প্রস্তুত থাকুন ট্রোলড হওয়ার জন্য
‘মিম’, ‘ট্রোল’, ভাইরাল–ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপের কল্যাণে এই বিষয়গুলো এখন সকলেরই জানা। এর শুরুটা হয় একভাবে। শেষটা আর এক। মজা হলো, যারা শুরু করে, শেষটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের নিয়ন্ত্রণে আর থাকে না। এই রানু মন্ডলের কথাই ধরা যাক। সোশ্যাল মিডিয়া সেনসেশন রানু কোনও না কোনও কান্ড ঘটিয়ে রোজ ভাইরাল। ভাইরাল এবং ট্রোলড। কিছুদিন আগে ‘মানিকে মাগে হিতে’ গেয়ে এবং অতি সম্প্রতি আল্লু অর্জুনের ‘পুস্পা’ স্টাইলে নেচে সোশ্যাল মিডিয়ায় আবার চাঞ্চল্য ছড়িয়েছেন তিনি। রানুর ক্ষেত্রে ভাইরাল হওয়াটা তার নিজের হিসেবে মনে হয় ইতিবাচকই হয়েছে, সে গান নিয়ে ছেলেখেলা হোক বা সামগ্রিক রুচির নিম্নগামিতা। আর ওই শুরু এবং শেষ–রানুকে প্রথম যিনি ভাইরাল করেন, তিনি আজ মানচিত্রের বাইরে। রানু শিখে গেছেন সোশ্যাল মিডিয়ার সমীকরণ।
এটাও জানি, যেটা আমি ভাবছি, পাঠক সেটা না-ও ভাবতে পারেন। সবকিছুই এখন আপেক্ষিক–বিচার ও বিবেচনা। তবে, আপেক্ষিক হলেও নিম্নগামিতার বোধহয় একটা সীমা আছে। মুশকিল হলো সামান্য ছাড় পেলেই আমরা সীমা ছাড়াই। তখন স্বাধীনতার পূর্ণ অপব্যবহার। শিক্ষা, রুচি, বিচার, বিবেচনা জলাঞ্জলি দিয়ে শোভনতা, শালীনতার বেড়া ভাঙার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ি আমরা। যতদিন যাচ্ছে, এই ট্রেন্ড বাড়ছে। সামান্য নামী থেকে প্রতিষ্ঠিত লোকজন–সকলেই যেন এই সীমা ছাড়াবার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। পাশাপাশি আম জনতার কথা তো ছেড়েই দিলাম। তাঁদের অধিকারের যেন কোনও সীমা নেই ! যত্রতত্র (পড়ুন সোশ্যাল মিডিয়ায়) যা খুশি বলতে পারেন ওঁরা।
আমাদের শৈশবে এই শিক্ষাটায় খুব জোর দেওয়া হতো–বাক-সংযম ! কোন কথা কোথায় বলবো, কোথায় নয়–তার সুস্পষ্ট একটা বিধি ছিল। বলা বাহুল্য, সামাজিক ক্ষেত্রে একটা সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশ বজায় রাখার জন্যই এই পাঠ। এই যেটা আমি লিখলাম, এটা নিয়েও বিতর্ক, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ চলতে পারে। চলেও। ফেসবুকে প্রায়শই চোখে পড়ে বিষয়টা। এর ফলে যেটা হয়, ভদ্র ও শিক্ষিত, সু-আচার সমৃদ্ধ মানুষজন কিছুটা গন্ডিবদ্ধ হয়ে যান। তাঁরা ওই খোঁচার কারণে সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকেন।
আমরা ভাষা প্রয়োগের বিষয়টি ছাড়াও শিখতাম একে অপরের প্রতি আচার-ব্যবহার। সমাজের প্রতিটি মানুষের সঙ্গে কীভাবে কথা বলব, কেমন ব্যবহার করব, তার একটা সুস্পষ্ট গাইডলাইন অলিখিত ভাবে মেনে চলাটা সামাজিক নিয়মের মধ্যেই পড়ে। এটাকে নিছক অনুশাসন কিন্তু বলা যাবে না। এটা সমাজবদ্ধ মানুষের পারস্পরিক সুসম্পর্ক বজায় রাখার একটা ফর্মূলা। এবার এই ফর্মূলা কেউ মানবে কিনা সেটা যার যার নিজের বিবেচ্য। আমরা যারা মেনে এসেছি,তারা এতে সুফল পেয়েছি নিশ্চয়ই।
আমাদের সময়ের সব শিক্ষা ভালো আর এখন কোনও শিক্ষাই নেই, এমন কথা বলাটা নিশ্চয়ই খুব একপেশে হয়ে যাবে। কিন্তু এটা তো ঠিক, কথাবার্তা, আচার-ব্যবহারের সেই শিক্ষা আজও কাজে লাগে
আমাদের। একটা সুস্থ সামাজিক বাতাবরণ বজায় রাখতে অনেকটাই সাহায্য করে। সোশ্যাল মিডিয়ার গুরুত্ব একালে অসীম। আমাদের যাপিত জীবনের নিয়ন্ত্রক বহু ক্ষেত্রে। আর এখান থেকেই শুরু এক অনিয়ন্ত্রিত সামাজিক সমস্যার।
সুসম্পর্ক বজায় রাখার ফর্মূলা, সুস্থ সামাজিক বাতাবরণ সৃষ্টির প্রক্রিয়া। সেই রীতি বা ফর্মূলা না মানার এক জ্বলন্ত নিদর্শন এখন ফেসবুক খুললেই পাতায় পাতায় প্রকট। যে যাকে যা খুশি বলছে, যেভাবে পারছে অপমান করছে, গালিগালাজের তো কোনও সীমাই নেই। কারও বিরুদ্ধে আক্রমণের ছুরি শানানোর প্রথম ধাপটাই হলো তাকে অকথ্য গালিগালাজ, খিস্তিখেউর এবং নানাভাবে কলঙ্কিত করা। একটা শ্রেণী প্রবল ভাবে সক্রিয়, যারা দিবারাত্র এটাই করে। এরা উন্নত প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে ভালো কিছু, যা সমাজের অগ্রগতির পক্ষে, সেটা করে না। এরা প্রযুক্তির সাহায্যে লোকজনকে নিয়ে নোংরা মিম বানায়, ট্রোল করে, তারপর তা ব্যাপক হারে ছড়িয়ে দেয় ফেসবুক, হোয়াটসআপ, টুইটার সর্বত্র। ভাইরাল করা, ভাইরাল হওয়ার ব্যাপারটাকে এখন ভাইরাস অর্থাৎ রোগজীবাণু ছড়ানোর সঙ্গে নির্দ্বিধায় তুলনা করা যেতে পারে।
সত্যি কথা বলতে কি, মানুষের ভিতর কি পরিমান বিদ্বেষের বিষ জমা থাকে, ভিতরের সেই বিষ কোন ময়লা আবর্জনায় মাখামাখি হয়ে নির্গত হতে পারে, সেটা শুধু ফেসবুক বিচরণের মধ্য দিয়েই বোঝা যায়। আর তার টার্গেট যদি কোনও মহিলা হয়, তবে তো কথাই নেই। বস্তুত, মহিলাদেরই তুলনায় বেশি টার্গেট করা হয়। এবং তার যে কি কদর্য রূপ ! একটি ছবি, কিছু শব্দের প্রয়োগে কিভাবে এক নারীকে অপমানিত করা যায়, তার অজস্র নিদর্শন সাম্প্রতিক সময়ে দেখেছি আমরা। এও একপ্রকার ধর্ষণ যদি বলি, তাহলে বোধহয় বাড়াবাড়ি হবে না। এই বিষয়ে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ একেবারে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের নীতি নিয়ে চলে। তাদের কিসে নিয়ন্ত্রণ, কিসে নয়, সেটা একশো শতাংশ বাণিজ্যিক পলিসি মেনে নির্ধারিত হয়। সবশেষে একটাই কথা–সকলেই সাবালক। নিজেরাই জানেন ঠিক-বেঠিকের তত্ত্ব। শুধু, পরে যেন আক্ষেপ করবেন না। প্রস্তুত থাকুন নিজেরাও ট্রোলড হওয়া এবং আরও কিছুর জন্য।
*ছবিঃ প্রতিকি