চার্চ, গুম্ফা আর দুর্গের সঙ্গে প্রাচীন সিল্ক রুট নিয়ে অপরূপ পেডং
দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম। লিখেছেন অজন্তা সিনহা।
অক্টোবরের মাঝামাঝি হলেও আকাশে বাদলমেঘের ঘনঘটা। সঙ্গে জোর বৃষ্টি। উত্তরবঙ্গে থাকা শুরুর পর থেকে অবশ্য আর অবাক হই না প্রকৃতির এহেন কাণ্ডকারখানায়। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই তেন্দ্রাবং থেকে ব্রেকফাস্ট সেরে রওনা দিলাম পেডংয়ের পথে। পূর্ণজির সঙ্গে আগে থেকেই কথা হয়ে আছে। আজকের বাহন শাওনজির গাড়ি। তেন্দ্রাবংয়ে ওঁর হোমস্টে-তেই ছিলাম। অসাধারণ নিসর্গ আর ওঁর অনবদ্য আতিথেয়তার গল্প আগেই পাঠকদের শুনিয়েছি। শুনিয়েছি আপার পেডংয়ের সম্পর্কেও। পেডং থেকেই আপার পেডং গিয়েছিলাম। এবার পেডং বাসের দুটি দিনের কাহিনি।
এটা ঠিক, পেডং নিয়ে বহুবার লিখেছি আমি। তার কারণগুলিও সবাই জানেন বলে, সেই প্রসঙ্গে আর গেলাম না। এবারের যাওয়াটা বেশ কয়েক বছর পর। সবচেয়ে বড় কথা, শেষ যে ক’বার গেছি, সেটা কোনও না কোনও দলের সঙ্গে। এই যাওয়াটা খুব খারাপ লাগে, সে কথা বলবো না। তবে, একা ঘুরে বেড়ানোই আমাকে সর্বাধিক তৃপ্তি দেয়। ফিরে আসি এবারের কথায়। অনেকদিন পর গেলাম বলে কিনা জানি না, পূর্ণজির লাল দোতলা বাড়িটা দেখেই বড্ড নস্টালজিক হয়ে পড়লাম। শাওনজি আর পূর্ণজি একে অপরকে নামে চিনতেন। এদিন মুখোমুখি হলেন ওঁরা। সামান্য কথোপকথন সেরে শাওনজির বিদায়। আমি আমার আশ্রয়ে। মালপত্র ওপরের ঘরে, মানে আমি যেখানে থাকব, তুলে দিলেন পূর্ণজি নিজেই।
বৃষ্টির বিরাম নেই। ফলে, তাপমাত্রাও নিম্নগামী। পূর্ণজি লাঞ্চ রেডি করতে গেলেন। আপাতত বিশ্রাম কিছুক্ষণ। জানালার পর্দা সরাতেই পাহাড়ের সারি। মেঘলা আকাশের ক্যানভাসে কেমন যেন বিষন্ন তারা এখন। বাড়িটা তিন রাস্তার মোড়ে। আবহাওয়ার কারণে রাস্তায় গাড়ি চলাচল কম। লোকজন নেই বললেই চলে। ফলে, চারপাশ জুড়ে অপার শান্তি। শুধু জল পড়ার টুপটাপ শব্দ। দোতলায় ওঠার বাঁধানো সিঁড়িটা বাইরে দিয়ে। নিচ থেকে খোলা সিঁড়ি ওপরে ওঠার পর একেবারে ছোট্ট এক বারান্দা। এই বারান্দা এবং সিঁড়ির ধাপে রাখা টবে প্রচুর গাছ। সেইসব গাছেরা বৃষ্টির ধারাপাতে এই মুহূর্তে স্বর্গীয় সবুজ। দাঁড়িয়ে তাদেরই দেখছিলাম, পূর্ণজি এলেন লাঞ্চ নিয়ে। ভাত, ডাল, সবজি, পাঁপড় আর অমলেট। মেনু আমিই বলে দিয়েছিলাম। খাওয়া শেষ হতে দুপুর গড়াল। ক্লান্ত ছিলাম। ঠান্ডাও লাগছিল। অতএব চলো কম্বলের উষ্ণ আশ্রয়ে।
কালিম্পং শহর খুব কাছে বলে নয়, অন্যান্য আরও কয়েকটি কারণে আশপাশ এলাকার তুলনায় অনেক বেশি উন্নত পেডংয়ের জনজীবন। একদিকে এর প্রাচীন ইতিহাস, যেখানে বৌদ্ধ, হিন্দু ও খ্রিস্টান ধর্মের এক অপরূপ সমন্বয় ঘটেছে। অন্যদিকে ভৌগলিক কারণে এখানে একদা চা শিল্পের যে বিস্তার ঘটে, তারও এক ইতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা যায় পেডংয়ের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য গড়ে ওঠায়। সন্ধ্যায় পূর্ণজির বানানো মুচমুচে পেঁয়াজি আর কফি সহযোগে আড্ডা চলছিল ওঁর সঙ্গে। অঞ্চলটিকে ঘিরে পূর্ণজির তথ্যভান্ডার ঈর্ষণীয়। তারই কিছু পৌঁছে দিলাম পাঠকের দরবারে। ১৮৮২ সালে ফাদার অগাস্তে দেগোদাঁ এলেন পেডং। এই ফরাসি পাদ্রীর স্বপ্ন ছিল পেডং হয়ে তিব্বত যাবেন তিনি। সেই সময় ভারতে চলছে ব্রিটিশ রাজত্ব। প্রতিবেশী দেশ তিব্বতে তখন প্রবল বৌদ্ধ শাসন। খ্রিস্টান বলে ফাদার অগাস্তে তিব্বতে প্রবেশের অনুমতি পেলেন না। জীবনের বাকি দিনগুলি তিব্বতে মিশন করেই কাটাবেন, ফাদারের সেই স্বপ্ন পূর্ণ হলো না। তবে, সেবার আদর্শে যাঁর জীবন উৎসর্গীকৃত, তিনি ঠিক খুঁজে নেন পথের দিশা। তিব্বত না হোক, পেডং তো আছে ! কাজের জন্য এই অঞ্চলকেই শেষে বেছে নিলেন ফাদার অগাস্তে। নিজের দেশ থেকে আনা ওষুধপত্র আর লেখাপড়ার ভান্ডারকে সঙ্গী করে নেমে পড়লেন কাজে। প্রতিষ্ঠিত হলো চার্চ ও তাকে কেন্দ্র করেই সামাজিক উন্নয়ন।
ডিনারে খেলাম ওয়াই ওয়াই। এটা পূর্ণজি এত সুন্দর ভাবে বানান এবং পরিবেশন করেন ! এখানে এলে প্রতিবারই অন্তত একবার আমি চেখে দেখি এই ওয়াই ওয়াই। অন্ধকার গাঢ় হয়। আকাশ এখন তুলনায় পরিষ্কার। জানালার পর্দা সরিয়ে দূর পাহাড়ের গ্রামে গ্রামে জ্বলা মিটিমিটি আলো দেখি। একসময় একে একে সেই আলোরাও ছুটি নেয়। ঘুম নামে চরাচর জুড়ে। পরদিন সকালে চললাম ক্রস হিল পয়েন্টে ফাদার অগাস্তের সেই চার্চ দেখতে। রাস্তার বাঁদিকের পাহাড়গুলি তত উঁচু নয়। খাঁজে খাঁজে ছোট ছোট বাড়ি, সামনে ফুলের বাগান। ডানদিকটায় শুধুই পাহাড়। নানা রঙের শেড তাদের, কোথাও ধূসর, কোথাও শ্যাওলা পড়ে সবুজের আভা। যেতে যেতে সামান্য হাফ ধরে। তবে, একটু দাঁড়ালেই চনমনে লাগে, বাতাস পুরোপুরি দূষণমুক্ত এখানে। মূল রাস্তা থেকে কিছুটা ওপরে সেই চার্চ অধিষ্ঠিত। বহুবার এসেছি এখানে। অদ্ভুত প্রশান্তি পুরো জায়গাটা ঘিরে। পূর্ণজির হোমস্টে থেকে চড়াইগামী পথ এখানে এসে বাঁক নিয়েছে। সেই বাঁকের বাঁদিকে খাড়া পাহাড়ের ওপরে চার্চ। ডানদিকে সারি সারি পর্বতমালা, যা সিকিমের অন্তর্ভূক্ত। চার্চের সামনে ক্রুশবিদ্ধ যীশুর মূর্তি। কী শান্ত, সমাহিত আর ক্ষমার পরশ তাঁর মুখে। মাথা আনত হয় স্বতস্ফূর্ত আবেগ ও শ্রদ্ধায়।
এখান থেকে পথ বাঁদিকে ঠিক নব্বই ডিগ্রি ঘুরে গেছে। ঘুরেছে এবং নেমেছে। সোজা গেছে কাশ্যম জঙ্গল ও গ্রামে। জঙ্গলের নামেই গ্রাম। এখানেই বসবাস করে লেপচা উপজাতির শেষ ঐতিহ্যবাহী পরিবারটি। ওঁদের বাড়িটিও ওই ঘরানার শেষ নিদর্শন। রাস্তা থেকে অনেকটা নিচে নেমে বাড়ি। মাটির বাড়ি, উপরে খড়ের চাল। হেরিটেজ তকমা প্রাপ্ত এই বাড়ির শরীর জুড়ে প্রাচীন ইতিহাস, যা দুর্মূল্য ও দৃষ্টিনন্দন। কাশ্যম জঙ্গলে প্রচুর ওষধি গাছ রয়েছে, যার খোঁজে পড়ুয়া ও গবেষকরা প্রায়ই আসেন। কালিম্পং জেলার অন্তর্গত পেডং ফুল ও অর্কিডের স্বর্গ। পথে চলতে চলতে সেসব ঘুরেফিরেই নজর কেড়ে নেয় পর্যটকের।
ফিরে এসে ব্রেকফাস্ট। পুরি আর সবজি খেয়ে চললাম আপার পেডং। এই যাতায়াতের পথেই চলুক আরও কিছু গল্প, অর্থাৎ, আরও কিছু তথ্য বিনিময়। আগেই বলেছি ঐতিহাসিক ভাবে পেডংয়ের গুরুত্ব অসীম। অতি প্রাচীন সিল্করুটের সব থেকে পুরোনো গেটওয়ে পেডং। এই সিল্ক রুট ভারতকে লাসার সঙ্গে যুক্ত করেছে পেডং নিকটস্থ জিলাপি লা পাসের মাধ্যমে। কালিম্পং থেকে ২০ কিমি দূরত্বে অবস্থিত পেডং। উচ্চতা ৪০৭১ ফুট। পুরো শহরটি দুভাগে বিভক্ত–আপার ও লোয়ার পেডং। আপার পেডং নিয়ে সম্প্রতি জানিয়েছি। আজ বরং লোয়ার পেডং নিয়েই আরও কিছু আকর্ষণীয় তথ্য জানাই। পাঠকের জ্ঞাতার্থে জানাই, আপনারা গেলে আপার ও লোয়ার পেডং দুটি মিলিয়েই পরিকল্পনা করবেন।
প্রসঙ্গত, পূর্ণজির হোমস্টে-র কাছেই অবস্থিত এখানকার অতি প্রাচীন বৌদ্ধ গুম্ফাটি। গাড়িতে যেতে মিনিট পনের লাগে। ইতিহাসপ্রসিদ্ধ এই গুম্ফার প্রতিষ্ঠাকাল ১৭০০ সাল। নাম সানচেন দোরজি মনাস্ট্রি। এখানে একটি কথা বলা দরকার–এই গুম্ফার পুরোনো ভবনটির মেরামত চলছে বেশ কিছুদিন ধরে। আমার সৌভাগ্য, এই কাজ শুরু হওয়ার আগেই আমি এটি ঘুরে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। রাস্তা থেকে অনেকটা ওপরে উঠে গেছে পাথরের সিঁড়ি। দু’টিতলের ওপরের অংশে অধিষ্ঠিত বুদ্ধের মূর্তি। সামনে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলছে। দেওয়ালে প্রচুর ফ্রেসকো পেন্টিং, সংগ্রহ দেখবার মতো, সংখ্যায় ৩০০-র কাছাকাছি। এবার নতুন ভবনের কথা। ঘুরে দেখার সুযোগ হয় এটিও। এখন যাবতীয় কার্যক্রম নতুন ভবনেই। দেখেছিলাম এদিক-ওদিক কাজে ব্যস্ত নানা বয়সের বৌদ্ধ সন্ন্যাসীগণ, সঙ্গে ছাত্র হিসেবে এখানকার আবাসিক কিশোর ও বালকবৃন্দ। এঁরাও ব্যস্ত প্রার্থনা ও পঠনপাঠনে। সঙ্গে জীবনযাপনের বাকি কাজ। বুদ্ধের মূর্তির সামনে প্রদীপ প্রজ্বলিত এখানেও। স্থান পেয়েছে ফ্রেসকো পেন্টিংগুলিও।
আপার পেডং থেকে ফিরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম। আবহাওয়া আজ বেশ ভালো। পূর্ণজি আর ওঁর স্ত্রী লাঞ্চ বানাতে ব্যস্ত। ঘরের কাজ থেকে হোমস্টে পরিচালনা–সবটা দুজনে মিলেই করেন ওঁরা। আবার পোস্ট অফিসের চাকরিও রয়েছে দুজনের। দুই ছেলের মধ্যে সাংপো বড়। তাকে খুব ছোট দেখেছি। এখন সে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। ছোট সাংচো সবে স্কুল যাওয়া শুরু করেছে। তার জন্মের আগে থেকে এই পরিবারটি আমার নিজের হয়ে গেছে। পেডং যতবার যাই, আত্মীয়তার এই স্বাদটি অনুভব করি। লাঞ্চে আজ মাছ রান্না করেছেন পূর্ণজি। সঙ্গে ডাল, সবজি, আলু ভাজা, আঁচার। পেডং বাজারে নিয়মিত মাছ পাওয়া যায় আজকাল। কয়েক বছর আগে পাহাড়ে মাছ খাওয়ার কথা ভাবতেই পারতেন না পর্যটকরা। এখন তো ওঁরা মাছচাষও করছেন, যা দেখে এলাম তেন্দ্রাবংয়ে। আদতে বাঙালি পর্যটকদের মৎসপ্রীতি যে অনেকটাই এর প্রেরণা, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আজ আর দিবানিদ্রা নয়। বরং যাব দুর্গ প্রসঙ্গে। চার্চ, গুম্ফার পর দুর্গ। ঐতিহাসিক ড্যামসাং ফোর্ট। একদা ড্যামসাং উপত্যকা ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলকে ঘিরেই গড়ে ওঠে দেশের প্রথম চা শিল্প। পেডং তথা কালিম্পং-এর মাটি ও আবহাওয়া ছিল চা উৎপাদনের সম্পূর্ণ উপযোগী। এদেশে ব্রিটিশ শাসনের অনেক আগেই চৈনিক চা ব্যবসায়ীরা চিন দেশ থেকে সিল্করুটের মাধ্যমে চা পাতা আমদানি করত এখানকার ধনী ও সৌখিন চা-প্রেমীদের জন্য। এই আমদানীর ব্যাপারটা অত্যন্ত খরচ ও সময়সাপেক্ষ হওয়ায়, একসময় এরা চা উৎপাদনের কথা ভাবে। সেখান থেকেই চা বাগান, উৎপাদন ও শিল্প-বাণিজ্যের দরজা খুলে যায়। একদার সমৃদ্ধ ও বর্ণময় সেই দিন, কালের অঙ্গুলিহেলনে অবলুপ্ত। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে সাহেবদের বাংলোটি, যা ড্যামসাং ফোর্ট থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত। বাংলোটি অক্ষত। তবে, ড্যামসাং ফোর্টের শরীর জুড়ে আজ শুধুই ধ্বংসের চিন্হ। সব গিয়ে দাঁড়িয়ে কয়েকটি ভাঙ্গা দেওয়াল। আর আছে জঙ্গল। এখান থেকে সম্পূর্ণ উপত্যকা দৃশ্যমান–এই ভিউ এককথায় অবর্ণনীয়।
এই দুর্গের ইতিহাস অবশ্য আরও প্রাচীন। ১৬৯০ সালে তৈরি এই দুর্গে বাস করতেন লেপচা রাজা গ্যাবো আচুক। দুর্গ তখন ভুটানের রাজার অধীন। রাজার হয়েই আচুকের কাজ করার কথা। কিন্তু তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করে দুর্গের দখল নিলেন। ঘোর যুদ্ধ হলো ভুটানের রাজার সঙ্গে গ্যাবো আচুকের, এবং শেষে রাজার কাছে আচুকের পরাজয়। আচুক নাকি ব্ল্যাক ম্যাজিক জানতেন। এলাকার লোকজনের কথায়, আজও ড্যামসাং দুর্গকে ঘিরে আচুকের প্রেতাত্মা ঘুরে বেড়ায়। ১৮৬৪-তে ভুটানের রাজার সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধ ও দুর্গের দখল চলে যায় ব্রিটিশদের হাতে। আক্ষেপের কথা, এত সব বর্ণময় ইতিহাস নিয়েও অবহেলিত ড্যামসাং ফোর্ট। যাঁরা ট্রেকিংয়ে সক্ষম, তাঁরা পেডং গেলে অবশ্যই ড্যামসাং ফোর্ট দেখবেন। শুনেছি মার্চ-এপ্রিল মাসে দুর্গের চারপাশ ফুলের শোভায় চমৎকার হয়ে ওঠে।
শিক্ষার বিস্তারের কথা শুরুতেই বলেছি। সাধারণ ও আবাসিক মিলিয়ে পেডংয়ে রয়েছে বেশ কয়েকটি স্কুল। আশপাশের গ্রাম তো বটেই, উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলি এবং বিভিন্ন প্রতিবেশী দেশ থেকেও এই স্কুলগুলিতে পড়তে আসে ছেলেমেয়েরা। ২০১৫ সালে পেডংয়ে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্থাপিত হয়েছে গভর্নমেন্ট জেনারেল ডিগ্রি কলেজ, যা নিঃসন্দেহে এলাকার শিক্ষার্থীদের কাছে নতুন আশার বার্তা নিয়ে এসেছে। পেডংয়ে বাস করেন সিকিমিজ ভুটিয়া, দুকপা, তামাং, রাই, শেরপা, কামি, লেপচা, লিম্বু, ছেত্রী, সন্ন্যাসী ইত্যাদি জাতির মানুষ। সুন্দর সহাবস্থান এই গ্রামকে সামাজিক ভাবে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। পূজা, দশেরা, দিওয়ালি, বড়দিন, বুদ্ধ পূর্ণিমা, লোসার উৎসবে মেতে ওঠেন হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিষ্টান ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষ। আপার পেডংয়ে দেখেছিলাম তামাং মনাস্ট্রি। শান্ত, সমাহিত পরিবেশ। চারপাশের ভিউ অনির্বচনীয়। শুনলাম বুদ্ধ পূর্ণিমার রাতে দারুণভাবে সেজে ওঠে এই জায়গাটি। একটি ঝর্নাও রয়েছে কাছেই। সব মিলিয়ে ইতিহাস, প্রকৃতি ও ধর্ম পালন–মিলেমিশে একাকার। এছাড়া এখান থেকে মেলে কাঞ্চনজঙ্ঘার দুর্দান্ত ভিউ। আমি এবারে তার দর্শন পাইনি আবহাওয়ার কারণে। তবে, একবার লোয়ার পেডংয়ের ক্রস হিল পয়েন্ট থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা পেয়েছিলাম, যা আজও না ভোলা স্মৃতি হয়ে রয়েছে।
পেডংয়ের কাছাকাছি আপনি সাইট সিয়িংয়ের জন্য যেতে পারেন তিনচুলে ভিউ পয়েন্ট, রমিতে ভিউ পয়েন্ট, রামধুরার প্রাচীন শিব মন্দির, মনসংয়ের জলসা বাংলো, সিলেরি গাঁও যাওয়ার পথে সাইলেন্ট ভ্যালি, লাভা, লোলেগাঁও, ঋশপ, কালিম্পং শহরের যাবতীয় দ্রষ্টব্য। মনে আছে আমি এখান থেকেই গিয়েছিলাম সিকিমের আরিটার লেক দেখতে। যাওয়ার পথে পড়ে ঋষি খোলা অর্থাৎ ঋষি নদীর ওপরের দীর্ঘ ও চওরা ব্রিজ। এই নদীই উত্তরবঙ্গ ও সিকিমের সীমান্তরেখা বলা যায়। ঋষি খোলা কাছ থেকে দেখার জন্যও ট্রেক করে অনেকটা নিচে নামতে হয়। ব্রিজের পাশ দিয়েই নেমে গেছে সেই পথ। আরিটার লেক ভারি মনোরম। বাঁধানো লেক ঘিরে গাছপালা। লেকে বোটিংয়ের ব্যবস্থা আছে। এদিকে ঋষি তো অন্যদিকে রংপো। রংপো নদীও সিকিম বর্ডার। রামধুরা, মনসং, ইচ্ছে গাঁও এবং আরও বেশ কয়েকটি গ্রামের পাশ দিয়ে রাস্তা গেছে, পৌঁছেছে রংপো। অপরূপ ভিউ দুপাশে–রয়েছে নানাজাতের প্রাচীন ও নবীন গাছ, নদী, উপত্যকা, ঘরবাড়ি আর পাহাড়ের সারি।
কালিম্পং থেকে আলগড়া হয়ে যেতে হয় পেডং। কালিম্পং পর্যন্ত মাঝে মাঝেই উঁকি দেবে তিস্তা। তার আকর্ষণও চিরন্তন। কালিম্পং থেকে পেডংয়ের দূরত্ব সামান্যই, ৪৫ মিনিট মতো সময় লাগে। সে পথও গেছে দু’পাশে পাহাড় রেখে, জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। বর্ষা এড়িয়ে যে কোনও সময় যেতে পারেন। শীতে বেশ ঠান্ডা পড়ে। উপযুক্ত শীত-পোশাক সঙ্গে রাখা জরুরি। যখনই যান–টর্চ, জরুরি ওষুধ, ফার্স্টএড বক্স, টি ব্যাগ ও কফির প্যাকেট, বিস্কুট ও কিছু শুকনো খাবার সঙ্গে রাখবেন। এমনিতে হোমস্টে-তেই পাবেন লাঞ্চ, ডিনার, ব্রেকফাস্ট ও সন্ধ্যায় স্ন্যাকস এবং সকাল-সন্ধ্যা দিনে দু’বার চা। ভাত,ডাল, সব ধরনের সবজি, ভাজা, ডিম, চিকেন মেলে। আঁচার ও পাঁপড় থাকে সঙ্গে। আজকাল মাছের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছেন ওঁরা, আগেই বলেছি। পূর্ণজির হাতের আলুর চোখা, বেগুন ভর্তা, শীতের পাঁচমেশালি সবজি যে একবার খাবেন, ভুলবেন না গ্যারান্টি। আর অনুরোধে মোমো বা দিনে বাড়তি দু-একবার চা পেলেও পেতে পারেন। থাকা খাওয়ার খরচ দিন প্রতি জন প্রতি ১২০০ টাকা।
বুকিং ও অন্যান্য তথ্যের জন্য
যোগাযোগ # পূর্ণ তামাং +919933615828