জাঁকজমকপূর্ণ ‘রুদ্রবীণার অভিশাপ’
এ সিরিজ দেখতে দেখতে আপনার মনে পড়েই যেতে পারে, প্রিয়দর্শনের ‘হালচাল’, সঞ্জয় লীলা বনশালীর ‘দেবদাস’ ইত্যাদি বা দক্ষিণের অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ ছবির কথা। যার প্রভাব বেশ কিছু বাংলা ছবিতেও দেখেছি আমরা। বেশ একটা ফিল গুড ব্যাপার। সবটাই দৃশ্যত খুব নান্দনিক। চোখের আরামের পূর্ণ আয়োজন রয়েছে। পরিচালক জয়দেব মুখার্জি যে বাঙালি আবেগের স্পন্দনটা বোঝেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। দুর্দান্ত সেট ও লোকেশন, বেশ নিটোল এক গল্প বলার ভঙ্গি–একদল দক্ষ অভিনেতা নিয়ে হইচই চ্যানেলে শুরু হয়েছে ‘রুদ্রবীণার অভিশাপ’।

আলাদাভাবে বলতে হয় জয় সরকারের সংগীত পরিচালনার কথা। ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর বা নাটকের প্রয়োজনে গান নয়। ‘রুদ্রবীণার অভিশাপ’ পল্লবিত সংগীতকে ঘিরেই। জয় এই সময়ের একজন প্রথম সারির মিউজিক কম্পোজার। তাঁর সৃজনে শাস্ত্রীয় সংগীত থেকে লোকসুর–চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে সুন্দর ব্যবহৃত। বস্তুত, এটি একটি মিউজিক্যাল থ্রিলার, যার পরতে পরতে রয়েছে অপার রহস্য, প্রাচীনতা, লোককথা, অন্ধ ও উগ্র জাত্যাভিমান এবং আরও অনেক মশলা। স্বভাবতই সংগীত এই সমস্ত টানাপোড়েনের সঙ্গে মিলেমিশে আছে।
আলাপ ও শ্রুতি–মুখ্য চরিত্রদ্বয়ের নামেই অনুমেয়, এ সিরিজে সংগীতের গুরুত্ব। বহুকাল আগে থেকে লেগে থাকা অভিশাপ-রহস্যের খোলস ছাড়াতে চায় আলাপ ও শ্রুতি। এই অভিশাপ কাহিনিকে জড়িয়ে আছে দুই সংগীতজ্ঞ পন্ডিতের বংশ অধ্যুষিত অঞ্চল–রুদ্রপুর ও আনন্দগড়। আর আছে নাদ। কে এই নাদ ? কী তার জীবনরহস্য ? এক দেবদাসী সন্তানবতী নারী, তার জীবন ও রুদ্রবীণা ছুঁয়ে ফেলার অভিশাপে তার মৃত্যুদণ্ড, উপজাতীয় সমাজের মানুষজনের যাপন ও পালন–সবটাই রহস্যকে আরও ঘন করে তোলে।

নাদ একদিকে এক ব্রাত্য সমাজের প্রতিনিধি। অন্যদিকে তার কণ্ঠে বাস করে সংগীতের ঈশ্বর। রুদ্রপুরের রুদ্রভৈরবের কাছে সংগীতশিক্ষার লক্ষ্যে একের পর এক পরীক্ষা দিয়ে চলেছে সে। অদ্ভুতভাবে এ পরীক্ষা শুধু সুর-তালের নয়। সঙ্গে রয়েছে হত্যা-নিষ্ঠুরতা ও রক্তস্রোত বইয়ে দেবার তীব্র পৈশাচিক এক রীতির প্রক্রিয়া। এই রুদ্রভৈরব নিজেও যেন এক নিষ্ঠুরতার প্রতিমূর্তি। শুধু তাই নয়। তার আপাত নিয়মনিষ্ঠ আভিজাত্যের অহংকারের আড়ালে লুকিয়ে এক গভীর ষড়যন্ত্রকারী।
মোদ্দা কথা, ‘তানসেনের তানপুরা’, অর্থাৎ সিরিজের আগের ফ্র্যাঞ্চাইজির মতোই শিহরণ জাগিয়ে শুরু হয়েছে ‘রুদ্রবীণার অভিশাপ’। আলাপ, শ্রুতি ও নাদের চরিত্রে যথাক্রমে সেই পুরোনো তিন মুখ বিক্রম চট্টোপাধ্যায়, রূপসা চট্টোপাধ্যায় ও সৌরভ দাস। তিনজনেই তাঁদের ফিরে আসাকে উপলক্ষ করে বেজায় খুশি। সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সেই খুশি লুকোননি ওঁরা। সৌরভ মনে করছেন, তাঁর কাছে দর্শকের প্রত্যাশা বেড়েছে। ফলে, চ্যালেঞ্জও বেশি। নাদের চরিত্রটি খুবই জটিল। শুধু নেগেটিভ বললে কম বলা হবে। প্রচুর শেড রয়েছে নাদ চরিত্রে।
ওঁরা ছাড়াও আছেন দিতিপ্রিয়া রায়। এটা তাঁর প্রথম ওয়েব সিরিজ। অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ‘সাজ’-এর চরিত্রে কাজ করছেন তিনি। স্পষ্টতই উদ্দীপনায় একেবারে চনমনে তিনি। একে তো প্রথম ওয়েব সিরিজ, ‘রুদ্রবীণার অভিশাপ’-এর মতো একটি কাহিনি ও সাজের মতো একটি ব্যতিক্রমী চরিত্র ! এক্সাইটেড হওয়ারই কথা ! ‘রুদ্রবীণার অভিশাপ’-এ আরও যাঁরা আছেন, শ্রীলেখা মিত্র, উষসী রায়, সুদীপ মুখোপাধ্যায়, পুষ্পিতা মুখোপাধ্যায়, ভাস্কর ব্যানার্জি, অনুরাধা মুখার্জি, দেবশঙ্কর হালদার, রূপাঞ্জনা মিত্র, রজত গাঙ্গুলি প্রমুখ।
রুদ্রপুর ও আনন্দগড়–দুটি সংগীতমুখর অঞ্চলকে ঘিরে একদা ঘনিয়ে ওঠা জমাট রুদ্রবীণার অভিশাপ-রহস্য ভেদ করতেই আলাপ আর শ্রুতির ফিরে আসা। কাহিনি শুরু হয় এইভাবে–আলাপ ও শ্রুতির এনগেজমেন্ট উৎসব চলছে। এই দৃশ্যটি চূড়ান্ত রঙিন ও জাঁকজমকপূর্ণ করে নির্মাণ করেছেন পরিচালক। এদিকে সেইদিনই নাদ আনন্দগড়ে যায় লুকানো তথ্যের খোঁজে, যার গর্ভে রয়েছে তাদের সমাজের ওপর যুগ যুগ ধরে লেগে থাকা রুদ্রবীণার অভিশাপের সূত্র। উৎসব উদযাপনের মাঝেই আসে চমকে দেওয়া একটি খবর। মিউজিক রুমে আলাপ আর শ্রুতি খুঁজে পায় একটি বাক্স। সেটা দেখার পর থেকেই বদলে যায় সব। আভাসে কিছু অনুভব করে ওরা। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ওঠে রহস্যে যবনিকাপাতের লক্ষ্যে। সেই লক্ষ্য পূরণের সাথী দর্শক কতটা হতে পারেন, দেখা যাক।
একজন ন্যারেটর অর্থাৎ গ্রন্থনাকারীর মাধ্যমে আমরা ‘রুদ্রবীণার অভিশাপ’ কাহিনি শুনি। সুন্দর এক গল্প বলার ভঙ্গি তাঁর। বোঝা যায়, বিষয়ের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই পরিচালক পরিবেশনের এই প্যাটার্ন অনুসরণ করেছেন, যা সচরাচর পৌরাণিক কাহিনি-নির্ভর সিনেমা বা টিভি সিরিয়ালে দেখি আমরা। এছাড়া দৃশ্যায়নে ব্যবহৃত হয় বেশ কিছু প্রাচীন প্রাসাদ-সম বাড়ি, পুরানো মন্দির। ইলাস্ট্রেশন ও গ্রাফিক্সের সুপ্রয়োগও চোখে পড়ে। সিনেমাটোগ্রাফি চমৎকার। সব মিলিয়ে প্রথম সিজন থেকেই ‘রুদ্রবীণার অভিশাপ’-এর দর্শকধন্য হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল বলা যায়।