস্ত হই। পেটে ছুঁচোরা রীতিমতো দৌড়োচ্ছে। পাহাড়ের জলহাওয়া এমনই। খুব তাড়াতাড়ি হজম আর খিদে।
কিছু দূর যেতেই দেখা রিয়াং নদীর সঙ্গে। স্থানীয়দের খুব প্রিয় পিকনিক স্পট। এদিনও দেখলাম একদল তরুণতরুণী ভিড় জমিয়েছে রিয়াং-এর কোলে। তাদের উচ্ছ্বাস মিশে যাচ্ছে নদীর কলকল ধ্বনি, উত্তুরে বাতাসের ঘূর্ণির সঙ্গে। নদীর উৎস মানে ঝর্ণা কাছেই। এখন অবশ্য সর্বত্রই জল কম। সুরজের কাছে শুনলাম নদী পার হয়েই যাব আমরা। মানে ? শুনে চোখ কপালে ওঠার যোগাড়। এখানে পথ কোথায় ? আশ্বস্ত ক’রে সুরজ জানায়, ওই প্রবল বেগে ( যতই জল কম হোক ) বহতা রিয়াং-এর ওপর দিয়েই যাবে আমাদের গাড়ি। পাশে ব্রিজ তৈরি হচ্ছে দেখলাম। আমি সিটং গেছিলাম বেশ কয়েক বছর আগে। সেই ব্রিজ এখন তৈরি হয়ে গেছে। ব্রিজের নাম যোগীঘাট। যোগী বাবা রামদেব নাকি এসেছিলেন উদ্বোধনে। তার জন্যই যোগীঘাট ? সে যাই হোক, আমার জন্য নদীর ওপর দিয়ে গাড়ি চড়ে যাওয়াটা যে দারুণ রোমাঞ্চকর এক অভিজ্ঞতা হয়েছিল, সেটা বলাই বাহুল্য।
এরপর আরও অনেকটা পথ পেরিয়ে, চড়াই-উৎরাই পার হয়ে সিটং পৌছলাম মাঝ দুপুরে। রাস্তা মাঝে মাঝেই বেশ খারাপ। পথে পড়লো ছোট ছোট গ্রাম, কাছে-দূরে পাহাড়, গাছপালা আর কমলার বাগান। সে এক অভাবনীয় ব্যাপার। জীবনের কয়েক দশক পার হয়ে এসে প্রথম দেখলাম গাছে ঝুলন্ত কমলালেবু। নানা আকার, আর কমলা রঙেরও নানা শেড। একটা জায়গায় রোদে ছড়ানো লেবুর স্তূপ। প্যাকিং হচ্ছে দেখলাম। এগুলো বাজারে যাবে। বাজার মানে বৃহৎ তার পরিধি, দেশ ও দেশের বাইরে। যাঁরা বাগানে বা প্যাকিংয়ের কাজ করছেন, তাঁরা সকলেই এ অঞ্চলের মানুষ। আমার বিস্ময়ানুভূতি দেখে মজা পাচ্ছিলেন বোধহয়। একজন কয়েকটি কমলালেবু হাতে তুলে দিলেন আমার। এঁরা সকলেই সুরজের চেনা। শুরুতেই জানিয়েছিল, সে এই গ্রামেরই বাসিন্দা।
দার্জিলিং জেলার অন্তর্গত সিটং-এর উচ্চতা মোটামুটি চার হাজার ফুট। কিন্তু ঠান্ডা সে তুলনায় কিছু বেশি। কারণ এটা একটা বৃহৎ ও ছড়ানো উপত্যকা। চারপাশ খোলা। উত্তুরে হাওয়া বইছে পাগলের মতো। দূর দূর পর্যন্ত যতটুকু চোখ যায় শুধুই পাহাড়। ধাপে ধাপে ঘরবাড়ি। হোমস্টে-র কর্ণধার হাসি মুখে আপ্যায়ন করেন। তিনতলা বাড়ি। নিচে বসবার ব্যাবস্থা, রান্না ও খাবার ঘর। সাজানো ও পরিচ্ছন্ন। বাকি তলাগুলিতে অতিথিরা থাকে। ওঁরা নিজেরাও থাকেন। আমাকে নিয়ে গেলেন তিনতলায়। ঘরটিতে বড় বড় জানালা, সেখান দিয়ে পুরো উপত্যকা নজরে আসে। আর দেখা যায় অনেকটা আকাশ। ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ। তালিকায় ছিল ভাত, ডাল, বেগুন ভাজা, পাপড় আর চিকেন। সঙ্গে আচার। চিকেনের প্রিপারেশন পাক্কা পাহাড়ী, বেশ ঝাল আর অনেকটা রসুন দিয়ে বানানো। একে খিদে, তায় ঠান্ডা। যাকে বলে জমে গেল খাদ্য উৎসব।
লাঞ্চের পর ছাদে গেলাম। সেখানে নানা ফুলের গাছ ও অর্কিড। বর্ণময় প্রজাপতির দল নিশ্চিন্তে নেচে বেড়াচ্ছে ফুলের ওপর। শেষ বিকেলের সূর্য মায়াবী হয়ে উঠেছে আকাশে। পাখিরা ঘরে ফিরছে। তাদের কিচিরমিচির ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। অনেক দূর থেকে একটি গরুর ডাক শোনা গেল, ঘরে ফিরতে চায় সেও। ঠান্ডার প্রকোপ বাড়ছে। অতএব আমারও ঘরে ফেরা। পাহাড়ে এমনিতেই সন্ধ্যা নামে দ্রুত। তার মধ্যে শেষ ডিসেম্বর। ঝপ করে অন্ধকার তার আঁচল উড়িয়ে ঢেকে দিলো পুরো উপত্যকা। একটু পরেই কফি আর পকোড়া নিয়ে আসবেন, জানিয়ে গেলেন হোম স্টে-র কর্ণধার। তার মাঝে সিটং নিয়ে আরও কিছু তথ্য।
প্রথমেই বলি সিটং এমনিতেই বেশ নয়নাভিরাম। উত্তরবঙ্গের আর সব অঞ্চলের মতোই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এখানেও উজার করে ঢেলে দিয়েছেন ঈশ্বর। তবে, কমলার বাগান দেখার অভিজ্ঞতাই আলাদা। জেনে রাখা ভালো, কমলালেবুর ফলন দেখতে হলে আসতে হবে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে। এছাড়াও এখানে সিনকোনা চাষ হয়। মংপু-সিটং বেল্টটা সিনকোনা চাষের জন্য বিখ্যাত। এর বাইরে হয় বড় এলাচ। আছে সব ধরনের শাকসবজি। ফলের মধ্যে কমলালেবু ছাড়াও হয় কলা, পেঁপে। আর ফুলঝাড়ু যে গাছ থেকে হয়, তারও চাষ হয় সিটং-এ। গ্রামের মানুষ মূলত কৃষিজীবী। নিজেদের খাওয়ার বাইরে উৎপাদিত শাকসবজির পুরোটাই তারা কালিম্পং ও কার্শিয়ং-এর বাজারে বিক্রি করে। এছাড়াও রুটিরুজির জন্য ড্রাইভারিকে পেশা হিসেবে নেয় অনেকেই। পুলিশ ও সেনা বিভাগের কাজেও যায় কেউ কেউ। স্থানীয় মানুষ পর্যটন ব্যাবসায় আসতেও আগ্রহী। কেউ কেউ করছেনও। তবে, রাস্তা ভালো হলে, এতে বাড়তি উদ্দীপনা যুক্ত হতে পারে, বলাই বাহুল্য।
সিটং আদতে খাসমহল, অনেকগুলি ছোট ছোট গ্রাম মিলে গড়ে উঠেছে অঞ্চলটি। বসবাসের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। রয়েছে শতাব্দী প্রাচীন এক গুম্ফা, বাঁশ ও মাটি দিয়ে তৈরি। গুম্ফাটি আপার সিটং-এ। ট্রেক করে উঠতে হয়। এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার দারুণ ভিউ পাওয়া যায় শুনলাম। একটি অতি প্রাচীন গির্জাও রয়েছে। গির্জাটি একেবারে হোমস্টে লাগোয়া। এটিও বাঁশ আর মাটির তৈরি ছিল আগে, সম্প্রতি সংস্কার হয়ে পাকা দালান। তবে, স্থাপত্যে পুরোনো আঙ্গিক ব্যবহার হওয়ায়, গির্জার প্রাচীন রূপটি রক্ষিত হয়েছে।
পকোড়ার দুর্দান্ত স্বাদ ভোলার আগেই ডিনার নিয়ে ওপরে উঠে আসে এক নেপালী তরুণী। খুব মিষ্টি চেহারা, চোখদুটিতে অপার সারল্য। শুনলাম কালিম্পঙে থেকে পড়াশোনা করে। এখন ছুটি, তাই বাড়িতে। ভবিষ্যতে বাবার হোমস্টে চালনার কাজে সাহায্য করবে, সেটা রয়েছে তার ভাবনায়। পড়াশোনা শেষ হলে এই গ্রামেই থাকতে চায় সে। এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে বাবার ব্যাবসা। বয়স হলে আর তো খাটতে পারবেন না তিনি ! কিছুক্ষণ গল্প করে নিচে নেমে যায় মেয়েটি। আমাদের কথা থামতেই, থেমে যায় সব শব্দ। রাত নামে হিমেল আবেশে। সারারাত, সারাদিনের ক্লান্তি। ঘুম নামতে একটুও দেরি হয় না। উপত্যকা ততক্ষণে মায়াবী জ্যোৎস্নায় মাখামাখি। বন্ধ জানালার ফাঁকফোকড় দিয়ে সেই আলো চুইয়ে পড়ে ঘরে, নিয়ে যায় এক কোমল স্বপ্নের দেশে।
মাঝে একটা দিন। তারপরেই ফিরতে হবে। এটা আমাদের, মানে সংবাদ মাধ্যমে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের জন্য লম্বা ছুটির সময় নয়। অর্থাৎ হাতে শুধু আজকের দিন। ব্রেকফাস্ট আসবে একটু পরে। ঘুম ভেঙেছে পাখির ডাক শুনে, অনেক ভোরে। প্রসঙ্গত, সিটং হলো পাখির স্বর্গ। মহানন্দা স্যাংচুয়ারী কাছেই। কাছে লাটপাঞ্চারও। লাটপাঞ্চারও এখানকার এক আকর্ষণীয় টুরিস্ট স্পট, সিনকোনা চাষের জন্য বিখ্যাত। সিটং-এ পাখির বৈচিত্র্য এইসব কারণেই। সকালের অনেকটা সময় তাদের ওড়াউড়ি চলে, সঙ্গে কলকাকলি। লাটপাঞ্চার ছাড়াও কাছাকাছির মধ্যে আছে বাগোড়া, চটকপুর। আমি এলাম মংপু হয়ে। অন্যদিকে কার্শিয়ং, মিরিক হয়েও আসা যায় সিটং। অর্থাৎ এই অঞ্চলকে ঘিরেই অনেকগুলি স্পট দেখে নেওয়া সম্ভব। ছোট ছোট ট্রেকিং রুটও আছে সিটং-এ। ব্রেকফাস্ট আসে। মেয়েটি চিকেন স্যান্ডউইচ বানিয়ে এনেছে, সুন্দরভাবে সাজিয়ে। সবকিছুর মধ্যে যেমন রুচিবোধ, তেমনই আন্তরিকতা। মন ভালো হয়ে যায় সহজেই।
আগেই ঠিক করা ছিল আজ কমলালেবুর বাগান দেখতে যাব। বেরিয়ে পড়লাম পায়ে হেঁটে। এখানে প্রায় সব বাড়িতেই কমলালেবুর চাষ হয়। একজন জানালেন, এ বছর কোনও কারণে পোকা লাগার ফলে চাষ কিছু কম হয়েছে। নাহলে, এই সময় নাকি পুরো গ্রামটারই রং কমলা হয়ে যায়। পথ অনেকটা চড়াই। তাই বেশি দূর যাওয়া হয়ে ওঠে না। গির্জার প্রবেশপথ বন্ধ, বাইরে থেকেই দেখি তাই। রোদ প্রখর হয়। ফিরে আসি হোম স্টে-তে। লাঞ্চে আজ ডিম কারি, সঙ্গে শীত-সবজির পাঁচমেশালী ব্যাঞ্জন, ডাল, আলু ভাজা ও স্যালাড। আচার তো আছেই। নিচের ডাইনিং রুমে আরও কয়েকজন টুরিস্ট আছেন দেখলাম। একটা বড় পরিবার, শুনলাম আজ সকালেই এসেছেন তাঁরা। খাওয়ার পর নিজের ঘরে। রোদ্দুর হেলেছে পশ্চিমে। তারপর নিয়মমতোই সূর্য অস্তে যান। সন্ধ্যা নামে। কালই আভাস পাচ্ছিলাম। এবার নিশ্চিত হলাম। আকাশে রুপোর থালা। বুঝলাম আজ পূর্ণিমা। কী যে তার রূপ ! ঠান্ডা যথেষ্ট। তবু খুলে রাখি জানালা। চাঁদের মায়াময় আলোক বিচ্ছুরণ দেখে চোখ ফেরাতে পারি না। এক সময় জানালা বন্ধ করতেই হয়। ডিনারের শেষে ঘুম। ততক্ষণে ঠান্ডা পড়েছে জাঁকিয়ে।
সকালে ঘুম ভাঙতেই গরম চা হাজির। সঙ্গে এঁদের ঘরে বানানো কুকি। মেয়েটিই এসেছে নিয়ে। ছোট আড্ডায় জানা যায় ওদের জীবনকথা, প্রতিদিনের বেঁচে থাকার লড়াই, বহু যুগের ইতিহাস। শিক্ষার জায়গাটায় এখনও বড় পিছিয়ে তারা। আমি অনেক দিন আগে গেছিলাম। জানি না কতটা পরিবর্তন হয়েছে এখন ! সেইসময় এলাকায় সরকারি প্রাইমারি স্কুল ছিল মাত্র দুটি। একটি প্রাইভেট প্রাইমারি স্কুলও ছিল, ইংলিশ মিডিয়াম। জুনিয়র হাইস্কুল দুটি–তার একটা কেন্দ্রীয় সরকারের, অন্যটি প্রাইভেট, জিটিএ-র অধীনে চলে। চিকিৎসা ব্যবস্থাও তথৈবচ। একটাই হাসপাতাল, যেখানে বেশির ভাগ সময়ই ডাক্তার থাকে না। কঠিন রোগে যেতে হয় কালিম্পঙে। এত কিছু না পাওয়ার জন্য অবশ্য থামে না জীবন। বেঁচে থাকার লড়াইটা ওরা শিখে যায় পুরুষানুক্রমে।
বিস্তৃত ছড়ানো উপত্যকা জুড়ে প্রকৃতি সাজিয়েছে তার সৌন্দর্যের ডালি। পর্যটন আকর্ষণ বাড়ছে। আরও অনেক অনেক পর্যটক আসুক, এটাই এখানকার অধিবাসীদের প্রার্থনা। আমি যখন গেছিলাম, তখন থাকার ওই একটাই জায়গা। আজ সিটংয়ের পরিচিতি বেড়েছে। অনেকগুলি হোমস্টে-ও হয়েছে এখন। বেলা বাড়ে। আজ ইচ্ছে করেই ব্রেকফাস্ট স্কিপ। কারণ আর্লি লাঞ্চ করে বের হতে হবে। গরম গরম ডাল, আলু, ডিম সেদ্ধ, ঘি ভাত ছিল লাঞ্চে। খেয়েদেয়ে নিচে নামি। ব্যাগপত্র গাড়িতে তুলে দিয়েছে সুরজ। তার গাড়িতেই যাব নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন। শেষবারের মতো চেটেপুটে নিই উপত্যকার অপার সৌন্দর্য। পাখি আর প্রজাপতিরা বিদায় জানায় তাদের ভাষায়। বাতাসে দোলে কমলালেবু গাছের পাতা। উত্তুরে বাতাস দ্রুত উড়িয়ে নিয়ে যায় গাছের পাতা। গির্জার ঘন্টা বাজে। আমার প্রহর ফুরোয় সিটংয়ে। এবার ফেরার পালা। সঙ্গী সিটং বাসের অমলিন অভিজ্ঞতা।
এখন প্রচুর হোমস্টে হয়েছে সিটংয়ে। তবে, আমি যখন যাই, তখন ছিল একটিই থাকার জায়গা। সেইদিক থেকে ইয়াকসা হলিডে হোমস্টে হলো সিটংয়ের প্রথম হোমস্টে। আজ, এত বছর পরেও এই পরিবারের আন্তরিকতার স্মৃতি আপ্লুত করে রেখেছে আমায়। বুকিংয়ের জন্য যোগাযোগ : 97330 80866