হার না মানা ঐন্দ্রিলা
আকারে ছোট হলেও বিনোদন ক্ষেত্রে টেলিভিশনের গুরুত্ব আজ অসীম। মেগা থেকে রিয়ালিটি, গেম শো থেকে ম্যাগাজিন–টিভি শোয়ের চাহিদা ছিল, আছে, থাকবে। এই বিভাগে তারই খবর পড়বেন প্রতি সপ্তাহে।
লিখেছেন সোমনাথ লাহা
অনিশ্চয়তায় ঘেরা আমাদের সকলের জীবন। সরু সুতোর ওপর দিয়ে চলার মতোই টালমাটাল। এহেন অনিশ্চিত এক সময়েই যেন অফুরান প্রাণশক্তি ও হাসিমাখা মুখ নিয়ে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার লড়াইয়ের মূর্ত প্রতীক হয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ান তিনি। ঐন্দ্রিলা শর্মা, মুর্শিদাবাদের বহরমপুরের এই মেয়েটি গত কয়েক মাস, নাকি বছর ধরে এভাবেই অনুপ্রাণিত করেন আমাদের। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত হার না মানা লড়াইয়ের এক জ্বলন্ত প্রতিচ্ছবি হয়ে থাকেন তিনি। মারণ ব্যাধি ক্যান্সারকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন ঐন্দ্রিলা, যার পরিণতি অবধারিত মৃত্যু। তবু, শেষ যুদ্ধে জয়ী তিনি ! যে কটা দিন বেঁচেছেন, একজন সাহসী যোদ্ধার মতোই ছিল ঐন্দ্রিলার আচরণ, যাপন ও দর্শন। চলে যাওয়াও সেই অনুসরণেই। বাঙালি বিনোদন দর্শক তাঁকে সেই জয়ের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেই মনে রাখবে।
‘ঝুমুর’ ধারাবাহিকের হাত ধরে ছোটপর্দায় পথচলা শুরু ঐন্দ্রিলার। তারপর ‘জীবনজ্যোতি’, ‘জিয়নকাঠি’-র মতো ধারাবাহিকে নিজের অভিনয়ের বিচ্ছূরণ ঘটান তিনি। ২০১৫-তে মেরুদন্ডের নিচে ক্যান্সার ধরা পড়ে তাঁর। কিন্তু তারপরও অদম্য জীবনীশক্তিতে ভর দিয়ে দিল্লি এইমসে ১৬টি কেমোথেরাপি ও ৩৩টি রেডিয়েশন থেরাপি নিয়ে মারণ রোগকে নিশ্চিহ্ন করে নতুনভাবে পথচলা শুরু করেন মানসিক শক্তিতে ভরপুর এই অভিনেত্রী। একবার নয়, দু’দুবার ক্যান্সারের মতো মারণব্যাধি ঐন্দ্রিলার শরীরে বাসা বাঁধলেও এতটুকু দমাতে পারেনি তাঁকে। ২০১৫-তে একাদশ শ্রেণিতে পড়াকালীন মারণ রোগের শিকার হন ঐন্দ্রিলা। কিন্তু হাল ছাড়েননি তিনি। অসুস্থ অবস্থায় একাদশের দু’টি পরীক্ষা স্কুল থেকেই দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে বেসরকারি হাসপাতালের বেডে শুয়ে পরীক্ষা দেন ঐন্দ্রিলা। রুপোলি পর্দায় অভিনয়ের পাশাপাশি ঐন্দ্রিলার অন্যতম ভালোবাসা ছিল নাচ। সাত-আট বছর বয়স থেকেই নাচের প্রতি তাঁর অনুরাগ। বহরমপুরের এক রিয়েলিটি শোয়ের হাত ধরেই রুপোলি দুনিয়ায় পা রাখেন ঐন্দ্রিলা। শো চলাকালীনই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তিনি। কিন্তু, তারপরও থামেননি, অডিশনে যোগ দেন এবং উত্তীর্ণও হন।
ঐন্দ্রিলা নিজের এই অদম্য লড়াইয়ে পাশে পেয়েছিলেন সহ-অভিনেতা, বন্ধু তথা মনের মানুষ সব্যসাচী চৌধুরীকে। ‘ঝুমুর’ ধারাবাহিকের সেটেই প্রথম আলাপ হয় দু’জনের। ঐন্দ্রিলার এই লড়াইয়ে তাঁর পাশে ছায়ার মতো দাঁড়িয়েছেন সব্যসাচী। প্রতিনিয়ত তাঁকে আগলে রাখার পাশাপাশি একবারের জন্যও ঐন্দ্রিলার হাত ছাড়েননি তিনি। ‘মহাপীঠ তারাপীঠ’ ধারাবাহিকে ‘ঝুমুর’-এর পর আবার একসঙ্গে কাজ করেন সব্যসাচী-ঐন্দ্রিলা। সেখান থেকেই তাঁদের বন্ধুত্ব ভালোবাসায় পরিণত হয়। যথার্থই ঐন্দ্রিলার ছায়াসঙ্গী হয়ে উঠেছিলেন সব্যসাচী। তাই কেমোথেরাপির জন্য যখন ঐন্দ্রিলাকে ন্যাড়া হতে হয়, নিজের মাথাও পুরো ন্যাড়া করে নিয়েছিলেন সব্যসাচী। মনের মানুষ যদি এভাবে পাশে থাকে, লড়াইয়ের জোরও কয়েক শো গুণ বেড়ে যায়। তাই তো ন্যাড়া মাথায় হাসিমাখা মুখে হাসপাতালের কেবিনে ঐন্দ্রিলার মনের আনন্দে নৃত্যরত ভিডিও যখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়, তখন মৃত্যুও থমকে দাঁড়ায়।
প্রসঙ্গত, ‘জিয়নকাঠি’ ধারাবাহিকে কাজ করার সময়ই দ্বিতীয়বার তাঁর শরীরে হানা দেয় ক্যান্সার। সেই সময় টলিপাড়া দেখেছে তাঁর মনের জোর। সেই ঘটনার সাক্ষী ঐন্দ্রিলার সহকর্মীরা। একাধিক ঝুঁকিপূর্ণ সার্জারির পর চলেছে কোমোথেরাপি, রেডিয়েশন। কিন্তু ঐন্দ্রিলার চোখে-মুখে কষ্টের লেশমাত্র নেই। তাঁর মুখের হাসি কখনও অমলিন হতে দেখেননি স্টুডিওপাড়ার লোকজন। হাসিমুখে ক্যামেরার সামনে দিনের পর দিন টেক দিয়েছেন ঐন্দ্রিলা। মাঝে কিছুদিন অসুখের জন্য বিরতি নিলেও, অভিনয়ের প্রতি প্যাশন তাঁকে ক্যামেরার সামনে আবার দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। আর এসবের পিছনে ছিল ঐন্দ্রিলার অফুরান প্রাণশক্তি ও মনের জোর।
অভিমন্যু মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় জি বাংলা সিনেমা অরিজিন্যালসের ‘ভোলে বাবা পার করেগা’-য় কাজ করেছিলেন। এই কাজের সূত্র ধরেই বেশ কয়েকটি সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ক্লিক-এর ওয়েব সিরিজ ‘ভাগাড়’-এ কাজ করেছিলেন ঐন্দ্রিলা। এই সিরিজে তাঁর সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন সব্যসাচীও। একটি নতুন ওয়েব সিরিজের শুটিংয়ে গোয়া যাওয়ার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু যাওয়ার আগের রাতেই অসুস্থ হয়ে পড়েন অভিনেত্রী। ফলে, সেই কাজটাও আটকে যায় সেখানেই। মাস কয়েক আগে সব্যসাচী, সৌরভ (অভিনেতা সৌরভ দাস) ও তাঁদের এক বন্ধু মিলে নতুন ক্যাফে খুলেছেন। ঐন্দ্রিলা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগের দিন ৩১ অক্টোবর ছিল সব্যসাচীর জন্মদিন। ৩০ অক্টোবর সেই ক্যাফেতেই কেক নিয়ে হাজির হয়েছিলেন তিনি। সেটাই ছিল কাছের বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ, হুল্লোড়ে কাটানো ঐন্দ্রিলার শেষ রাত।
অসম লড়াইয়ের ময়দানে প্রাণপণে মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রেখেছিলেন ঐন্দ্রিলা। ১ নভেম্বর স্ট্রোক হয় তাঁর। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। রাখতে হয়েছিল ভেন্টিলেশন সাপোর্টে। কয়েক দিন পরে অবস্থার সামান্য উন্নতি হয়। ভেন্টিলেশন থেকে বেরও করে আনা হয় তাঁকে। মনে হচ্ছিল, তাঁর অফুরন্ত প্রাণশক্তির কাছে হার মানবে ব্যাধি। ‘মিরাকল’ ঘটিয়ে ফিনিক্স পাখির মতো আবারও ফিরে আসবেন ঐন্দ্রিলা। এবারেও তাঁর সঙ্গী হিসেবে ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সব্যসাচী। কিন্তু ফুসফুসের ম্যালিগন্যান্ট টিউমার–আগের থেকেও দ্রুত বেগে ছড়িয়ে পড়ে ক্যানসার। ১৮ নভেম্বর একাধিকবার হৃদরোগে আক্রান্ত হন ঐন্দ্রিলা। তখনই বোঝা যায় এবার আর ফিনিক্স পাখি হয়ে ওঠা হলো না তাঁর।
তবু, জীবনের এই শেষ লড়াইতেও টলিপাড়ার বিশিষ্ট মানুষ থেকে আমজনতা–সকলের মধ্যেই একটা লড়াকু মানসিকতার বীজ বপন করে দিয়েছিলেন ঐন্দ্রিলা। ২৪ বছরের তরতাজা তরুণীর লড়াইকে তাই কুর্নিশ জানিয়েছেন তাঁর সহকুশীলব থেকে আমজনতা। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “ভালো থেকো ঐন্দ্রিলা। তোমার ইচ্ছেশক্তি অনুপ্রেরণা হয়ে থাকুক।” তাঁর জন্য বার্তা লিখেছেন জিৎ থেকে কোয়েল মল্লিক। টুইট করেছেন পরিচালক রাজ চক্রবর্তী। গত ২০ নভেম্বর নশ্বর দেহ ছেড়ে পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গিয়েও মানুষের মনে অমর হয়ে থাকার অমোঘ বাণী ছড়িয়ে দিয়েছেন ঐন্দ্রিলা। আর একইসঙ্গে ছড়িয়ে দিয়েছেন হার না মানার মানসিকতাকে। জীবন মানেই লড়াই, একথাকে প্রতিটি পর্যায়ে উত্তীর্ণ করেছেন তিনি। তাইতো তাঁর লড়াইয়ে সামিল ষাটোর্ধ্ব বেবি চট্টোপাধ্যায় থেকে অর্পিতা কাড়ার সহ রবি দাসের মতো সাধারণ মানুষজন। যাঁরা কোনওদিন সামনাসামনি তাঁকে দেখেননি। শুধু তাঁকে টিভির পর্দায় দেখেছেন। আর সোশ্যাল মিডিয়া ও গণমাধ্যমের সৌজন্যে শুনেছেন তাঁর হার না-মানা লড়াইয়ের কথা। তাঁদের মনেও জীবনযুদ্ধে লড়াইয়ে জিতে ফেরা যায় এই মানসিকতার বীজটুকু বপন করতে পেরেছেন ঐন্দ্রিলা। ঐন্দ্রিলার অকাল প্রয়াণে টলিপাড়ার নামী মানুষদের পাশাপাশি শোকে মুহ্যমান তাঁরাও।
অফুরন্ত প্রাণপ্রাচুর্যতায় ভরা ঐন্দ্রিলার ইচ্ছেশক্তির কাছে তাই নতজানু হতে হয়েছে ভাগ্যকেও। ‘দাদাগিরি’-র মঞ্চে ঐন্দ্রিলার পিঠে হাত রেখে যখন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন..’এত আনন্দ আয়োজন, সবই বৃথা তোমায় ছাড়া’। মনে হয়েছিল, গানের পংক্তিগুলো যেন ঐন্দ্রিলার কথা ভেবেই লেখা। সেই মঞ্চে ওই গানের সুরে তাল মিলিয়ে ঐন্দ্রিলার নাচের ভিডিও ক্লিপ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল। প্রাণশক্তির ছোঁয়ায় ভরপুর ঐন্দ্রিলা এভাবেই আজীবন স্মৃতিপটে বেঁচে থাকবেন। আর রয়ে যাবে তাঁর কথাগুলো। হাসিমুখে লড়া একটু হলেও সহজ।