Monday, February 3, 2025
বিনোদন প্লাস স্পেশাললাইম-Light

আপনি থাকবেন ইরফান

প্রতিটি জন্মদিনই কী আসলে একটু একটু করে মহাশূন্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া ? জীবিত অবস্থায় শেষ জন্মদিন পালিত হলো ২০২০-এর ৭ জানুয়ারি। তখনই কী লেখা হয়ে গেছিল এপ্রিল মাসের ২৯ তারিখের বিদায়লগ্নের বার্তা ? উত্তরের খোঁজে উথালপাথাল ঢেউ তাঁর তামাম অনুরাগী মহলে। উত্তর মেলে না, বছর পার হয়ে যায়। আজ তাঁর আর একটি জন্মদিন। ভারতীয় সিনেমায় নিজের অপরিহার্যতা প্রমাণ করে গেছেন তিনি। এরই পাশাপাশি ব্রিটিশ ও আমেরিকান সিনেমাতেও ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন ইরফান।

রাজস্থানের টঙ্কের সাহাবজাদে ইরফান আলি খান কেমন করে দেশের অন্যতম বৃহৎ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির  ইরফান খান হয়ে উঠলেন, সে ইতিহাস শুধুই উত্তরণের

Images 10

রূপকথা ছিল না। ছিল কঠিন ও অদম্য লড়াইয়ের এক চিত্রনাট্য। বাবার ছিল টায়ারের ব্যবসা। অভিনয়ের জিন ইরফানের রক্তে আসে মামাবাড়ির সূত্রে। শৈশব কাটে টঙ্কেই। পরে জয়পুর আসেন তিনি। তবে, শুরুতে ইরফানের প্রতিভার ঝলক চোখে পড়ে ক্রিকেটে। দেশের প্রথম সারির ক্রিকেট দলে খেলার সুযোগ পেয়েও ভাগ্যে ঘটেনি তাঁর। যাতায়াতের খরচ যোগাড় করতে পারেনি ইরফানের পরিবার। তাঁর ভক্তরা হয়তো ইরফানের ক্রিকেট কেরিয়ার না গড়তে পারাকে সাধুবাদই দেবেন। যে ইরফানকে পরে আমরা পেলাম, সেও বোধহয় ভাগ্যেরই খেলা। শতাব্দীতে এমন একজন বহুমুখী প্রতিভাবান অভিনেতা তো ভাগ্যেই মেলে–সিনেমাপ্রেমী মানুষের ভাগ্য !

যোধপুর নিবাসী এক মামার সুবাদে প্রথম থিয়েটার জগতের মহার্ঘ পর্দা উঠলো ইরফানের জীবনে। তিনি যেন মনে মনে এই মুহূর্তটিরই অপেক্ষা করছিলেন। ক্রমশ থিয়েটার জগতের কিংবদন্তী মানুষজনের সংস্পর্শে আসা এবং খাতায় নাম লেখানো। যোধপুর শহরের বিভিন্ন মঞ্চে অভিনয় করার পর, অভিনয়ই প্যাশন হয়ে উঠলো তাঁর। দিল্লীতে ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা-য় যোগ দিলেন ইরফান–সেটা ১৯৮৪ সাল। এরপর মুম্বই যাত্রা। মুম্বইয়ে আসার পর শুরু হলো নতুন যুদ্ধ। অভিনয়কে পুরোমাত্রায় পেশা হিসেবে নিতে পারেননি তখনও। চাকরি করছেন একজন এয়ার কন্ডিশনার রিপেয়ারম্যান হিসেবে। সেই সময় ওই কাজেই তাঁর আইডল রাজেশ খান্নার বাড়িতে গেছেন ইরফান। পরে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন নিজের অনুভূতির কথা– “রাজেশ খান্নাকে নিয়ে যে ক্রেজ ছিল তাঁর ভক্তদের মধ্যে, তা এর আগে দেখেনি বলিউড। উনি ছিলেন প্রকৃত একজন স্টার। স্টারডম কী, সেটা নিজের আইডলকে দেখে অনুভব করি সেদিন। এটা একটা অদ্ভুত অনুভূতি। ভাবাবেগে রুদ্ধ, যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলার মতো একটা ব্যাপার।”

১৯৮৮ সালে মীরা নায়ারের ‘সালাম বম্বে’ ছবিতে ছোট এক চরিত্রে প্রথম সুযোগেই নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন ইরফান। কিন্তু তাতে কাজ হয় না। হাতে এনএসডি-র ডিগ্রি, টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া-র ছাত্রছাত্রীদের ছবিতে অভিনয় ছাড়া এক অন্তহীন লড়াই তখন ইরফানের নিত্যসঙ্গী। প্রথম বড় ব্রেক এলো ব্রিটিশ ছবি ‘দ্য ওয়ারিয়র’-এর হাত ধরে। হিন্দী ছবি ‘হাসিল’ প্রথম বলিউডি দর্শকের কাছে পৌঁছে দিল ইরফানকে। আর জয়যাত্রা শুরু হয়ে গেল ‘মকবুল’ থেকে। বিশাল ভরদ্বাজের এই ছবি সব অর্থেই ব্যতিক্রমের ঢেউ তুলেছিল হিন্দী ছবির জগতে, যার অন্যতম সেরা প্রাপ্তি ছিল ইরফানের অত্যন্ত শক্তিশালী অভিনয়। ইরফানের পরের ছবি ‘ দ্য নেমসেক’। এই ছবির জন্য ‘Independent Spirit Award for Best Supporting Male’ পুরস্কারের জন্য নমিনেটেড হন তিনি। এই ছবিকে কেন্দ্র করে এই প্রতিবেদকের কিছু অমূল্য ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আছে। সেই গল্প পরে। তার আগে ইরফানের আরও কিছু ছবির নাম পাঠককে স্মরণ করাতে চাই।

২০০৭ থেকে ২০২০ পর্যন্ত ভারতীয়, ব্রিটিশ ও আমেরিকান সিনেমায় যে অবদান রেখেছেন, তা বিস্ময়কর। পাঠক নিশ্চয়ই জানেন নামগুলো–তবু, সেই না ভোলা কয়েকটি ছবি হলো–লাইফ…ইন আ মেট্রো, পান সিং তোমর, দ্য লাঞ্চবক্স, পিকু, তলোয়ার, হায়দর, গুন্ডে, বিল্লু, হিন্দী মিডিয়াম, কমলা কি মউৎ, এক ডক্টর কি মউৎ, লাইফ অফ পাই, স্লামডগ মিলিয়নেয়ার, জুরাসিক ওয়ার্ল্ড, এমেজিং স্পাইডারম্যান, ইনফার্নো থেকে শেষ ছবি আংরেজি মিডিয়াম। বলা বাহুল্য,  প্রত্যেকটি ছবিতেই স্বতন্ত্র ইরফান। অত্যন্ত রিয়ালিস্টিক, মেধাবী, সংবেদনশীল, শক্তিশালী এবং আকর্ষণীয় অভিনয়ের এক ধারা তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন হিন্দী ছবির দুনিয়ায়, যার উত্তরাধিকার খুঁজে বের করা শক্তই বলা যায়। অভিনয়ের এই ব্যাপ্তির জোরেই আন্তর্জাতিক সিনেমার বিশাল পটভূমিতে নিজের অপরিহার্যতা প্রমাণের দিকে এগোচ্ছিলেন ইরফান। তাঁর অসময়ে চলে যাওয়া তাই শুধু ভারতীয় সিনেমা নয়, বিশ্বের সিনেমাশিল্পের ক্ষতি বলা যায়।

সত্যি বলতে কী, ইরফানের মূল্যায়ন এই ছোট্ট লেখার পরিসরে করাটা প্রায় অসম্ভব ! পাঠককে অনুরোধ, পারলে গুগলে ওঁর কাজের খতিয়ানটা দেখবেন। এই প্রতিবেদন লিখতে গিয়ে আমারই খেই হারিয়ে যাওয়ার যোগাড়, কোনটা ছেড়ে কোনটা নিয়ে ভাববো! উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না, এই সমস্ত কাজই, বলিউডের নেপোটিজম, লবিবাজির মধ্যেই করে গেছেন ইরফান। ওঁর জন্য পথের কোথাও ফুল বিছানো ছিল না। মধ্যবিত্ত একটি পরিবার থেকে আসেন। প্রতিভা, শিক্ষা ও অভিনয়ের প্রতি চরম প্যাশন তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিল সাফল্যের চূড়ায়। বড়-ছোট সব ব্যানারে, হাই থেকে লো বাজেট, বাণিজ্যিক হোক বা সমান্তরাল–ইরফান প্রত্যেকবার দেখিয়েছেন তাঁর কামাল করা অভিনয়। মাফ করবেন পাঠক, সব বড় স্টার থেকে বড় অভিনেতা, বহু হাতড়েও ঠিক ইরফানের মাত্রায় ব্যপ্তি খুঁজে পাচ্ছি না এই মুহূর্তে।

Images 12

সিনেমা ছেড়ে একটু টেলিভিশনে চোখ রাখা যাক। দূরদর্শনে ‘লাল ঘাস পর নীলে ঘোড়ে’-তে লেনিন চরিত্রে, ‘ডর’-এ সাইকো কিলার, উর্দু কবি ও মার্ক্সবাদী এক্টিভিস্ট মখদুম মহিউদ্দিনের চরিত্রে ‘কাহকাশান’ সিরিজে অভিনয়, চাণক্য, চন্দ্রকান্তা, দ্য গ্রেট মারাঠা থেকে শ্যাম বেনেগলের ‘ভারত এক খোঁজ’ ও এইচবিও-তে প্রদর্শিত সিরিজ ‘ইন ট্রিটমেন্ট’! ব্যপ্তি ও বিস্তারটা অবিস্মরণীয়। শাহরুখ খান ইরফানের সঙ্গে ‘বিল্লু’ ছবিতে অভিনয় করাকালীন বলেছিলেন, ইরফানের সঙ্গে এক ফ্রেমে থাকলে অভিনয়টা অনেক বেশি মন দিয়ে করতে হয়। আর ‘স্লামডগ মিলিওনেয়ার’-এ ইরফানের অভিনয় দেখার পর স্বয়ং ড্যানি বয়েল বলেন, “he has an instinctive way of finding the ‘moral centre’ of any character, so that in Slumdog, we believe the policeman might actually conclude that Jamal is innocent.” বয়েল ইরফানকে একজন অ্যাথলিটের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, যে প্রত্যেকবার একই মাত্রায় ‘মুভ’ করতে পারেন, এতটাই নিখুঁত তাঁর ধারাবাহিকতা। শেষ করবো ব্যক্তিগত এক অনবদ্য অভিজ্ঞতার ঝলকে। তাজ বেঙ্গলে ‘নেমসেক’ ছবির প্রমোশন উপলক্ষে সাংবাদিক সম্মেলন চলছে। দীর্ঘদেহী, মেরুদন্ড সোজা করে চলা একজন মানুষকে দেখেছিলাম সেদিন। এক বঙ্গতনয়া তাঁর ঘরণী, সে কথা জানা ছিল না তখনও। সেটার উল্লেখ সেদিন ছিল কিনা, আজ আর তত মনে নেই। তবে, সাংবাদিক সম্মেলনে কলকাতা ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও আগ্রহ প্রতিভাত ছিল বক্তব্যের অনেকটা জুড়ে। প্রথামাফিক জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব মিটতেই মঞ্চ ছেড়ে নেমে এলেন। নিজেকে মিশিয়ে দিলেন মানুষের মাঝে। জনসংযোগ নয়, একেবারে সাধারণের মতো করেই মানুষের কাছে পৌঁছানো। মুখে পরিচয়ের হাসি। চোখাচোখি হলে বার্তা বিনিময়। ইরফান খান যে এদেশের যে কোনও অভিনেতার তুলনায় সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী, সেটা সেদিন বুঝেছিলাম। সেই অনুভব নিয়েই এ প্রতিবেদন শেষ করবো। মনেপ্রাণে ইতিবাচক ভাবনার একজন মানুষ ছিলেন ইরফান। ওঁর চলে যাওয়া বড় বেদনার মতোই বেজে চলবে আমাদের হৃদয়ে। কিন্তু মননে ও চেতনায় থাকবে ইরফানের সেরিব্রাল অভিনয়, যা তিনি মূল্যবান উপহারস্বরূপ দিয়ে গেছেন বিশ্বের তামাম সিনেমা দর্শককে।