হারানো দিনের গানের গল্প…
চল্লিশ পেরিয়ে আসা বাঙালি এখনও স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়ে পুরনো বাংলাগান শুনে। সেইসব গানের গল্পই এই বিশেষ ধারাবাহিক প্রতিবেদনে। আজ চতুর্থ ও শেষ পর্ব। লিখছেন প্রদীপ্ত চৌধুরী।
গীতিকাররা তো মূলত কবিই। চারপাশের প্রায় সবকিছুই তাঁরা খুঁটিয়ে দেখেন। এবং অনেক ঘটনাই যথেষ্ট প্রভাব ফেলে তাঁদের মনে। লেখার খাতায় সেই আলো বা ছায়াই ফুটে ওঠে কবিতা কিংবা গান হয়ে। গীতিকার ভাস্কর বসু ছিলেন এমনই এক সংবেদনশীল কবি। পেশায় তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক। গায়ক মৃণাল চক্রবর্তীর অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন তিনি। মৃণালের বাড়িতে নিত্য যাতায়াত ছিল তাঁর। মৃণাল তাঁর বাবাকে হারিয়েছিলেন মাত্র চার বছর বয়সে। বন্ধুর মায়ের এই করুণ বৈধব্য গভীর প্রভাব ফেলে ভাস্করের কবি-মনে। সেই অনুভবই গান হয়ে উঠে আসে তাঁর খাতায়। তাতে সুর চাপিয়ে অসাধারণ একটি গানের জন্ম দেন মৃণাল। গাইলেনও তিনিই। একসময় খুবই জনপ্রিয় এই গানটির প্রথম কয়েকটি লাইন হলো ‘মৃণাল বাহুলতা ঘেরিয়া / কাঁকন রিনিঝিনি বাজে না / প্রিয়ের অনুরাগ হেরিয়া / সিঁদুরে সিঁথি আর রাঙে না…’।
সলিল চৌধুরীর সুরে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের একটি জনপ্রিয় গান হলো ‘যদি জানতে গো তুমি জানতে’। সলিলীয় সুরের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য গানটায় ভরপুর। সলিল এ-গানের সুরটা করেছিলেন আগে। আর লিখে রেখেছিলেন শুধু মুখরাটুকু। রিহার্সালেও গানের বাকি অংশটা উনি লা-লা-লা করেই মানবেন্দ্রকে তুলিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু গণ্ডগোলটা বাঁধল রেকর্ডিং-এর ঠিক আগের মুহূর্তে। দেখা গেল, বাকি গানটা লিখতে তিনি বেমালুম ভুলে গেছেন। শুনে তো সকলের মাথায় হাত !
সেই চরম বিপদেও মানবেন্দ্র সলিলকে রসিকতার সুরে বললেন, “দাদা, হাতে আজ সময় তো খুবই কম। এবার কিন্তু আপনাকে প্রতিভার পরীক্ষায় বসতে হবে।” সলিল চৌধুরী ততক্ষণে একটা সিগারেটের প্যাকেট ছিঁড়ে তার সাদা দিকটায় বাকি গানটা খুদে খুদে অক্ষরে লিখতে শুরু করে দিয়েছেন। রেকর্ডিং ফ্লোরে নয়, সামনের সবুজ লনে একটা চেয়ারে বসে। বড়জোর মিনিট দশেক। ব্যস, তার মধ্যেই গোটা গানটা লেখা হয়ে গেল। মানবেন্দ্র-সহ উপস্থিত সকলেই তখন হতবাক। সদ্য লেখা লাইনগুলি ছিল এইরকম–’তুমি জান কি / আমি এলাম জীবনদিগন্তে / সান্ত্বনা মোর এই শুধু / আমি পাড়ি দিয়েছি বসন্তে / ধরা ফুলে ফুলে গেছে ছেয়ে / এই জীবন বন-বনান্তে’।
এই সলিল চৌধুরীই একবার চার্লি চ্যাপলিনের ‘লাইমলাইট’ দেখে হল থেকে বেরিয়েছেন। অসম্ভব ভালো লেগেছে ছবিটা। কিন্তু মাথা থেকে কিছুতেই বেরোচ্ছে না ছবির থিম সং-টা। বাড়ি ফেরার আগেই সেই সুরের আদলে মনে মনে রচনা করে ফেললেন ‘পল্লবিনী গো সঞ্চারিনী’। দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া সেই গানের জনপ্রিয়তা এখনও পুরোদস্তুর অটুট ।
একবার কোনও একটা ছবির কাজে বিমানে চেপে দক্ষিণ ভারত যাচ্ছিলেন সলিল। মাঝপথে ঝড়ের কবলে পড়ল সেই বিমান। পরিস্থিতি একটা সময় বেশ বিপজ্জনক হয়ে পড়ল। বেশ কিছুক্ষণ পর অবশেষে অক্ষত বিমান নিয়েই এয়ারপোর্টে নামলেন পাইলট। ততক্ষণে সলিলও তাঁর আতঙ্কটা অনেকটা কাটিয়ে উঠেছেন। মৃত্যুভয়ের অন্ধকার কেটে গিয়ে আবার ফুটে উঠছে বেঁচে থাকার আলো। সেই মনোভাবেরই অব্যর্থ প্রতিফলন উঠে এল তাঁর গানের খাতায়। অবিলম্বে ভূমিষ্ঠ হল আরও একটি মাইলফলক গান–‘আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা’।
আরও কত গানের জন্মের সঙ্গেই যে জড়িয়ে আছে এমন সলতে পাকানোর গল্প। কিন্তু তখন তো আর এমন ঢালাও প্রচারের যুগ ছিল না। তাই অধিকাংশ গল্পই পথ হারিয়েছে দিকশূন্যপুরে। হারিয়ে গেছে সময়ের স্রোতে ভেসে। শুধু মাথা উঁচু করে দ্বীপের মতো জেগে আছে কালজয়ী সব গানগুলি। আমাদের রক্ত-মজ্জা-শিরা-উপশিরায় একাকার হয়ে আছে তারা।