আমাদের কিশোর আমাদের কৈশোর
জীবনমরণের সীমানা ছাড়িয়ে ওঁরা আজ বহু আলোকবর্ষ দূরের এক জগতে। তবু আছেন ওঁরা আমাদের মাঝে। থাকবেন চিরদিন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সিনেমা জগতের সেইসব মানুষ, যাঁদের অবদান ছাড়া অসম্পূর্ণ আমরা। তাঁদের নিয়েই এই বিশেষ কলম। আজ থেকে শুরু হলো কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী কিশোরকুমার কে নিয়ে লেখা ধারাবাহিক রচনা। লিখেছেন অজন্তা সিনহা।
সালটা ১৯৬৭, সেটা গুগল দেখে জানলাম। আমাদের বালিকা বয়সে সাল-তারিখের খবর রাখার অত রেওয়াজ ছিল না। যে বছরটা আসতো, তাতেই বাঁচতাম। আগে-পরের ঠিকানা থাকতো না। তবে, মনে যা দাগ কাটতো, তার স্মৃতি অবশ্যই থেকে যেত। এই রচনা যখন লিখছি, সেদিনের পর আজ, মাঝে কয়েকটা যুগ পার হয়ে গেছে। ঘটনা মনে থাকলেও সাল-তারিখ ভুলে গেছি। বলা বাহুল্য, আমাদের চারপাশের পরিবেশটা তখন অন্যরকম ছিল। জাগতিক যা কিছু, বড়ই আড়ম্বরহীন, সরল ও সাদামাটা। আয়োজন কম ছিল–যাপন থেকে শিল্পসংস্কৃতি, সব ক্ষেত্রেই। শুধু মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কটা বড় নিবিড় ছিল।
এমনই নিবিড় ও মগ্ন এক সময়ে আমার সম্পর্কিত এক কাকা, তিনি সারাক্ষণই গুনগুন করে বাংলা ও হিন্দি আধুনিক এবং সিনেমার গানের সুর ভাজতেন। যাকে নিতান্তই বাথরুম সিঙ্গার বলা যায়। কিন্তু একটা বৈশিষ্ট্য ছিল, নতুন গান বাজারে এলেই সেটা নিয়ে মেতে যেতেন তিনি। সেই প্রথম শুনি ‘ইয়ে দিল না হোতা বেচারা…’! তাঁর কাছেই জানলাম, এটা ‘জুয়েল থিফ’ ছবির গান, কিশোরকুমার গেয়েছেন। কিশোরকুমারের নামটা শোনা ছিল, এই পর্যন্ত। আমাদের সময়ে রেডিও একমাত্র মাধ্যম গান শোনার। আমাদের বাড়িতে সেটাও তখন ছিল না। কিন্তু ওই একটা গানের গুনগুনানি শুনে আমার মধ্যে অদ্ভুত একটা প্রতিক্রিয়া হলো। তখনও কিশোরের নিজের কণ্ঠে গানটা শোনা হয়নি। তারপর একদিন এক বিয়েবাড়িতে কিশোরকুমারের কণ্ঠে গানটা শুনলাম এবং ফিদা হয়ে গেলাম। মাফ করবেন পাঠক, এর থেকে যুৎসই বাংলা প্রতিশব্দ পেলাম না।
একটু বড় হবার পর মেলামেশার পরিধি বাড়লো। এরইমধ্যে কিশোরকুমারকে আরও শোনা হয়ে গেছে। ক্রমশ সেটা একটু বেশিমাত্রায় শুরু হলো–বাড়ির রেডিও, পাড়ার পুজো প্যান্ডেল থেকে বিয়েবাড়ি–আমি পাগল হয়ে গেলাম। আর কোনও পুরুষকণ্ঠের গান শুনতে আর ইচ্ছে করতো না তখন। কথাটা সবাইকে মাথায় রেখেই বলছি। গানবাজনা শেখার পালা শুরু হয়নি। রবীন্দ্রসংগীত শুনতাম না। কিশোরকুমার ছাড়া আর কিছু শুনতে ভালো লাগতো না। অথচ সময়টা সাতের দশক। বাংলা-হিন্দি মিলিয়ে রমরমা স্বর্ণযুগ–কী বেসিক, কী সিনেমার গান। ঘরে ঘরে রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি ও অন্যান্য বাংলা গানের চর্চা। আর অসাধারণ এক একজন শিল্পী। কিন্তু না। আমি একেবারে নিবেদিত। আর কেউ নয়, আর কেউ নেই। একেবারেই ছেলেমানুষি-বেলা ছিল সেটা। ভাবনার গতিপ্রকৃতি বড্ড একমুখী থাকার একটা সময়। তাই বলে ভাববেন না, এই ষাটোর্ধ্ব বয়সে পৌঁছে এতটুকু পাল্টেছি আমি। কিশোরপ্রেম কমেনি। এটা ঠিক সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিণতমনস্কতা থেকেই অন্য গুণী শিল্পীদেরও গ্রহণ করার মানসিকতা তৈরি হয়েছে।
আমার পরিবার রক্ষণশীল না হলেও বাড়ির মেয়ে সারাদিন হিন্দি বা আধুনিক গান শুনবে, সেখানে একটা বাঁধনের চেষ্টা ছিল। অন্যদিকে পরিবারের মধ্যেই গানের চর্চা ছিল চূড়ান্ত পর্যায়ে। প্রায় সকলেই জন্মগতভাবে সুকণ্ঠের অধিকারী ছিল। পারিবারিক কোনও অনুষ্ঠান মানেই গানের আসর বসবে। প্রথাগতভাবে গুরুর কাছে বসে প্রশিক্ষণ সেভাবে কেউ নেয়নি–সকলেই শুনে শুনে। তাদের মধ্যে আমিও একজন। মনে আছে, কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি তখন। অফ পেলেই বন্ধুরা টেনে নিয়ে চলে যেত লেডিস কমনরুমে, শোনাতে হতো কিশোরকুমারের গান। ছেলেরা বাইরে থেকে চেঁচিয়ে বলতো, আমরাও শুনবো, তুই ক্যান্টিনে চল।
এরপর কিছুদিন দু’জায়গাতেই ওইসব কান্ড চলছে। এমন সময়ে কলেজে আয়োজিত হলো রবীন্দ্রসংগীত প্রতিযোগিতা। বন্ধুরা জোর করে নাম দিয়ে দিল। তখনও আমি গান শেখা শুরু করিনি। রবীন্দ্রসংগীত গাইতে তো মোটেই পছন্দ করি না। গাইতেও পারি না। ঠেলেঠুলে পাঠালো বটে বন্ধুরা, তবে, প্রতিযোগিতার আশানুরূপ ভাবেই দ্বিতীয় হলাম আমি। পুরস্কার ছিল শুধু প্রথম যে হবে তার জন্য। আমার হেলদোল নেই। আমি তো গাইতেই চাইনি। কিন্তু গাইলাম একদিন। আর ছাড়তে পারলাম না। জানলাম, রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়া আমার ডেসটিনি। পরে সেটা যাপনের অঙ্গ হয়ে যাবে। জীবনভাবনা নিয়ন্ত্রিত করবে রবীন্দ্রসৃষ্টির সমুদ্রসম সম্ভার। তারপর একদিন তো কিশোরকুমারের কণ্ঠেও রবীন্দ্রসংগীত শুনলাম। সে প্রসঙ্গে পরে যাব।
যাই হোক, পারিবারিক এমনই এক আসরে আমার এক খুড়তুতো দাদা, সে গান শেখার সুযোগ পায়নি, কিন্তু খুব ভালো গায় শুনেছিলাম আত্মীয়মহলে। আমার কিশোরভক্তির চরম দিনে সেই দাদা একবার এলো আমাদের বাড়ি। সাবলীল, সুরেলা ও আবেদনময় কণ্ঠ–সঙ্গে বিস্তৃত রেঞ্জ তার। সবগুলি সপ্তকে অনায়াস যাতায়াত। এই ব্যাকরণগত বিষয়টি অবশ্যই তখন জানতাম না। নিজে গানের প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করার পর বুঝেছি। একটা সন্ধ্যা আমরা ভেসে গেলাম কিশোরকুমারের গানে। প্রচুর নতুন গান শুনলাম ওই দাদার কাছে। ওরা গিরিডি থাকতো। স্বভাবতই চমৎকার হিন্দি উচ্চারণ। পরিস্থিতির কারণেই কিশোরকুমারের নিজের কণ্ঠে গাওয়া গান খুব বেশি শোনার পরিস্থিতি তখনও আমার জীবনে ঘটেনি। ক্বচিত রেডিওতে বা দূর থেকে ভেসে আসা মাইকে। রেকর্ড এসে থাকলেও আমার বাড়িতে সেই সেটআপ ছিল না। ক্যাসেটের যুগ তো অনেক পরে।
নানা ধরণের ও বিভিন্ন শিল্পীর গান শোনার অভ্যাস, প্রযুক্তির আশীর্বাদ, নিজের গানের জগতে আসা–এইসব পর্যায়ক্রমে ঘটতে লাগলো গতানুগতিক নিয়মে। কিশোরকুমারের প্রতিটি গান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ শুধু নয়, তাঁর পারিবারিক পরিচয়, জীবনযাপন–সবকিছু নিয়েই আগ্রহ বাড়লো। মোহমুগ্ধতা কেটে গিয়ে তখন ওঁকে জানার কৌতূহল বাড়ছে। কিছুটা বিশ্লেষণী মনোভাবাপন্নও হচ্ছি ধীরে ধীরে। এক বিরল প্রতিভার অধিকারী এক শিল্পী, ব্যক্তিগত দিক থেকে অপরিসীম আবেগপ্রবণ। একদিকে এই ‘আবেগ’ শব্দটাই তাঁর গান ও জীবন ঘিরে প্রবলবেগে আবর্তিত। অন্যদিকে তিনি যেন সমাজ-সংসারে থেকেও এক জন্ম সন্ন্যাসী–উদাসীন, নিরাসক্ত। তাঁর চরম রোমান্টিক গানগুলোয় ভাবাবেগে ভেসে যাওয়া–শিল্পী ও শ্রোতা উভয়েই। যে গানগুলি বিরহের, চূড়ান্ত দার্শনিক ভাবনার, সেখানে তিনি যেন এমন এক নির্জনবাসী, যেখানে কিছুতেই পৌঁছনো যায় না। মানুষটাকে ছোঁয়া যায় না, তাঁর এই অধরা অস্তিত্বই সম্ভবত দ্বিতীয় স্ত্রী মধুবালাকে বারবার নিরাপত্তাবোধের অভাবে আক্রান্ত করেছে। সঙ্গে শারীরিক কঠিন রোগ তো ছিলই। কিশোরকুমারের জীবন ও গান কোথায় পেশাদারিত্বের চরম দৃষ্টান্ত আর কোথায় কিশোরসুলভ পাগলামির ফসল, সে প্রসঙ্গে যাব। তার আগে একটু অন্য কথা–দুই কিশোরভক্তের গল্প–তোলা রইলো পরের সপ্তাহের জন্য। (চলবে)