Monday, February 3, 2025
দর্পণে জীবনসোশ্যাল মিডিয়া

ফেসবুক প্রেম এবং…

আজকের জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ। কত সম্পর্ক তৈরি। কত ভাঙাগড়ার গল্প ! কেউ মনের ভাব প্রকাশে, কেউ বা শিল্পচর্চায়–বাণিজ্যিক লেনদেন থেকে রেসিপি-কলা এই প্ল্যাটফর্মে সবাই হাজির। পড়ছেন চয়নিকা বসুর কলমে।

শুরুতে ছিল অর্কুট। এখন ফেসবুক। অর্কুট বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ফেসবুকের জনপ্রিয়তা বাড়ে। এখন তো সেটা তুঙ্গে। সদস্য সংখ্যার বাড়বৃদ্ধি যত, ফেসবুকের তত বাণিজ্যিক রমরমা। এই মুহূর্তে আপনি যদি বলেন, আমার ফেসবুক একাউন্ট নেই, আপনাকে সমাজ একঘরে করে দিলেও দিতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়া থুড়ি ফেসবুক এখন এভাবেই স্টেটাস সিম্বল হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু তাই নয়, ফেসবুক আক্ষরিক অর্থেই এক গণতান্ত্রিক প্ল্যাটফর্ম। এখানে সবাই সবার বন্ধু। সত্যিই কী তাই ? সেই প্রসঙ্গেই যাব এবার। তবে, বন্ধুত্ব নয়, ফেসবুক ঘটিত প্রেম আমাদের এবারের চর্চার বিষয়। এমনিতে প্রেম খুবই স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত একটি অনুভব। কিন্তু ফেসবুক প্রেমের ক্ষেত্রে এমনটা জোর দিয়ে বলা যায় না।

ভার্চুয়াল দুনিয়ার এই প্রেমজ সম্পর্ক বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এমন সব ভয়ঙ্কর কান্ডকারখানার চিত্রনাট্য তৈরি করে ফেলে যে তার কাছে একালের ওটিটি কাহিনিও হার মানবে। আমার পরিচিত এক মহিলা, ধরে নিন তাঁর নাম রঞ্জনা। আসল নাম সংগত কারণেই দিলাম না। সত্যি বলতে কী, দেওয়া জরুরিও নয়। এই রঞ্জনা আমি-আপনি যে কেউ হতে পারে। অকাল বৈধব্য, সন্তানহীনতা নিয়ে বড্ড হতাশাগ্রস্ত হয়ে ছিল সে জীবনের একটা সময়। শ্বশুরবাড়ির হেনস্থার শিকারও হতে হয়। স্বামীর দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুকে তারই কপালের দোষ বলে উঠতে বসতে কথা শোনানো হয়। তার আগেই অবশ্য সন্তান না হওয়ার কারণে অপরাধের কাঠগোড়ায় ছিল রঞ্জনা। স্বামী থাকাকালীন সবসময় পাশে থেকে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের আক্রমণের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। এখন তিনিও নেই।

এরপর রঞ্জনা বাপের বাড়ি এসে ওঠে একান্ত বাধ্য হয়েই। বাড়ি মানে দু’কামরার একটি ফ্ল্যাট। মা-বাবা গত হয়েছেন আগেই। একটি মাত্র ভাই এখন আমেরিকায় সেটেলড। এই ফ্ল্যাটটি রঞ্জনার নামে। বাবা-মা থাকতেই ভাই স্বত্ব ত্যাগ করে। ভাইয়ের কথাতেই বাবা-মা রঞ্জনাকে ফ্ল্যাটটি লিখে দিয়ে যান। ভাগ্যিস !!! যাই হোক, শুরু হলো রঞ্জনার একার জীবন, একটি দিনরাতের মা-বাবার আমলের কাজের লোককে সঙ্গী করে। আমার সঙ্গে মাঝে তেমন যোগাযোগ ছিল না রঞ্জনার। সেই সময়কার ঘটনা এসব। আমি যখন জানলাম, ততদিনে জল অনেকদূর গড়িয়েছে। রঞ্জনা এক মানসিক রোগীতে পরিণত হয়েছে ততদিনে।

ফ্ল্যাটে থাকতে আসার পর তার কোনও এক বান্ধবী রঞ্জনার একাকীত্ব দূরীকরণে ফেসবুকের শরণাপন্ন হতে পরামর্শ দেয়। এতে দোষের কিছু নেই। এমন তো প্রায়ই হয়ে থাকে। যাই হোক, দিনের অনেকটা সময় ফেসবুকে কাটাতে শুরু করে রঞ্জনা। কিছু বন্ধুও জোটে। এই পর্যন্ত ঠিক আছে। তারপর একজন প্রেমিক জোটে রঞ্জনার। অভিজ্ঞতা বলে, নারী-পুরুষের সম্পর্কের প্রেক্ষিতে ফেসবুকের বন্ধুত্ব,ফেসবুকের প্রেম–খুবই সুক্ষ এক সীমারেখা দুইয়ের মাঝখানে। এটা হৃদয় নয়, মস্তিষ্ক দিয়ে বুঝতে হয়। এর বাইরে সত্য-মিথ্যার গল্প তো আছেই।

রঞ্জনার ক্ষেত্রে এই সত্য-মিথ্যার ব্যাপারটা জটিল আকার ধারণ করে। চোখের সামনে থেকে প্রেমের পর্দা সরে যেতে চোখে অন্ধকার দেখে সে। প্রথমে ফোন নাম্বার বিনিময়, তারপর মেসেজের আদানপ্রদান। এইভাবে চলে কিছুদিন। ফোনাফুনিও শুরু হয়ে যায়। রঞ্জনা এই সম্পর্কের কথা গোপনেই রাখে। ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও কিছুই জানতে পারে না। তারপর হঠাৎ একদিন সেই প্রেমিকপ্রবর হাওয়া ! ততদিনে রঞ্জনা মানসিকভাবে প্রবল নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে ছেলেটির ওপর। কিছুদিন পরে ফেসবুকের এক কমন বন্ধুর সূত্রে রঞ্জনা জানতে পারে, প্রোফাইলটা ফেক, ছবি ও পরিচয়ের পিছনে অন্য কেউ। আরও কয়েকজন মেয়ে ও মহিলার সঙ্গে এই প্রেম প্রেম খেলাটা খেলেছে সে। প্রতিবারই নতুন ছবি ও পরিচয়।

একটি মেয়ে লালবাজার সাইবার ক্রাইম বিভাগে অভিযোগ করায় জানাজানি হয়েছে। পুলিশ বেরও করে ফেলেছে আসল লোকটিকে। রঞ্জনা বেঁচে গেছে। অনেকের ক্ষেত্রে টাকাপয়সা ঘটিত ক্ষতিও হয়েছে। এসব জানায় রঞ্জনা খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি। বিশ্বাসভঙ্গের ব্যাপারটাই বড় হয়ে উঠেছে তার কাছে। চারিত্রিক দিক থেকে সে নিজে খুবই আবেগপ্রবণ ও সংবেদনশীল একজন মানুষ। নানা যন্ত্রনা ও অশান্তির প্রহর পার করে নতুন এক সম্পর্কে বাঁচতে চেয়েছিল সে। তার অবস্থা দেখে বন্ধুদেরই একজন রঞ্জনার ভাইকে খবর দেয়। ভাই এসে ডাক্তার ইত্যাদি ব্যবস্থা করে। আপাতত চিকিৎসাধীন রঞ্জনা। ভাই ফিরে চলে গেছে। কাজের লোকটি পুরোনো, সে-ই এখন দেখে রাখে রঞ্জনাকে। বন্ধুরা যাতায়াত করে।

পাঠকও নিশ্চয়ই এমন অনেক রঞ্জনাকে চেনেন। এমন বলছি না, সবসময় নেতিবাচক ঘটনাই ঘটে। ফেসবুকের প্রেম পরিণতি পেয়েছে বিয়ে ও সুখের সংসারে, এমনও শুনেছি। কিন্তু সেটা শতাংশের বিচারে কম। সবচেয়ে বড় কথা, আপনি বুঝবেন কী করে ? ফেক প্রোফাইল যারা বানায়, তাদের নানা উদ্দেশ্য থাকে। নানাভাবে মানুষের সারল্যের সুযোগ নেই তারা। বুঝতে বুঝতে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে যায়। কোথাও অর্থ, কোথাও মনপ্রাণ। অতএব, সাধু সাবধান !!

ছবি : প্রতীকী