কেমন আছেন নেপথ্যের সেই মানুষগুলি ?
দক্ষিণ কলকাতার যে অঞ্চলটিতে আমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে, সেখানে তখন একটাই সিনেমা হল। মনে পড়ছে, ছুটিছাটায়, অবকাশে সেখানেই মা-কাকিমারা যেতেন বাংলা ছবি দেখতে। সেসময় সিনেমাই ছিল আমোদপ্রমোদের প্রধান কেন্দ্র এবং সেই কেন্দ্রের কেন্দ্রে আবার উত্তম-সুচিত্রা। ছবি দেখে বাড়ি ফেরার পর অনেকক্ষণ মায়ের মুখটা কেমন আলো-আলো হয়ে থাকতো। একটু বড় হয়ে সেই আলোর পরশে আমি অর্থাৎ উদ্বেলিত হতে শুরু করলো পরের প্রজন্ম। প্রজন্মগত ভাবে, সারা শহর, রাজ্য এবং দেশের মানুষ তাঁদের এলাকার বা একটু দূরের সিনেমা হলগুলিতে যেত। সিনেমা দেখা, ইন্টারভ্যালে চানাচুরের প্যাকেট, কোথাও ঝালমুড়ি–বড়রা ছুটে বাইরে গিয়ে চা পান করে আসতেন। অনুষঙ্গে এই সবই থাকতো। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ দূর, ফ্যানের হাওয়ার ঘটঘটানি, পর্দায় খুব চাঞ্চল্যকর মুহূর্তে রিল কেটে ছবি উধাও―ইত্যকার অসুবিধার পরোয়াই করতো না কেউ। সিনেমা হলের যাবতীয় ত্রুটি মাফ হয়ে যেত সিনেমার গুণে।
কিন্তু একটা দিন এলো, যখন অবস্থাটা আর একরকম থাকলো না। একটু একটু করে বদলে গেল সিনেমা দেখার অভ্যাস। প্রথমে প্রাইভেট টিভি চ্যানেলের রমরমা। তারপর মাল্টিপ্লেক্স কালচার―সিনেমা হল মালিকদের ব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়লো। লোকে আর হলে যায় না। গেলেও মাল্টিপ্লেক্সে যায়। উত্তর-দক্ষিণ-মধ্য কলকাতার একের পর এক ঐতিহ্যবাহী সিনেমা হল, অনেকগুলি আবার ঐতিহাসিক গুরুত্বে অসীম, বন্ধ হয়ে গেল কালের রক্তচক্ষু শাসনে। সবশেষে এই মারণ ভাইরাস। বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকার পর মাল্টিপ্লেক্স খুলেছে। লোকে যাচ্ছেও সেখানে। কিন্তু টিমটিম করে জ্বলা সিনেমা হলগুলির হাল কী ? সেখানে যিনি টর্চ জ্বালিয়ে সিট নম্বর দেখিয়ে দিতেন, যিনি সেই ছোট্ট কোনের ঘরে বসে রিল চালাতেন, টিকিট কাউন্টারে বসা মানুষগুলি, আর ওই চানাচুর বিক্রি করতেন যিনি―কী অবস্থায় আজ, আমাদের সেই প্রমোদের স্বর্গে পৌঁছে দেওয়ার নেপথ্যের মানুষগুলি ? জানি না। পেশা পাল্টে ক’জন টিকে আছেন, কে বলবে ? নতুন পেশাই বা কোথায় অত যে অতগুলি মানুষ খেয়েপরে বাঁচবেন ? ফেলে আসা সেই সিনেমা দেখার দিন শুধু স্মৃতিভারে আক্রান্ত করে না, এই মানুষগুলির কথাও মনে পড়ায়। সুখস্মৃতি নিমজ্জিত হয় হাহাকারের অন্ধকারে।