চির উদীয়মান যে রবি
জীবনমরণের সীমানা ছাড়িয়ে ওঁরা আজ বহু আলোকবর্ষ দূরের এক জগতে। তবু আছেন ওঁরা আমাদের মাঝে। থাকবেন চিরদিন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সিনেমা জগতের সেইসব মানুষ, যাঁদের অবদান ছাড়া অসম্পূর্ণ আমরা, তাঁদের নিয়েই এই বিশেষ কলম প্রকাশিত হচ্ছে মাসে একবার। আজ শ্রদ্ধা ও স্মরণে বাংলা ছবির কিংবদন্তি অভিনেতা রবি ঘোষ। লিখেছেন শ্যামলী বন্দোপাধ্যায়।
তিনি আমাদের শৈশবের ‘বাঘাদা’, শ্রীমান পৃথ্বীরাজের ‘হরিদাস’, গল্প হলেও সত্যি-র ‘ধনঞ্জয়’, অরণ্যের দিনরাত্রি-র ‘শেখর’ আবার কালপুরুষ মহাপুরুষের ‘বিরিঞ্চি বাবা’। বাংলা সিনেমার কিংবদন্তি অভিনেতা রবি ঘোষ, যাঁকে বিশ্বের তাবড় অভিনেতাদের সঙ্গে এক সারিতে বসিয়েছেন একাধিক চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ। আর আপামর মানুষের হৃদয়ে কোথায় তাঁর বাস, সে তো শুরুতেই বলেছি। আদতে স্বল্প পরিসরে রবি ঘোষের কাজ সম্পর্কে আলোচনা করা খুবই কঠিন ! বাংলার সমস্ত বড় পরিচালকের ছবিতে কাজ করেছেন তিনি। অমন বুদ্ধিদীপ্ত, সংযত হাস্যরসাত্মক অভিনয় আর মেলেনি বাঙালির ভাগ্যে।
২০২৩-এর ৪ ফেব্রুয়ারি, অর্থাৎ আগামিকাল রবি ঘোষের মৃত্যুর ২৬ বছর পূর্তি। একজন অভিনেতা ২৬ বছর নেই। বাংলা বিনোদন দুনিয়ায় তাঁর শূন্যস্থান এখনও ফাঁকাই রয়ে গেছে। আদতে তাঁর মতো একজন অভিনেতা কোটিতেও হয় বলে মনে হয় না। কেউ কেউ তাঁকে একজন নিছক কৌতুক অভিনেতা অথবা সহ অভিনেতা হিসেবে দেখলেও, তাঁর অভিনয়গুণে পর্দায় প্রতিটা চরিত্র হয়ে উঠতো মূল চরিত্রের মতোই উজ্জ্বল ও বর্ণময় ! কোথাও কোথাও হয়তো মূল চরিত্রের অভিনেতাকে ছাপিয়ে দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি।
রবি ঘোষ এমনই এক জ্যোতিষ্ক, যিনি ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। সূর্যের মতোই যেন সার্থকনামা তিনি। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, রবি ঘোষ ছাড়া বহু ছবির কথা এবং সেই চরিত্রে কারওর অভিনয়ের কথা চিন্তাই করা যায় না। সব বাদ দিয়ে দৃষ্টান্তস্বরূপ এক ‘গল্প হলেও সত্যিই’ তো যথেষ্ট ! আর ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ ছবিতেও বাঘার চরিত্রে অন্য কাউকে কি কল্পনা করা যায়? তিনি ছিলেন একাধারে অভিনয়ের মাস্টার, কমেডি কিং এবং থিয়েটার আইকন। সবচেয়ে বড় কথা হলো, তিনি ছাড়া আমাদের মতো অনেকের শৈশবই বিনোদন থেকে বঞ্চিত থেকে যেত।
রবীন্দ্রনাথ ঘোষ বা আমাদের পরিচিত রবি ঘোষ ১৯৩১ সালের ২৪ নভেম্বর কোচবিহারে তাঁর মামাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। সেখানেই প্রাথমিক পড়াশোনা। এরপর বাবার কর্মসূত্রে চলে আসেন কলকাতায়। ১৯৪৭ সালে সাউথ সুবারবান মেন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। আশুতোষ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ওই কলেজেরই নৈশ বিভাগ শ্যামাপ্রসাদ কলেজে বি কমে ভর্তি হন। তখন থেকেই নাটকের প্রতি ঝোঁক বেড়ে যায়। নিজেদের নাটকের দল তৈরি করে নাম দেন ‘বন্ধুমন’। কলেজের ছাদেই চলত তাঁদের রিহার্সাল। অভিনয় ছাড়াও বডি বিল্ডার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন ছোটবেলা থেকেই। কলেজেরই ব্যায়ামাগারে শরীরচর্চাও করতেন নিয়মিত।
কিন্তু বাড়ির লোকের ওই দুটো বিষয়েই ছিল আপত্তি। প্রথমত, তাঁদের মতে, ওই চেহারায় অভিনয় হয় না। দ্বিতীয়ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে বডি বিল্ডার হওয়ার জন্য যেমন খাবারদাবারের দরকার, তার জোগান দেওয়া অসম্ভব ব্যাপার বলে মনে করতেন তাঁরা। অভিভাবকরা চাইতেন ছেলে একটা চাকরির চেষ্টা করুক, যাতে সংসারের একটু সুরাহা হয়। সংসারের কথা ভেবে ১৯৫৩ সালে চাকরিতে যোগ দেনও তিনি। যদিও কয়েক বছর বাদেই সেই চাকরিতে ইতি টেনে পুরোপুরি অভিনয় জগতে চলে আসেন।
অভিনয় জীবনের পথচলা শুরু উৎপল দত্তের পরিচালনায় ‘সাংবাদিক’ নাটক দিয়ে। সেখানে সংবাদপত্র বিক্রেতার চরিত্রে অভিনয় করেন। অভিনয় বলতে মঞ্চের একপ্রান্ত দিয়ে ঢুকে অন্যপ্রান্ত দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া। ওই সামান্য উপস্থিতিই বুঝিয়ে দিয়েছিল, তিনি কত দক্ষ অভিনেতা। সেই নাটক দেখতে আসা প্রখ্যাত পরিচালক মৃণাল সেন মুগ্ধ হন রবি ঘোষের অভিনয় দেখে। পরবর্তীকালে রবি ঘোষ মৃণাল সেনের ‘কোরাস’ ছবিতে অভিনয়ও করেন।
পর্দায় প্রথম রবি ঘোষকে দেখা যায় অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘আহ্বান’ ছবিতে। যদিও তার আগে এই পরিচালকের ‘কিছুক্ষণ’ ছবিতেও অভিনয় করেন তিনি। তবে সেই ছবি এখন আর পাওয়া যায় না। এরপর ১৯৬৬ সালে তপন সিনহা পরিচালিত ‘গল্প হলেও সত্যি’-তে ধনঞ্জয়ের চরিত্রে অভিনয় করে সবার নজর কাড়েন রবি ঘোষ। এরপর তাঁর শুধুই এগিয়ে চলার পালা। ১৯৬৯ সালে মুক্তি পাওয়া সত্যজিৎ রায়ের ‘গুপী গায়েন বাঘা বায়েন’ ছবিতে বাঘার চরিত্র তো মাইলস্টোন বলা যায়। এরপর সত্যজিৎ রায়ের ‘অভিযান’, ‘ কালপুরুষ মহাপুরুষ’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘হীরক রাজার দেশে’, ‘আগন্তুক’ ছাড়াও সন্দীপ রায় পরিচালিত ‘গুপী বাঘা ফিরে এল’ ছবিতে অভিনয় করেন। এছাড়াও গৌতম ঘোষ পরিচালিত ‘পদ্মানদীর মাঝি’, ‘অন্তর্জলী যাত্রা’, তপন সিংহের ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’, তরুণ মজুমদারের ‘বালিকা বধূ’, ‘ঠগিনী’, ‘শহর থেকে দূরে’, দীনেন গুপ্তের ‘বসন্ত বিলাপ’, অরুন্ধতী দেবী পরিচালিত ‘পদি পিসির বর্মী বাক্স’, শচীন মুখোপাধ্যায়ের ‘কাল তুমি আলেয়া’, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘ধন্যি মেয়ে’, বিষ্ণু পাল চৌধুরির ‘স্বপ্ন নিয়ে’ সহ ২০০-র বেশি বিভিন্ন ধারার ছবিতে অভিনয় করেন তিনি।
‘গুপী গায়েন বাঘা বায়েন’ ছবির জন্য বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালেও অংশ নেন। বাংলা ছবির পাশাপাশি হিন্দি ছবি ‘সত্যকাম’, ‘আজ কী রবিনহুড’, ‘পতঙ্গ’-তেও অভিনয় করেন তিনি। ‘নিধিরাম সর্দার’ ও ‘সাধু যুধিষ্ঠিরের কড়চা’ নামে দু’টি ছবি পরিচালনাও করেছিলেন। সেই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন মহানায়ক উত্তমকুমার, অপর্ণা সেনের মতো অভিনেতারা। শুধু কী ছবি! মঞ্চে প্রায় ৪০টা নাটকে অভিনয় করে দর্শকের বিপুল প্রশংসা পান। তার মধ্যে ‘শ্রীমতী ভয়ংকরী’ এবং ‘কনে বিভ্রাট’ প্রায় ইতিহাস তৈরি করেছিল। ‘চলাচল’ নামে থিয়েটার গ্রুপ তৈরি করেছিলেন তিনি।
তথাকথিত ভাবে সুন্দর মুখ এবং শারীরিক গঠন নায়কোচিত না হওয়ার কারণে হয়তো নায়ক হতে পারেননি। কিন্তু অসাধারণ অভিনয়ের গুণে কিংবদন্তী হয়ে আছেন। যে ভূমিকায় যখন অবতীর্ণ হয়েছেন, তাঁকেই সেরা করে তুলেছেন। হাসির অভিনয়ে যেমন সবার মন জয় করেছেন, তেমনই একাধিক ছবিতে খলনায়কের চরিত্রেও দেখা গেছে তাঁকে। ‘বাঘিনী’-তে রবি ঘোষ অভিনীত ভোলা চরিত্রটি ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর এক মানুষ। তাকে অভিনয়ে এতটাই জীবন্ত করে তোলেন তিনি, যে দেখে বিশ্বাস করা শক্ত হয়ে ওঠে, ইনিই আমাদের চেনা বাঘাদা। বোঝা যায় কত বড় মাপের অভিনেতা ছিলেন তিনি।
যেমন ছিল তাঁর নিয়মানুবর্তিতা, কাজের প্রতি শ্রদ্ধা, তেমনই ছিলেন শিক্ষা ও বিদ্যাবুদ্ধিতে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। সব সময় নিজের সঙ্গে রামকৃষ্ণ কথামৃত রাখতেন, সময় পেলেই পড়তেন। এমনকী তাঁর ড্রাইভারকেও শোনাতেন। কমিউনিজমে বিশ্বাসী হয়েও কথামৃত পড়তে কোনও অসুবিধা হয়নি তাঁর।‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ ছবি করার সময় নামী অভিনেত্রী অনুভা গুপ্তর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে রবি ঘোষের। নানা টানাপড়েনের পর তাঁদের বিয়ে হয়। কিন্তু খুব বেশিদিন তারা বিবাহিত জীবন যাপন করতে পারেননি। ১৯৭২ সালে অকালে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান অনুভা দেবী। স্ত্রীর বিয়োগে এতটাই ভেঙে পড়েছিলেন যে, বেশ কিছুদিন অভিনয় থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখেন। পরে যদিও ফের অভিনয় শুরু করেন এবং বৈশাখী দেবীকে বিয়ে করেন।
অভিনয় ছাড়াও তাঁর আরেকটা পরিচয় আছে। তিনি ভাল লেখকও ছিলেন। দশটা কৌতুক নকশা লিখেছিলেন তিনি। ১৯৯৭ সালে তাঁর ‘হাসতে মানা’ নামে বইটি প্রকাশিত হয় কলকাতা বইমেলায়। সে বছরই বইমেলায় আগুন লেগে যায়। তিন দিন পরে আবার বইমেলা শুরু হয়। কিন্তু মেলা চলাকালীনই ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলা সিনেমার রবি অস্তাচলে যান। তবে, বাঙালির হৃদয়াকাশে তিনি উদিত সূর্যের মতোই উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন চিরকাল।