Monday, February 3, 2025
তবু অনন্ত জাগে

আমাদের কিশোর আমাদের কৈশোর

জীবনমরণের সীমানা ছাড়িয়ে ওঁরা আজ বহু আলোকবর্ষ দূরের এক জগতে। তবু আছেন ওঁরা আমাদের মাঝে। থাকবেন চিরদিন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সিনেমা জগতের সেইসব মানুষ, যাঁদের অবদান ছাড়া অসম্পূর্ণ আমরা। তাঁদের নিয়েই এই বিশেষ কলম। পড়ছেন কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী কিশোরকুমার কে নিয়ে লেখা ধারাবাহিক রচনা। লিখছেন অজন্তা সিনহা। আজ ষষ্ঠ পর্ব।

তাঁর সময়ে বলিউডের প্রায় সব গীতিকার-সুরকারদের সঙ্গে কাজ করেছেন কিশোর। গেয়েছেন প্রায় সব নায়কের লিপে। গীতিকারদের মধ্যে মজরুহ সুলতানপুরী, আনন্দ বকশী, গুলজার, অনজান, ইন্দিবর, নীরজ, সাহির লুধিয়ানভি, হসরত জয়পুরী, গুলশান বাওরা, নিদা ফজলি, যোগেশ, নকশ লালপুরী, শৈলেন্দ্র, রাজেন্দ্র কিশান, জাভেদ আখতার, অমিত খান্না প্রমুখের লেখা এক একটি রত্নখচিত সম্ভার উপহার দিয়ে গেছেন তিনি আমাদের। এই পর্যায়ে সবশেষে একটি ছবির উল্লেখ করবো, যেটা ছাড়া এ প্রতিবেদন অসম্পূর্ণ। গুলজার-পঞ্চম-কিশোরের ত্রিবেণী সঙ্গমে অতুলনীয় ‘আঁধি’ ছবির গান। কথা-সুর-গায়নে যা চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে হিন্দি সিনেমা সংগীত শ্রোতার কানে।

বাংলা ছবির গানেও কিশোরকুমারের অবদান অবিস্মরণীয়। এক্ষেত্রে মাত্র কয়েকটি গানের উল্লেখ যথেষ্ট। শ্রোতারা চিরদিন মনে রাখবেন এমন কিছু গান– এ আমার গুরুদক্ষিণা, চিরদিনই তুমি যে আমার, যে ফুল ঝরে না কোনোদিন, ওপারে থাকবো আমি, এ তো কান্না এ তো নয় গান, হয়তো আমাকে কারও মনে নেই, আজ মিলনতিথির পূর্ণিমা চাঁদ, ভালোবাসা ছাড়া আর আছে কি, এক টানেতে যেমন তেমন, এক পলকে একটু দেখা, কারো কেউ নয় তো আমি, আধো আলোছায়াতে, আরো কাছাকাছি, এ কি হলো, কি আশায় বাঁধি খেলাঘর, ও বাবু যতই তোমরা, দুজনাতে লেখা গান, তুমি আমার আশা, যে কথা মনের কথা, শোনো শোনো গো সবে শোনো দিয়া মন, ওগো নিরূপমা, কি উপহার সাজিয়ে দেব, আমার নাম এন্টনি, এই তো জীবন, আমি যে কে তোমার, তোমার বাড়ির সামনে দিয়ে, কথা দিলাম, আমার স্বপ্ন তুমি ওগো, আজ এই দিনটাকে…!

Images 18
আমাদের কিশোর আমাদের কৈশোর 12

বাংলা ছবিতে তাঁর গানের সংখ্যা হিন্দির তুলনায় কম। তার মধ্যেই অজয় দাস, আর ডি বর্মণ, বাপি লাহিড়ী, শ্যামল মিত্র প্রমুখের সুরে যে গানগুলি গেয়েছেন তিনি, সেসবও বৈচিত্রে-বৈভবে অসীম। প্রতিটি গানে বাংলার স্বতন্ত্র আবেগ ও ব্যঞ্জনা স্পষ্ট। উত্তমকুমার, মিঠুন চক্রবর্তী, চিরঞ্জিত, তাপস পাল, প্রসেনজিৎ–কে নেই তালিকায়, যাঁর লিপে গাননি তিনি ! সবশেষে দুটি  গান পৃথকভাবে উল্লেখের দাবি করে –’নাম আমার কিশোরকুমার গাঙ্গুলি’ আর ‘সিং নেই তবু নাম তার সিংহ’। প্রথমটি পুজোর গান, সুরসৃষ্টি করেছিলেন অমিতকুমার। দ্বিতীয়টি ‘লুকোচুরি’ ছবির। এই ছবিরই আর একটি গান ‘এই তো হেথায় কুঞ্জছায়ায়’, ডুয়েট গেয়েছিলেন রুমা গুহঠাকুরতার সঙ্গে, যার প্রচুর রিমেক হয়েছে। এই ছবির গান লিখেছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। সুরকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সুর আর ছন্দ নিয়ে কোন পর্যায়ের পরীক্ষানিরীক্ষা তিনি নিজেকে নিয়ে নিজে করেছেন বা তাঁকে নিয়ে তাঁর সমসাময়িক স্রষ্টারা, ভাবুন একবার !

বাংলা আধুনিকে কিশোরের হিট গানের সংখ্যা রীতিমতো ঈর্ষণীয়। তার কয়েকটির উল্লেখেই শ্রোতার মন ময়ূরের মতো নেচে উঠবে জানি। কয়েকটি দশক ধরে প্রতি বছর পুজোর বাংলা গানের জন্য আমাদের যে অপেক্ষা থাকতো, সেখানে কিশোরকুমার প্রথম সারিতেই থাকতেন। তাঁকে ঘিরে নিপাট বাঙালি শ্রোতার আগ্রহ বাড়িয়ে তুলেছিল যে গানগুলি–তোমায় পড়েছে মনে, মন জানালা খুলে দে না, আজ থেকে আর ভালোবাসার নাম নেব না আমি, সে যেন আমার পাশে, নয়ন সরসী কেন, আমি নেই ভাবতেই ব্যাথায়, একদিন পাখি উড়ে, আকাশ কেন ডাকে, এই যে নদী যায় সাগরে, আমার পূজার ফুল, চোখের জলের হয় না কোনো রং, আজ থেকে আর ভালোবাসার, চলো যাই চলে যাই দূর বহুদূর, সে তো এলো না, সেই রাতে রাত ছিল পূর্ণিমা, হাওয়া মেঘ সরায়ে, আমার মনের এই ময়ূরমহলে এবং আরও অনেক। বাংলা ও মুম্বইয়ের সমস্ত প্রথম সারির গীতিকার ও সুরকাররা তাঁকে চাইতেন। তিনিও তাঁদের নিরাশ করেননি। গুনী স্রষ্টাদের সৃষ্টিকে কণ্ঠে ধারণ করে তাতে প্রাণদান করেছিলেন কিশোর। সেই দান ব্যর্থ হয়নি।                 (চলবে)

  • ছবি সৌজন্যে : গুগল