একটি মানবিক উপাখ্যান
সে এক ঝড়জল সিক্ত রাতের কথা। জেলাশহর বারুইপুরে থাকি তখন। সাংবাদিকতা পেশায় যা ঘটে, অর্থাৎ ঘড়ি ধরে ঘরে ফেরা প্রায় অসম্ভব ! সে রাতেও অফিস থেকে ছুটতে ছুটতে শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছে জানতে পারলাম ট্রেন বন্ধ। তারপর অনির্দিষ্টকালের অপেক্ষা। স্টেশন লোকে লোকারণ্য। দুপুর থেকেই অনিয়মিত ট্রেন। খেপে খেপে লোকজন জড়ো হয়েছে। শহরতলী থেকে অসংখ্য মানুষ রুটিরুজির জন্য কলকাতা শহরে আসে রোজ। তাদের সবার মুখে প্রবল টেনশনের ছাপ। টেনশন আমারও কম নয়। বারুইপুর স্টেশনে গিয়ে রিকশা না পেলে আমাকেও হাঁটতে হবে।
এরই মধ্যে দৈববানীর মতো ট্রেনের ঘোষণা হয়। সবাই যে যার নির্দিষ্ট ট্রেনের দিকে ছোটে। জনজোয়ারে ভেসে আমিও কোনও মতে মহিলা কামরায় পৌঁছই।
সেখানেও তিল ধারণের জায়গা নেই। কি ভাগ্য, আধখানা শরীর বাইরে রেখে হলেও একটা বসার সিট পাই। তখন সেটুকুই স্বর্গ। গড়িয়া স্টেশন যাওয়ার পর থেকেই কামরা ফাঁকা হতে থাকে। সঙ্গে এটাও হতে থাকে, পরিস্থিতির কারণেই বিভিন্ন স্টেশন থেকে পুরুষরাও উঠে পড়ে মহিলা কামরায়। অন্যদিন যা-ই হোক, সেই রাতে বাস্তব কারণেই এ নিয়ে ঝামেলা করে লাভ হতো না। অতএব মুখ বন্ধ !
বৃষ্টির মধ্যেই দেখি দিব্যি হকাররাও ট্রেনে উঠছে, ঘোরাফেরা করছে। লোকজন কিনছেও। এরই মধ্যে কখন যেন আমার সামনে একজন যাত্রী উঠেছেন খেয়াল করিনি। বোধহয় সোনারপুর থেকে। যাত্রী না যাত্রীনি। মানে, বেশ সুন্দরী এক কন্যা। কিন্তু চেঁচিয়ে বাদামওয়ালাকে ডাকতেই বাজখাই গলা শুনে চমকে উঠি। তবে, সেও ক্ষনিকের। এপথে নিত্য যাতায়াত করি, বৃহন্নলাদের সহযাত্রী হিসেবে পাওয়ার অভ্যাস আছে। তবে, ওদের তো আমরা এড়িয়েই চলি। আজও তেমনই এক মনোভাব নিয়ে গন্তব্যের অপেক্ষা করি। ঈশ্বর হাসেন ওপর থেকে। এবং তাঁর ইচ্ছেতেই মল্লিকপুর স্টেশনের ঠিক আগে ট্রেন থেমে যায়।
মল্লিকপুরের মহিলা ও পুরুষ যাত্রীরা সকলে ওখানেই ঝুপ ঝুপ করে নেমে পড়ে। খেটে খাওয়া মানুষ ওরা। রাত ১২টা বেজে গেছে অনেকক্ষণ। ট্রেন ছাড়ার অপেক্ষায় থাকলে ওদের চলে না। ঘরে গিয়েও তো কাজ আছে। কামরা এখন প্রায় খালি। দূরে একদল তরুণ ও মাঝবয়েসী মানুষ জমিয়ে গুলতানি করছে। আর আছেন আমার সামনের তিনি ! একটু নড়েচড়ে বসে, প্রশ্ন,” কি রে কোথায় নামবি ?” পিত্তিটা জ্বলে গেল। সোজা ‘তুই’ ? কিন্তু মুখে নির্বিকার ভাব এনে জবাবটা দিলাম।
অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ওদের সঙ্গে ঝামেলা করে খুব একটা লাভ হয় না। আমার জবাবের সঙ্গে সঙ্গেই নিজেরও তত্ত্বতালাশ দিতে শুরু করেন তিনি। শুনে একটু মায়াই হয়। বেচারি যাবে সেই সংগ্রামপুর। অর্থাৎ এখনও অনেকটা দূর। এদিকে ট্রেন ছাড়ার লক্ষণই নেই। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, টেনশন ব্যাপারটাও চলে গেছে। এরই মধ্যে কখন যেন ওই জটলাটা একেবারে কাছাকাছি চলে এসেছে। আবছা মনে হলো সংখ্যায় তারা বর্ধিত হয়েছে কিছুটা। কাছাকাছি এসে বসা ছাড়া এখনও পর্যন্ত ওরা এমন কিছু করেনি, যার জন্য অভিযোগ করা যায়। তবু, কোথাও একটা অস্বস্তি টের পেলাম ।
ট্রেন খুব ধীরগতিতে কষ্টেসৃষ্টে মল্লিকপুর পৌঁছলো। কিছু যাত্রী নামলো। সামনের তিনি নির্বিকার, উদাসীন। জানালা দিয়ে বাইরেটা দেখছে। বৃষ্টি একটু কম এখন। ট্রেন চলতে শুরু করেছে। গতি খুবই ধীর। হঠাৎ বিড়ির গন্ধ নাকে আসে। আমার একেবারে গা ঘেঁষে চলে এসেছে একটি লোক। আমি একটু ঠেসে বসি জানালার দিকে। সেও সরে আসে। ব্যাপারটা কতখানি সীমা ছাড়াবে, কি করতে পারে লোকটি ? ওরা সবাই কি একজোট ? এইসব নানা প্রশ্ন নিয়ে একটা ঠান্ডা শিহরণ শিরদাঁড়া বেয়ে নামতে থাকে। আমার সামনে, পাশের লোকটার পাশে, চারদিকে ততক্ষণে অনেকগুলি মুখ।
তারপরের ঘটনা। না, ঘটনা বলবো না, সে এক প্রবল নাটকীয় পটপরিবর্তন। আমার সামনের মানুষটি হঠাৎ উঠে দাঁড়ান। চোখমুখ আগুনের মতো লাল। আর মুখের ভিতর থেকে কামানের গোলার মতো ছিটকে আসে গালিগালাজ। সেসবের বর্ণনা নিষ্প্রয়োজন। শুধু একটি বাক্য ভোলার নয়, “কি ভেবেছিস তোরা ? কেউ নেই এখানে ? ওকে একটু টাচ করে দেখ, কি করি ?”
তাঁর সেই রণচন্ডী মূর্তি দেখে মুহূর্তের মধ্যে ভিড় হাওয়া।
আমি জানি না, এমন মানুষকে কি করে কৃতজ্ঞতা জানাতে হয়। আমার নির্বাক চোখে অসীম কৃতজ্ঞতাটুকু দেখতে পেয়েছিলেন হয়তো। হাসতে হাসতে বলেছিলেন, “ভয় পাস না। আর কেউ কিছু করবে না।” বারুইপুর স্টেশন আসার পর ট্রেন থেকে নেমে আমি মানুষের ভিড়ে পা মিলিয়ে চলতে শুরু করি। যতক্ষণ দেখা যায়, সেই মানুষটি জানালা দিয়ে দেখে আর হাসি মুখে হাত নাড়ে। মানুষ, পুরুষ বা নারী নয়, শুধুই মানুষ। যে মানুষ হাত বাড়ায়, বরাভয় যোগায়। স্টেশনে নেমে রিকশা পাইনি, একা একা হেঁটেই ফিরেছিলাম সে রাতে। ভয় ও ক্লান্তি উধাও–এক ‘মানুষের’ সঙ্গে দেখা হওয়ার আনন্দে।
★★ সঙ্গের ছবিটি সেদিনের সেই বরাভয়কারিণীর নয়। এঁকে পাই সম্প্রতি কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি আসার পথে দার্জিলিং মেলে। অনুরোধ জানাতেই ছবি তোলার অনুমতি দেন ইনি। তাঁকেও আমার কৃতজ্ঞতা।