Monday, February 3, 2025
ঠিকানা দিকশূন্যিপুর

রেলপথে দেশের পূর্ব থেকে পশ্চিমে, যাত্রা আহমেদাবাদে

দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম। প্রাচীন ভারতের হারিয়ে যাওয়া অসাম্প্রদায়িক, মানবিক বন্ধনের রূপটি আহমেদাবাদে আবিষ্কার করে আপ্লুত হয়েছিলাম। লিখেছেন অজন্তা সিনহা। তিনটি পর্বে পড়বেন এই ভ্রমণ রচনা। আজ প্রথম পর্ব। 

শিলিগুড়ি থেকে আহমেদাবাদ যাব রেলপথে, এমন সিদ্ধান্ত শোনামাত্রই হা হা করে উঠেছিল আমার আহমেদাবাদ নিবাসী আত্মীয়স্বজন। কেন এমন হঠকারি (তাদের ভাষায়) সিদ্ধান্ত, সেটা বোঝাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। দেশের পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রান্ত, দূরত্ব অনেকটাই। তবু, আমার ট্রেনে যাওয়ার ভাবনা খুব অযৌক্তিক ছিল না। তখন চাকরি থেকে সবে অবসর নিয়েছি। নতুন কাজকর্মও শুরু হয়নি। আর্থিক দিক থেকে প্লেনে যাতায়াত সম্ভব ছিল না। এরই পাশাপাশি আর একটি কারণও ছিল–যে ট্রেনটাতে আমি যাব, তার রুট। কামাখ্যা-গান্ধীধাম এক্সপ্রেস নামের যে সাপ্তাহিক ট্রেনটিতে আমি যাব, সেটি আসাম, বাংলা, বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, রাজস্থান হয়ে গুজরাত পৌঁছয়। 

Images 14 2
রেলপথে দেশের পূর্ব থেকে পশ্চিমে, যাত্রা আহমেদাবাদে 8

অর্ধেক ভারত দেখে ফেলার এমন সুযোগ কে ছাড়ে ? যাত্রাপথ সম্পর্কে যেমনটা ভেবেছিলাম, ঠিক তেমনটাই ঘটল। টানা ৪৮ ঘন্টা ট্রেনযাত্রার ধকল টের পাওয়া দূর, রঙদার ও বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতায় ঝুলি ভরে উঠল। প্রসঙ্গত, রেল দফতর ট্রেনগুলি পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব কোনও একটি দায়িত্বশীল সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ায়, অপরিচ্ছন্নতা জনিত সমস্যায় ভুগতে হলো না। মজার ব্যাপার হলো, শুরু থেকেই ট্রেনটা যাকে বলে ‘নানা ভাষা নানা মত’-এর বিচিত্র গুঞ্জনে ভরে উঠল। সে এক মহা মিলনের সুর। আমাদের কামরার অভ্যন্তরে যেন কথায়, সংস্কৃতিতে, খাদ্যের সম্ভার-সুগন্ধে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত উঁকি দিল। খুবই অভিনব ও আকর্ষণীয় সেই উপলব্ধি। 

Images 3 1
রেলপথে দেশের পূর্ব থেকে পশ্চিমে, যাত্রা আহমেদাবাদে 9

পরিবেশের অনুষঙ্গেই বেশকিছু মজাদার অভিজ্ঞতাও হলো। আমার মতো একজন প্রবীণা একা এত দূরের পথে যাচ্ছি, এটা নিয়ে অনেকের মধ্যেই বাড়তি কৌতূহল ছিল। তবে, আমি আপ্লুত হলাম সহযাত্রীদের  ব্যবহারে। কামরার প্রত্যেকে এগিয়ে এসেছিলেন দরকার মতো। এত দূরের পথ একা চলেছি, বুঝতেই দেননি কেউ। বহু মানুষ দেখা, কয়েক ঘন্টার জন্য হলেও তাদের সুখদুঃখের শরিক হওয়া। নিজেকে যথার্থই জীবনপুরের পথিক মনে হচ্ছিল। ফেরাটা আহমেদাবাদ-কলকাতা প্লেনে, কলকাতা-শিলিগুড়ি ট্রেন। এই যাত্রাটা গতানুগতিক। কিন্তু যাওয়ার সময়ের দুটি দিন স্মৃতিতে থেকে যাওয়ার মতো। ভুলবো না ক্ষণিকের জন্য দেখা ভালোবাসায় মাখা মুখগুলি।

Img 20230903 Wa0080
রেলপথে দেশের পূর্ব থেকে পশ্চিমে, যাত্রা আহমেদাবাদে 10

আহমেদাবাদ স্টেশন পৌঁছনোর পর মালপত্র নিয়ে স্টেশনের বাইরে বের হলাম। খুড়তুতো ভাই এসেছে স্টেশনে। ক’টা দিন থাকব তারই বাড়িতে। যাওয়ার পথে চোখে পড়ল শহরের এক ঝলক। রাত নেমেছে আহমেদাবাদ শহরের বুকে। পার হলাম সবরমতি নদী। আকারে বেশ চওড়া। লম্বা আলোকোজ্জ্বল সেতু। এর তীরেই মহাত্মা গান্ধীর ইতিহাস প্রসিদ্ধ আশ্রম। এই নদীর ওপর এমন আরও কয়েকটি সেতু জুড়েছে শহরের এপার-ওপার। পুরো শহর জুড়ে চওড়া চওড়া রাস্তা, গগনচুম্বী অট্টালিকা, প্রচুর ঝলমলে শপিং মল, শো রুম, ফিটনেস সেন্টার, ঝাঁ চকচকে রেস্তোরাঁ ইত্যাদি। যেতে যেতে ভাবছিলাম, অত্যাধুনিক এই শহরের অন্তরমহলের কথা। সেখানে আজও বুঝি প্রাচীনতার গন্ধ মাখা। তাই তো, ইউনেস্কো একে হেরিটেজ সাইট ঘোষণা করেছে !

Images 13 1 1
রেলপথে দেশের পূর্ব থেকে পশ্চিমে, যাত্রা আহমেদাবাদে 11

পরের দিনটা নিখাদ বিশ্রাম। ৪৯ ঘণ্টা ট্রেন জার্নির পর এটুকু আরাম শরীরকে দিতেই হলো। আহমেদাবাদে আমার বেশ কয়েকজন আত্মীয় থাকে। তাদের কেউ কেউ চলে এলো দেখা করতে। এই দেখাটা নানা কারণেই বহু বছর পর। ফলে, আবেগের ঘটা বেশ তীব্রই ছিল। স্মৃতির পথে হেঁটে চলা আর আড্ডায় কাটল কিছুটা প্রহর। সবটাই নির্মল আনন্দের। পরের দিন বিকেলে শহর পরিক্রমা শুরু। প্রথমে গেলাম অক্ষরধাম। নাহ, এর সঙ্গে ঐতিহ্যের কোনও সম্পর্ক নেই। তবে ভারতীয় ধর্ম, পুরাণ এবং গুজরাতের মানুষের আবেগের যোগ নিশ্চয়ই আছে। বিশাল চওড়া রাস্তা ধরে এগোচ্ছে আমাদের গাড়ি। ট্রাফিক ব্যবস্থা নিখুঁত। পৌঁছনোর পর মন্দিরের ভিতর পর্যন্ত যেতে কড়া নিরাপত্তার বেড়া পার হতে হলো। শুনলাম কড়াকড়িটা বেশি হয়েছে, কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসবাদী হামলার পর থেকে।

Images 2 1
রেলপথে দেশের পূর্ব থেকে পশ্চিমে, যাত্রা আহমেদাবাদে 12

অপরূপ কারুকার্যখচিত এই মন্দিরের পুরো নাম স্বামীনারায়ণ অক্ষরধাম। ২৩ একর বিস্তৃত এক অঞ্চল জুড়ে প্রতিষ্ঠিত এই মন্দির তৈরি হয়েছে রাজস্থান থেকে আনা ৬,০০০ মেট্রিক টন গোলাপি বালিপাথরে (পিঙ্ক স্যান্ডস্টোন)। দেখে মুগ্ধ হতেই হয়। ভিতরে আছে ফুড কর্নার (সম্পূর্ণ নিরামিষ বলাই বাহুল্য), লাইব্রেরি ও বিপণনকেন্দ্র। বিপণনকেন্দ্রে যোগী স্বামীনারায়নের জীবন, দর্শন ও কর্ম সম্পর্কে বইপত্র রয়েছে। মন্দিরের ভাবনাও তাঁরই দর্শন ও আদর্শ সম্পৃক্ত। সমস্তটাই নিপুণ ছন্দে পরিচালিত। টিকেট কেটে ঢুকতে হয়। নিয়ম মেনে পর্যবেক্ষণ। ক্যামেরা, সেল ফোন নেওয়া বারণ। তাই ছবি তোলার কোনও সুযোগ নেই।

অক্ষরধামে একটি ওয়াটার শো হয় প্রতি সন্ধ্যায়। আধুনিক প্রযুক্তির চূড়ান্ত প্রয়োগ রয়েছে তাতে। লেজার, প্রজেক্টর, জলের ফোয়ারা বা ধারা (এমন যেন জলেই তৈরি ব্যাকড্রপ) ও লাইভ মঞ্চাভিনয়–সব মিলিয়ে চূড়ান্ত চমকপ্রদ ও বর্ণময় এক শো। এদিনের সন্ধ্যার উপজীব্য ছিল যম ও নচিকেতার কাহিনি। এই রকমই নানা কাহিনির মধ্য দিয়ে পুরাণকথা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে দর্শক দরবারে। উপস্থিত জনতা এতে বেশ আপ্লুত ও অভিভূত দেখলাম। শো শেষ হলে, অগণিত সেই মুগ্ধ জনতার পায়ে পা মিলিয়েই এলাম মন্দিরের বাইরে। সেই রাতে ডিনার ছিল এক নামী রেস্তোরাঁয়, অবশ্যই নিরামিষ ডেলিকেসি সহযোগে।

Wdm3B 14155 Lko Nr With Kyq Gimb Exp 12
রেলপথে দেশের পূর্ব থেকে পশ্চিমে, যাত্রা আহমেদাবাদে 13

বেশ ঝলমলে রোদ্দুর মাখা এক সকাল। আহমেদাবাদ পাক্কা বহুতলের শহর। কোথাও সবুজের কোনও চিহ্ন নেই। তবে, যেখানে আমি আছি সেই দশতলা ফ্ল্যাটের ব্যালকনি থেকে অনেকটা খোলা আকাশ দেখা যায়। যথারীতি নিচে পুরোটাই কংক্রিটের জঙ্গল। সেই সব দেখতে দেখতেই কিছুটা দূরে চোখ আটকে যায়। বৃহৎ এক বিল্ডিংয়ের পুনর্নির্মাণের কাজ চলছে সেখানে। এর সম্পর্কে তথ্য জেনে চমৎকৃত হই। বিশ্বের বৃহত্তম ক্রিকেট স্টেডিয়াম রয়েছে এই শহরেই। অধুনা দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নামাঙ্কিত এই স্টেডিয়াম আহমেদাবাদের মোটেরায় সরদার বল্লভভাই প্যাটেল স্পোর্টস কমপ্লেক্সে অবস্থিত। আগে এই স্টেডিয়ামের নাম ছিল মোটেরা স্টেডিয়াম। পরিচালনার দায়িত্বে গুজরাত ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন। এই স্টেডিয়ামে  একত্রে ১ লক্ষ ১০ হাজার দর্শক খেলা দেখতে পারেন। এর আগে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন ক্রিকেট স্টেডিয়াম ছিল এক নম্বরে। নিঃসন্দেহে গর্বের ব্যাপার ! (চলবে)

ছবি ঋণ : ইন্টারনেট