ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই রাজাদিত্যের তথ্যচিত্রে
সিনেমা ওঁদের প্যাশন। প্রতিভা, মেধা, দক্ষতা আর নতুন নতুন ভাবনার আলিঙ্গনে বিচিত্র পথগামী ওঁরা। কেউ পূর্ণদৈর্ঘের ছবি নির্মাণে ব্যস্ত, কেউ তথ্যচিত্র বা ছোট ছবি। কখনও স্বাধীনভাবে, কখনও সামান্য বিনিয়োগ―স্বপ্নের কারিগররা ব্যস্ত তাঁদের নিজের ভুবনে। এইসব সিনেমা পরিচালক ও তাঁদের কাজ নিয়েই এই বিভাগ। পরিচালক রাজাদিত্য বন্দোপাধ্যায়ের মুখোমুখি অজন্তা সিনহা। ধারাবাহিক আলাপচারিতার দ্বিতীয় পর্ব আজ। তথ্যচিত্রেও গল্প বলা যায়, এমন এক বার্তা নিয়েই প্রথম পর্ব শেষ করেছিলাম আমরা। এই পর্বে রাজাদিত্য নির্মিত তথ্যচিত্র বিষয়ে বিস্তারে যাব।
## তোমার নির্মিত তথ্যচিত্রগুলির ভাবনার মূল উৎস কী ?
প্রথম কথা আমি নিজেকে নিছক তথ্যচিত্র নির্মাতা বলতে চাই না। স্টোরি টেলর বলতে চাই। ঠিক যেভাবে মাইকেল মুরও বলতেন, আমার সিনেমা তো documentary নয়, আমার সিনেমায় একটা গল্প থাকে, যেটা মানুষ দেখতে আসে। এভাবেই ‘বিপন্ন বহুরূপী’-র গল্প বলেছি সেলুলয়েডে। বহুরূপী একটি বিলুপ্তপ্রায় শিল্প। আমি দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বায়ন বিরোধী activity-র সঙ্গে যুক্ত। ১৯৯০ সালে ভারতে যখন বিশ্বায়ন এলো, অনেককিছু নিয়ে গেল–একটা বিপর্যস্ত করে দেওয়া ঝড়ের মতো। সেটার শিকার হয়ে গেল traditional indigenous culture বা আর্ট ফর্মগুলো।
## নিঃসন্দেহে বিশ্বায়ন প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী বহু শিল্পকে বিলুপ্তির পথে ঠেলে দিয়েছে। তার মধ্যে আলাদা করে বহুরূপীদের নিয়ে কাজ করার কথাই ভাবলে কেন ?
বহুরূপীদের সংখ্যা দিন দিন কমছে। কমার কারণটা অনুমেয়। আজকের প্রজন্ম বহুরূপীর কথা জানে না। জানতেও চায় না। তাদের এত সস্তা বিনোদন, এত প্রযুক্তি আমরা দিয়েছি যে তারা শিকড়কে ভুলে গেছে। ট্রাডিশনাল আর্ট ফর্ম নিয়ে তাদের উৎসাহ নেই। আমি তাদের দোষ দিচ্ছি না। তারা জানবেই বা কোথায় ? এত কম কাজ হচ্ছে। আমি বীরভূমের ভূমিপুত্র। বীরভূমে জন্ম আমার। শান্তিনিকেতনে ছোটবেলাটা কেটেছে। লাভপুরে তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের বাড়ির পাশেই আমার মামার বাড়ি। সেখানে থাকতে শীতলগ্রাম, বিষয়পুর বাবার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে বহুরূপীদের কাজ দেখেছি। প্রসঙ্গত, আমার বাবা সাংবাদিক ও কথা সাহিত্যিক প্রয়াত দেবাশিস বন্দোপাধ্যায়ের বিশেষ আগ্রহ ছিল ঐতিহ্যবাহী এইসব বিলুপ্তপ্রায় শিল্প নিয়ে। তাঁর সান্নিধ্যে থেকেই বহুরূপীদের সঙ্গে আলাপ শৈশব-কৈশোরে।
বিদেশে অনেক বছর কাটিয়ে দেশে ফিরে যখন শান্তিনিকেতন বা লাভপুর যাই, দেখি বহুরূপীদের সংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছে। এই আর্ট নিয়ে আর কেউ কাজ করতে চায় না। সেখানে সুবল দাস বৈরাগ্য, উনি কিছুটা হলেও ধরে রেখেছেন। একজন জীবন্ত কিংবদন্তী, আশি বছরের ওপর বয়স। দীর্ঘজীবী হোন তিনি। তাছাড়া শীতলগ্রাম, বিষয়পুর, কাটোয়া, তারকেশ্বর এবং তারকেশ্বরের রবি পন্ডিত, বীরভূমের ব্যাধ পরিবারের রাজেন্দ্র ব্যাধ ও বাজিকর সম্প্রদায়ের বহুরূপী ভানু বাজিকর–এঁরা শিল্পটাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। কিন্তু আস্তে আস্তে এটা বিলুপ্তির পথে ঢলে পড়ছে।
এটা দেখেই আমার মনে হলো বাংলার শিল্প এত সমৃদ্ধ ও এত বৈচিত্রপূর্ণ–এটা আমাকে বিশ্বের দর্শকের কাছে তুলে ধরতে হবে। বলতে পারি এই প্রবীণ মানুষগুলো আমায় অনুপ্রাণিত করলেন। আমি সিনেমা বা থিয়েটার কখনওই শুধু কলকাতার বা বাংলার মানুষ দেখবেন বলে বানাইনি। আমার সৃষ্টি যদি বিশ্বের দর্শকের কাছে পৌঁছে দিই, তবেই মনে হয় আমার প্রচেষ্টা সার্থক। এখানে বহুরূপীদের নিজেদের শিল্পকে টিকিয়ে রাখার যে যন্ত্রনা, সেটা দেখে দর্শকও সেই যন্ত্রণার শরিক হবেন। তাঁদের এখন আর শিব বা কালীমূর্তিতে কেউ দেখতে চাইছে না, সিরিয়ালের চরিত্রে দেখতে চাইছে। এই যে সস্তা বিনোদনের একটা প্রভাব মানুষের মধ্যে, একটা contradiction, এই অবস্থাটা তুলে ধরার জন্যই আমি বানিয়েছি ‘Dying art of the Bohurupis of Bengal’.
## এই ছবিতে বিষয়টা ঠিক কীভাবে এসেছে, যদি আর একটু বিস্তারে বলো !
বহুরূপী অর্থাৎ বহুরূপে যার প্রকাশ, ইতিহাসের একটি সুপ্রাচীন শিল্পকলা। এই ছবি বহুরূপী শিল্প এবং সেই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শিল্পীদের জীবন ও সংগ্রামের উপর আধারিত। ছবিতে সেই সংগ্রাম ও বিলুপ্তপ্রায় এই শিল্পের কথা বলতে দেখা গেছে কিংবদন্তি শিল্পীদের। এখানেই বিষয়টি সীমাবদ্ধ নয়। সমাজ, ধর্ম, আঞ্চলিক সংস্কৃতি ও ভাষাগত প্রকাশের নানাবিধ ক্ষেত্রগত দিকের সঙ্গে সেটির সংযোজন একটি বিশিষ্ট রূপ প্রদানে সক্ষম হয়েছে। তাই বহুরূপীর ইতিহাস কেবল একটি শিল্পের কথা নয়, তা ওই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের জীবনের ওঠা-পড়ার গল্প।
একই সঙ্গে এই ইতিহাস এক বিশেষ ধরণের পারফরম্যান্সের এবং যে সমস্ত অঞ্চলগুলিতে তার বিকাশ, তাদের সংস্কৃতি, ভাষা ও সামাজিক আঙ্গিকগুলি আত্মস্থ করে নেওয়ারও আলোচনা পল্লবিত ছবিতে। এই ছবিতে মূর্ত হয়েছে গ্রাম বাংলার অপরূপ সৌন্দর্য। প্রধানত বীরভূম, তারকেশ্বর ও বর্ধমানে অবস্থিত বহুরূপীদের কাজ ও জীবন ধরা পড়েছে ‘Dying art of Bohurupis of Bengal’-এ। কাজটা করেছি বহুরূপীদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ আদানপ্রদানের মাধ্যমে। জানার চেষ্টা করেছি, এই শিল্প সম্পর্কে তাঁদের মতামত। ছবিতে তাঁদের সাজ, পারফরমান্স এবং জীবনযাপনের নানা দিক দর্শক মনকে ভাবতে বাধ্য করবে বাংলার লোকশিল্পের ইতিহাসের পাতায় এই শিল্পের অবস্থান কতখানি তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। তারই পাশাপাশি উপলব্ধ এটির বর্তমান দুরবস্থা কতখানি বেদনাদায়ক।
## তোমার পরের ছবি ‘Lost For Words ‘! এখানেও তো সেই হারিয়ে যেতে বসা সম্পদের খোঁজ! এর উৎস থেকে নির্মাণ সম্পর্কে জানাও।
ছোট্ট সুন্দর দেশ ফিনল্যান্ডে বসবাসের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু বিষয় উপলব্ধি করেছি। সেখানে মাত্র ৫৩ লক্ষ মানুষ বাস করে। ২ লক্ষ লেক আছে। ফিনিশ আর সুইডিশ (একদা সুইডেনের অধীনে ছিল) ভাষা বলে তারা। এখানেও বিশ্বায়নের প্রভাব চলে এসেছে। Indegenous languageগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, এমন ৭০০০টি ভাষার মধ্যে মাত্রা ৬০০টি ভাষা থাকবে। বিলুপ্তপ্রায় ভাষার মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশের ভাষা সবচেয়ে বেশি সংখ্যক। আমি আমার প্রথম ছবি ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ কুরমালি ভাষায় তৈরি করি। বিলুপ্তপ্রায় বলা না গেলেও, এই ভাষাও এখন আর বেশি লোক বলে না। এই জায়গাটা থেকেই আমি টোটোদের ভাষা নিয়ে তৈরি করেছি ‘Lost For Words’!
গবেষণা বলছে, ১৬০০ জন টোটোর মধ্যে ৩০০/৪০০ জন ছেড়ে চলে গেছে নিজেদের গোষ্ঠী। তারা এখন টোটো ভাষায় কথাও বলেন না। আজকে বাচিক সংখ্যা কমতে কমতে এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৩১৬ মতো। আগামী পাঁচ-দশ বছরে এই ভাষাটা হয়তো মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। এই পরিপ্রেক্ষিতে একটি ছোট্ট টোটো মেয়ে ও তিনজন ভাষাযোদ্ধা কী করে পরিশ্রম করে ভাষাটা বাঁচিয়ে রাখার জন্য লড়াই করছে, দেখানো হয়েছে ছবিতে। তাঁদের এই প্রয়াস এবং টোটোদের জীবন, ভাষা এবং সংস্কৃতির ওপর বিশ্বায়ন–ও আধুনিকতার প্রভাব এইসবের ওপর নির্ভর করে ছবিটা করেছি। ধোনিরাম টোটো ছবির প্রধান চরিত্র। তিনি একজন টোটো সাহিত্যিক। টোটো ভাষায় লিপি আবিষ্কার করেছেন ধোনিরাম। টোটো ভাষায় প্রথম একটি উপন্যাস লিখেছেন তিনি। সেটাও আমাদের ছবিতে দেখানো হয়েছে।
আমি ছোটবেলা যখন ডুয়ার্স গেছি, দেখেছি। পড়েছি ওঁদের সম্পর্কে। এছাড়া ২/৩ বছর আগে আমার প্রেসিডেন্সি কলেজের বন্ধু বিপ্লব নায়ক, তিনি নিজেও উদ্যোগ নিয়ে তাঁর মাতৃভাষা প্রকাশনা থেকে কয়েকটি বই প্রকাশ করেছেন। টোটো ভাষা বাঁচাবার জন্য নিজে বিশাল প্রয়াস নিয়েছেন। তাঁর কিছু বই আমি পড়লাম নতুন করে, তখনই আমার মাথায় বিষয়টা আসে। মনে হলো, this needs to be filmed, this is a subject of a film. এক্ষেত্রে ডকুমেন্টারির ট্রিটমেন্ট সম্পূর্ণ আলাদা। যাঁরা দেখতে যাবেন, তাঁরা একটা গল্প দেখতে পাবেন। কিন্তু গল্পটা সত্যি ও বাস্তব, fiction নয়। এখানেই ছবিটার মজা
ছবিটি ইউনিক এই কারণে, ভাষা আমাদের বৈচিত্রের এক প্রতিচ্ছবি। আমাদের জীবনের এক একটা প্রতিবিম্ব। আমাদের সেই বৈচিত্র্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বিশ্বায়নের দাপটে ছোট্ট গ্রামের কিছু মানুষ, যারা তিব্বত থেকে এসেছিল, তারা টোটো ভাষা রক্ষা করে চলেছে প্রাণপণে। ৯০ মিনিটের এই তথ্যচিত্রের সিনেমাটোগ্রাফি করেছেন তন্ময় কর্মকার। অতিরিক্ত সিনেমাটোগ্রাফির দায়িত্বে ছিলেন গিরিধারী গড়াই ও শুভজিৎ রায়। শব্দগ্রহণ ও সুরারোপে রয়েছে ব্যাকবেঞ্চার্স ও ছবিটি সম্পাদনা করেছেন সুমন্ত সরকার।
ইউরোপে স্লোভাকিয়ায় ‘Lost For Words’ শ্রেষ্ঠ তথ্যচিত্রের পুরস্কার পেয়েছে। বিশ্বের নানান প্রান্তে ছবিটি সাড়া ফেলেছে। অনুভব করছি, এই সাক্ষাৎকার দেবার সময়ও পৃথিবীর কোনও এক কোনায় আরেকটি ভাষার মৃত্যু হচ্ছে। প্রতি ১৪ দিনে এভাবেই মৃত্যু হচ্ছে অন্তত একটি ভাষার । টোটো ভাষাও হয়তো ঢলে পড়বে মৃত্যুর কোলে। তাই এই ছবিটি খুবই প্রাসঙ্গিক। আমি মনে করি, ভাষার মৃত্যুও কম বড় অতিমারী নয় !
## ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘Lost For Words’ বিপুলভাবে সাড়া পেয়েছে। এটা সত্যিই খুব আনন্দের। অন্যান্য উৎসবেও তো প্রশংসিত এই ছবি।
সত্যিই আনন্দের ! ২০ তম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে নির্বাচিত ‘Lost For Words’. এছাড়াও বাংলাদেশ শিল্পকলা অ্যাকাডেমির জাতীয় আর্ট গ্যালারিতে প্রদর্শিত হয়েছে এই ছবি। ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সাফল্যের পর ‘Lost For Words’ স্ক্রিনিংয়ের আমন্ত্রণ পেয়েছে স্লোভেনিয়া, ইতালি, ফ্রান্স, উত্তর সুইডেন, ফিনল্যাণ্ড ও এস্তোনিয়াতে। ইতিমধ্যেই কলকাতা, গুয়াহাটিতে ছবিটি দেখানো হয়েছে। শিলচর, দিল্লি, বেঙ্গালুরু ও মুম্বইতে এবারে দেখানো হবে। বছরের শেষের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড ও জার্মানিতে দেখানোর পরিকল্পনা আছে। প্রসঙ্গত, এরপর মুক্তি পেতে চলেছে আমার ‘Dying art of Bohurupis of Bengal’. এই ছবিটিও আমার হৃদয়ের খুব কাছাকাছি। (চলবে)