এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর…
জীবনমরণের সীমানা ছাড়িয়ে ওঁরা আজ বহু আলোকবর্ষ দূরের এক জগতে। তবু আছেন ওঁরা আমাদের মাঝে। থাকবেন চিরদিন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সিনেমা জগতের সেইসব মানুষ, যাঁদের অবদান ছাড়া অসম্পূর্ণ আমরা, তাঁদের নিয়েই এই বিশেষ কলম। বাংলার মুখ দেখেছিলেন তিনি। দেখিয়েছিলেন আপামর বাঙালিকে। আজ কবি জীবনানন্দ দাশের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য। পড়ুন দেবজিৎ সাহার কলমে।
‘তারপর মৃত্যু তাই চাহিলাম–মৃত্যু ভালো–মৃত্যু তাই আর একবার/বিবর্ণ বিস্তৃত পাখা মেলে দিয়ে মাঝ-শূন্যে আমি ক্ষিপ্র শকুনের মতো/ উড়িতেছি–উড়িতেছি ; ছুটি নয়–খেলা নয়–স্বপ্ন নয়–যেইখানে জলের আঁধার/বৈতরণী–বৈতরণী–শান্তি দেয়–শান্তি–শান্তি–ঘুম–ঘুম–ঘুম অবিরত/তারই দিকে ছুটিতেছি আমি ক্লান্ত শকুনের মতো…’ –জীবনানন্দ দাশ
জন্ম ১৭ই ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৯। মৃত্যু ২২শে অক্টোবর, ১৯৫৪। তাঁর ৬৯তম প্রয়াণ বার্ষিকী আগামী ২২শে অক্টোবর। প্রকৃতির কবি, মানুষের কবি জীবনানন্দ দাশ। মৃত্যুকে এভাবেই শান্তির ঘুম বলে মহাকাব্যের দেহ-মন নিয়ে উড়ে গেছেন নক্ষত্রসম, শুদ্ধতম কবি জীবনানন্দ দাশ। শান্তির খোঁজে চলে গেছেন মহাকালের ছায়াপথ ধরে। রেখে গেছেন জীবনের অফুরান বোধ আর্শীবাদ-স্বরূপ। মাত্র ৫৫ বছর বয়েসে জীবনানন্দ দাশের চলে যাওয়া। সেই অনুষঙ্গেই কিছু বেদনার অঞ্জলি এই প্রতিবেদন।
জীবনানন্দ দাশ ১৮৯৯ সালে বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সত্যানন্দ দাশগুপ্ত (১৮৬৩-১৯৪২) ছিলেন বরিশাল ব্রজমোহন স্কুলের শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, বরিশাল ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক এবং ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক। মাতা কুসুমকুমারী দাশও একজন সুপরিচিত কবি ছিলেন।
১৯২১ সালে জীবনানন্দ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় বিভাগসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতা সিটি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন এবং আইনশাস্ত্র অধ্যয়ন ছেড়ে দেন। এরপর ১৯৩৫ সালে তিনি বরিশাল বিএম কলেজে ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপনায় যোগ দেন। ধীরে ধীরে কলকাতা, ঢাকা এবং অন্যান্য জায়গার বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায় তাঁর লেখা ছাপা হতে থাকে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, সে সময়কার বিখ্যাত পত্রিকা কল্লোল, কালি ও কলম, প্রগতি প্রভৃতি।
১৯২৭ সালে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’ প্রকাশিত হয়। সে সময় থেকেই তিনি তাঁর উপাধি ‘দাশগুপ্ত’-এর বদলে শুধুমাত্র ‘দাশ’ লিখতে শুরু করেন। মূলত বরিশাল শহরে ফিরে গিয়ে অধ্যাপনার পাশাপাশি কবি তাঁর কাব্য পরিচয়কে মেলে ধরেন। এখানে বসেই লেখেন তাঁর বিখ্যাত অনেক কবিতা।
এ পর্যন্ত জীবনানন্দের মোট ১৩টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয় ৭টি কাব্যগ্রন্থ। জীবদ্দশাতেই অসাধারণ কবি হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠলেও, তিনি খ্যাতি অর্জন করেন মৃত্যুর পর। বাংলাভাষায় আধুনিক কবিতার পথিকৃতদের অন্যতম রূপে তাঁর প্রতিষ্ঠা আসে মৃত্যুর পরে। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের বলয় ভেঙে এক নতুন উপখ্যান নিয়ে সাহিত্যাকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে উদিত হন জীবনানন্দ দাশ। প্রচারবিমুখ নিভৃতচারী এই মানুষটি বরাবরই প্রকৃতির ভিতর ডুব দিয়ে নিঃশব্দে তুলে এনেছেন অনন্য সব রত্ন। বাংলা সাহিত্যভাণ্ডারকে শুধু সমৃদ্ধই করেননি, সেই সঙ্গে দেখিয়েছেন আধুনিক কবিতার পথ।
তবে, তাঁর মৃত্যুদিনের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আর এসব আলোচনা করতে ভালো লাগছে না, যে, জীবনানন্দ দাশ রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগে কত বড় কবি ছিলেন ! তাঁর রূপসী বাংলা, বনলতা সেন বাংলা কবিতার জগতে যে নতুন দিগন্ত সৃষ্টি করেছিল, সেই উল্লেখও যেন নিরর্থক মনে হয়। এই সব তথ্যই বই, নেট খুললেই পাওয়া যাবে। এখন আর এত স্তুতি করে কি লাভ? এই প্রসঙ্গে প্রণব রায়ের লেখা, শৈলেশ দাশগুপ্তের সুরে সৃষ্ট পুরনো দিনের একটা বিখ্যাত বাংলা গানের কথা মনে পড়ছে– “জীবনে যারে তুমি দাওনি মালা / মরণে কেন তারে দিতে এলে ফুল?”
নির্মম সত্য হলো, শুধু একটু সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে মাত্র পঞ্চান্ন বছরে একজন কবিকে আমরা হারিয়ে ফেলতাম না! কলেজের অধ্যাপনার চাকরি করতেন। সেটাও একসময় চলে যায়। আপনভোলা ‘রূপসী বাংলা’র কবি তখন প্রচন্ড অর্থকষ্টে ভুগছিলেন। জীবনে নানা বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। পরিচিত জনের কাছে আকুল প্রার্থনা করছেন, তাঁর জন্য কিছু করতে। কবির বন্ধু বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, হুমায়ুন কবীর তখন নেহরু মন্ত্রীসভায় শিক্ষামন্ত্রী। বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি দফতরের মন্ত্রীও ছিলেন। জীবনানন্দ দাশ তাঁর আর্থিক অবস্থা দূর করার জন্য মোট তিনখানা চিঠি হুমায়ুন কবীরকে লিখেছিলেন। শেষ চিঠি লিখেছিলেন তাঁর মৃত্যুর ছ’মাস আগে। সেই চিঠির অংশবিশেষ একটু তুলে ধরছি। প্রিয় পাঠক অনুগ্রহ করে লক্ষ্য করুন, একজন মানুষ কতটা অসহায় অবস্থার মধ্যে থাকলে এইরকম চিঠি লিখতে পারেন! দিনটি ছিল ১৯৫৪ সালের ২৩শে এপ্রিল।
মিস্টার কবীর,
আশা করি ভালো আছেন। আপনি এখন একটি উঁচু জায়গাতে আছেন এবং খুব সহজেই আমার জন্য কিছু একটা করতে পারেন। আমি আপনাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করছি, আমাকে সাহায্য করতে এক্ষুনি আপনি যথাসাধ্য করুন। আমি খুবই অসুবিধার ভিতর আছি।
শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ সহ,
আপনার জীবনানন্দ দাশ
হায়! কেউ তাঁর কথা রাখেনি! এরপর ১৯৫৪-র ১৪ই অক্টোবর–দুঃখে জর্জরিত কবি আনমনে শরতের আকাশে মেঘের ভেলা দেখতে দেখতে ট্রাম লাইনের ওপর দিয়ে হাঁটছিলেন। ট্রাম আসছিল। হর্ন বাজছিল। কনডাক্টর চিৎকার করছিল। তবু কোন শব্দই তাঁর কানে এসে পৌঁছলো না। কলকাতার বালিগঞ্জে এক ট্রাম দুর্ঘটনায় তিনি আহত হলেন। ট্রামের ক্যাচারে আটকে তাঁর শরীর একেবারে দলা পাকিয়ে গিয়েছিল। ভেঙ্গে গিয়েছিল কণ্ঠা, ঊরু এবং পাঁজরের হাড়। জীবনানন্দের চিৎকার শুনে ছুটে এসে নিকটস্থ চায়ের দোকানের মালিক চূণীলাল এবং অন্যান্যরা তাঁকে উদ্ধার করে ভর্তি করেন শম্ভূনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে। এ সময় ডাঃ ভূমেন্দ্র গুহ-সহ অনেক তরুণ কবি জীবনানন্দের সুচিকিৎসার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন। কবি-সাহিত্যিক সজনীকান্ত দাস এ ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁর অনুরোধেই পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় কবিকে দেখতে এসেছিলেন এবং আহত কবির সুচিকিৎসার নির্দেশ দিয়েছিলেন। যদিও এতে চিকিৎসার তেমন উন্নতি কিছু হয়নি। জীবনানন্দের অবস্থা ক্রমশ জটিল হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন কবি। টানা আটদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে, চিকিৎসক ও সেবিকাদের সমস্ত প্রচেষ্টা বিফল করে ১৯৫৪-র ২২শে অক্টোবর, রাত্রি ১১টা ৩৫ মিনিটে চলে গেলেন তিনি!
‘…মৃত্যু এলে মরে যেতে হবে,
ভালোবাসা নদীর জলের মতন হয়ে রবে।
জলের থেকে ছিঁড়ে গিয়েও জল,
জোড়া লাগে আবার যেমন নিবিড় জলে এসে…!’
জীবনানন্দ দাশ বাঁচতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, শত চেষ্টা করেও পারলেন না!
ছবি ও তথ্যসূত্র : অন্তর্জাল