বই: সুভাষচন্দ্র : অন্তর্ধান, প্রত্যাবর্তন ও অন্বেষণ | লেখক : দীপায়ণ রায়চৌধুরী | পাঠ প্রতিক্রিয়া
জানালেন – শুভব্রত বসু
বই: সুভাষচন্দ্র : অন্তর্ধান, প্রত্যাবর্তন ও অন্বেষণ
জঁর – নন – ফিকশন
লেখক : দীপায়ণ রায়চৌধুরী
প্রকাশক : প্রজ্ঞা পাবলিকেশন
বাঁধাই – রয়্যাল হার্ড বাউন্ড
পৃষ্ঠা সংখ্যা – ৭২৭
মূল্য – ₹ ৮৯০/-
নেতাজী সুভাষচন্দ্র – কত মানুষের কাছে একজন রূপকথার নায়ক, একটি জীবন্ত স্বপ্নের রূপ সে সংখ্যা গণনা করা সম্ভব নয়।
এই মানুষটিকে নিয়ে সাধারণ ইতিহাস বই বা ছোটদের সুভাষচন্দ্র গোছের বই পড়ে বড় হওয়া আমি প্রথম সিরিয়াস বই পড়ি – শৈলেশ দে রচিত তিন খণ্ডের “আমি সুভাষ বলছি”। এরপরে রিফ্লেক্ট থেকে প্রকাশিত শ্যামল বসু রচিত ” সুভাষ ঘরে ফেরে নাই”।
এই দুটি বই যখন পড়ি তখন বহু বিষয় অজ্ঞাত ছিল, কটক শহরে জন্ম ও বড় হয়ে ওঠা সুভাষ কেনই বা ভারত ছেড়ে চলে গেলেন, আর বিদেশে থেকে ভারতকে স্বাধীন করবেন বলে খোয়াব দেখলেন – সে কথা বুঝতে পারিনি।
কলেজে পড়ার সময় পরপর পড়ি নারায়ণ সান্যাল রচিত দুইখানি বই – “আমি নেতাজীকে দেখেছি” ও “নেতাজী রহস্য সন্ধানে”। পড়ে চমকে উঠি। আবার খুলে বসি “সুভাষ ঘরে ফেরে নাই”। চোখের সামনে থেকে পর্দা উঠতে থাকে। চিনতে শুরু করি একজন আপসহীন সংগ্রামীকে, একজন তুখোড় দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে। যাকে সমঝে চলত সারা পৃথিবীর তাবড় দেশনায়কেরা।
কিন্তু…
কেন তিনি ফিরে এলেন না? এই পোড়া দেশকে তাঁর মত করে কেই বা ভালোবেসে ছিল? তিনি ফিরে এলে তো আমরা অন্য এক ভারতের নাগরিক হয়ে জন্মাতাম।
উত্তর খুঁজে খুঁজে ফিরি…
হাতে আসে দিল্লির সাংবাদিক অনুজ ধরের লেখা India’s Biggest Cover- up. পড়ি আর চোখ বিস্ফারিত হয়ে ওঠে।
এত জঘন্য ষড়যন্ত্র? এত নীচ মানসিকতা?
আবার হাতে পাই কেশব ভট্টাচার্য বিরচিত “চক্রবূহ্যে নেতাজী” – আবার চমক। এরমধ্যে প্রকাশিত হয় – অনুজ ধর ও চন্দ্রচূড় ঘোষ রচিত Conundrum. এই সময় সুলভে দেখা যাচ্ছে ইউটিউব, সেখানে অনুজ ধর ও চন্দ্রচূড় ঘোষের সাক্ষাৎকার, এবং বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে কথপোকথন দেখতে দেখতে বিষয়টা ক্রমশ পরিষ্কার Sold থাকে। অনেক জটিল ও জট পাকানো বিষয় একসঙ্গে সামনে আসে – খোলসা হয়। গতবছর এই সময়ে সংগ্রহ করি চারণিক রচিত “ঐ মহামানব আসে” দুটি খণ্ড ও “মহাকাল কথন”।
ম্যাজিক ঘটে যায়, এবং প্রায় এই সময়েই জানতে পারি দীপায়ণ রচনা করছেন তাঁর দীর্ঘদিনের গবেষণা লব্ধ সাধনা -” দেশনায়ক”
গঙ্গা দিয়ে এই একবছরে অনেক জল গড়িয়েছে। বইমেলার আগে প্রকাশিত হয়েছে আলোচিত বইটি।
সর্বাগ্রে বলব – আমার প্রিয় গবেষক ও প্রাবন্ধিক শ্রী রজত পালের লেখা ভূমিকা টির কথা। যিনি এই বই পড়বেন, অবশ্যই পড়বেন রজতদার লেখা এই ভূমিকাটি।
এরপরে প্রশ্ন ওঠে, এই বিষয়ে এতগুলি বই পড়ার পরে এই বইটি পড়ার দরকার কী? এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। এবং দীর্ঘ বারো দিন ধরে বুঁদ হয়ে পড়ার পর মনে হয়েছে – এই গবেষণা পত্র প্রকাশিত হওয়ার দরকার ছিল।
এই বইটিতে সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনের চারটি অধ্যায় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
১) সুভাষচন্দ্র বসুরর সেই বিখ্যাত অন্তর্ধান।
২) জাপান ও পূর্ব এশিয়ায় আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন ও তার সর্বাধিনায়ক হিসেবে সুভাষচন্দ্র বসুর “নেতাজী” হিসেবে আত্মপ্রকাশ।
৩) তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু নাকি মৃত্যু নয়!
৪) ভারতে প্রত্যাবর্তন ও গুমনামি বাবা বা ভগবানজি।
কী আছে:
প্রতিটি ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ চুলচেরা আলোচনা ও প্রতিটি আলোচনার স্বপক্ষে (কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিপক্ষে) নথিপত্র সহযোগে প্রমাণ দাখিল।
অসংখ্য পরিচিত, অর্ধপরিচিত এবং অপরিচিত মানুষ – যারাই এই চারটি অধ্যায়ে সম্পৃক্ত তাদের সম্পর্কে অসংখ্য তথ্য সহযোগে ঘটনাবলীর পারম্পর্য রক্ষা করে বিশ্লেষণ।
কেন আছে:
নেতাজী সুভাষচন্দ্র এক আবেগের নাম। কিন্তু কোথা থেকে আসে এই আবেগ?
একজন মানুষ যিনি আই এ এস অফিসার হয়ে বিলাসবহুল জীবনযাপন করতে পারতেন, তিনি হেলায় সব ঠেলে ফেলে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন।
কিন্তু…
পদে পদে তাঁকে তাড়া করে বেড়িয়েছে বিশ্বাসঘাতকতা, ভাগ্যের বিড়ম্বনা। যে দেশের জন্য তিনি সর্বস্ব ত্যাগ করেছিলেন – সেই দেশের নেতারাই নিজেদের গদীর লোভে তাঁকে কখনও মৃত বলে প্রমাণ করতে চেয়েছে, কখনও হাজির করেছে এমিলি ও অ্যানিটাকে স্ত্রী কণ্যা হিসেবে।
শুধু তো নেতা নেত্রী নন, তাঁর ফৌজের সেনানী অসংখ্য মানুষ পিঠে ছুরি মেরে নিজের আখের গুছিয়েছে।
কোথায় গেল আজাদ হিন্দ সরকারের বিপুল সম্পদ? কেন কংগ্রেস বা যুক্ত ফ্রন্ট বা বিজেপি কোনো সরকারই নেতাজী সংক্রান্ত বিপুল ফাইল ডিক্লাসিফাই করল না আজও?
কেন বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন সময়ে তাদের বক্তব্য বদলে ফেলেছে? দিন কে রাত করেছে কেউ – তার বদলে সরকারি সুযোগ সুবিধা বাগিয়ে সমাজের মাথায় চেপে বসেছে।
শাহ নওয়াজ খান থেকে প্রেম ও লক্ষী সায়গল কেউ এই তালিকা থেকে বাদ যায়নি? কেন এত ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা?
অনেকেই এই বিষয়গুলি জানেন, সংবাদ পত্রে, বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেলে অসংখ্য সাক্ষাৎকার আছে, বইও কিছু কম নেই, (আমিই তো বোধহয় গোটা দশেক বইয়ের নাম উল্লেখ করেছি) – তবুও এই বইয়ের প্রয়োজন আছে, কারণ এত তথ্য এত প্রামাণ্য নথি দিয়ে বিশ্লেষিত বই বাংলায় নেই বললেই চলে।
মিশন নেতাজী – অনুজ ধর, চন্দ্রচূড় ঘোষ, সৈকত নিয়োগী প্রমুখ এগিয়ে নিয়ে চলেছেন, নিয়মিত তথ্য পাচ্ছি কুণাল বসুর I’m Bose চ্যানেলের উপস্থাপনায়।
তবুও আরও পাথুরে প্রমাণ, আরও জোরদার তথ্য সহ নেতাজীর সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার জন্য এই বই সহায়ক হবে।
শেষে : বইটি বিপুল, এবং তা সত্ত্বেও আমার বিশ্বাস কিছু অংশ সংক্ষেপিতও বটে। দীপায়ণের কাছে অনুরোধ যে অংশগুলি সংক্ষিপ্ত আকারে লেখা হয়েছে, সেগুলিও বিস্তারিত আলোচনা হয়ে আসুক, প্রয়োজনে আরও কয়েকটি খণ্ডে।
আমরা আরও সম্বৃদ্ধ হই, আমরা আরও জোর গলায় আওয়াজ তুলি
“জয়তু নেতাজী”
—————————-
প্রাপ্তিস্থানঃ
- প্রজ্ঞা পাবলিকেশনের নিজস্ব বিপণী। বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট, প্যারামাউন্টের ঠিক বিপরীতে।
- ঘরে বসেই বইটি হাতে পাওয়ার জন্য WhatsApp করুন 9147364898 – এই নম্বরে।
অন্যান্য প্রাপ্তিস্থান –
- দে বুক স্টোর (দীপুদা)
- জানকী বুক ডিপো (সুখরঞ্জন দা)
- বইবন্ধু