অন্য ডাকঘর
হাতে হাতে স্মার্টফোন। তরুণ প্রজন্মের চোখ ইদানীং নিত্যনতুন ওয়েব সিরিজে। সারা বিশ্বের স্ট্রিমিং বিনোদন এখন হাতের মুঠোয়। সেইসব সিরিজ নিয়েই নানাকথা এই বিভাগে। হইচই চ্যানেলে দেখানো হচ্ছে ‘ডাকঘর’। লিখেছেন মৃণালিনী ঠাকুর।
ডাকঘর, পোস্টমাস্টার এই শব্দগুলো শুনলেই আমাদের বাঙালি আবেগে কোথাও একটা পৃথক অনুরণন জাগে। যদিও হোয়াটসএপ, ই-মেলের যুগে আমাদের নাগরিক যাপন থেকে প্রায় উধাও চিরন্তন ডাক ব্যবস্থা ! তা হোক। সাহিত্য, সিনেমা ও অন্যান্য ফিকশনে তার অস্তিত্ব বিদ্যমান। প্রসঙ্গত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটক ও ছোটগল্পের সৌজন্যে বিখ্যাত হয়ে আছে ‘ডাকঘর’ ও ‘পোস্টমাস্টার’। হইচই-এ প্রদর্শিত ‘ডাকঘর’ ওয়েব সিরিজেও রয়েছে একজন ‘পোস্টমাস্টার’-এর গল্প। সেটা দেখার আগে পর্যন্ত বাঙালি দর্শক বিভ্রান্ত হলেও হতে পারেন। দেখার পর যেটা অনুভূত হয়, এই মিল নিছকই কাকতলীয়। কাকতলীয় না বাণিজ্যিক অনুষঙ্গ, সে বিচার দর্শকের ওপর ছেড়ে রাখাই ভালো।
আপাতত যেটা জানার, অভ্রজিত সেন পরিচালিত ‘ডাকঘর’-এর কাহিনি লিখেছেন পদ্মনাভ দাশগুপ্ত। পদ্মনাভর কলম এর আগে বহু সফল প্রযোজনা উপহার দিয়েছে আমাদের। ‘ডাকঘর’ তারই অনুসারী হবে, প্রত্যাশিতই ছিল। সিরিজের মুখ্য তিন চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুহোত্র মুখোপাধ্যায় (দামোদর), দিতিপ্রিয়া রায় (মঞ্জরী) ও কাঞ্চন মল্লিক (মধুসূদন)। ক্রাইমের আবছায়া ইঙ্গিতে কমেডি ড্রামা ‘ডাকঘর’ স্ট্রিমিং শুরু হয়েছে গত ফেব্রুয়ারিতে। সাত পর্বের এই সিরিজের পর্বগুলির সময়সীমা ২৫ মিনিট।
গ্রামে আসে নতুন পোস্টমাস্টার দামোদর দাস। একেবারে গন্ডগ্রাম, ফলে, লোকজন ও বসবাসের ব্যবস্থাদি সবই শুরুতে দামোদরের পক্ষে প্রতিকূল হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে গ্রাম্য মানুষের হৃদয়ের উষ্ণতাও অনুভব করে দামোদর। সহজ সরল মানুষজনের সাহচর্য যেমন এক ধরনের শান্ত ও তৃপ্তিদায়ক অনুভূতি দেয় দামোদরকে, তেমনই এদের অজ্ঞতার কারণে ক্ষণে ক্ষণে নির্ভেজাল হাস্যরসের অবতারণা হয়। এই পর্যায়ে দামোদরের ভূমিকায় সুহোত্র চূড়ান্ত মানানসই হয়ে ওঠেন। তাঁর অভিব্যক্তি, সংলাপ কথন, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ চমৎকার প্রতিভাত করে দামোদরকে।
হাস্যরসের পাশাপাশি কিছুটা রহস্যও দানা বাঁধে ‘ডাকঘর’-এ। দামোদরের অতীত ঘিরে রয়েছে সেই রহস্য, যার আবরণ উন্মোচন করতে বদ্ধপরিকর দামোদর। সবার ওপরে রয়েছে মঞ্জরীর সঙ্গে দামোদরের প্রেম। অনুচ্চারিত অনুভূতি দুজনেই শুরুর দিকে বয়ে বেড়ায়। তাদের মধ্যে কথার থেকেও অনুভূতি বিনিময় হয় বেশি। দিতিপ্রিয়া এই সময়ের সম্ভাবনাময় অভিনেত্রীদের অন্যতম। তাঁর মঞ্জরীকে সহজেই ভালো লেগে যায়।
তবে, এই সিরিজের অন্যতম আকর্ষণ নিঃসন্দেহে কাঞ্চন মল্লিক। বাংলা বিনোদনে কাঞ্চন আজ এক অপরিহার্য নাম। তিনি থাকা মানেই দর্শকের বিনোদনের ভাঁড়ার পূর্ণ হয়ে ওঠা। গ্রামের একটি সরস চরিত্র মধুসূদন। প্রতি দৃশ্যে নিজেকে একজন গ্রামের মানুষ রূপে নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলেন কাঞ্চন। দামোদরকে গ্রাম জীবনে অভ্যস্ত করে তোলার ক্ষেত্রে মধুসূদন সাহায্য করার আন্তরিক চেষ্টা করে। আর এই প্রেক্ষিতেই হাসির এক একটি চরম মুহূর্ত তৈরি হয়, যা কাঞ্চনের সাবলীল অভিনয় ছাড়া সম্ভব ছিল না। দুজনের কথোপকথনে ছোট ছোট সংলাপে এমন সব মজা জন্ম নেয়, যা দর্শককেও সহজেই সম্পৃক্ত করে নেয় বিষয়ের সঙ্গে।
দামোদরের যে শৈশব স্মৃতি তাকে তাড়া করে বেড়ায়, তার উৎসের খোঁজ বাকি গল্পের সঙ্গে সমান্তরালে চলতে থাকে। এই বিষয়টির উপস্থাপনা কোথাও হাসি-মজার বাতাবরণে আরোপিত মনে হয়। এর বাইরে ‘ডাকঘর’ বেশ উপভোগ্য এক সিরিজ। মুখ্য তিন অভিনেতা ছাড়া বাকিরাও চরিত্রানুগ। টানটান চিত্রনাট্য সিরিজকে গতিশীল রাখে। গ্রামের পরিবেশ সৃষ্টিতে লোকেশন ও সেট ডিজাইন সহায়ক হয়। পর্বগুলি দীর্ঘ সময়ব্যাপী না হওয়ায়, দেখার আগ্রহ সম্পূর্ণ মাত্রায় টিকে থাকে। সব মিলিয়ে এই ‘ডাকঘর’-কে বেশ আকর্ষণীয় বলা যায়।