ইতিহাসের গন্ধমাখা পেডং
দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম। লিখছেন অজন্তা সিনহা।
উত্তরবঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার একেবারে শুরুর দিকে আমি সিলেরি গাঁও আর পেডং একসঙ্গে গেছিলাম। দুটো জায়গাতেই আমারও সেটা প্রথমবার যাওয়া। সিলেরি গাঁও খুবই সুন্দর। কিন্তু কলকাতার একটা টিম এসে পরিবেশ একেবারে নয়ছয় করে দেয়। যে হোমস্টে-তে আমি ছিলাম, তার সমস্ত অতিথিই অত্যন্ত বিরক্ত হয় ওই দলটির ব্যবহারে। যাই হোক, তাদের সেসব কর্মকান্ডের বিস্তারে না গিয়ে বলবো, সিলেরি গাঁও দু-রাত্তির থাকার পর পেডং এসে শান্তির নিশ্বাস ফেলেছিলাম। সেই অপরূপ শরতে এই পাহাড়ী জনপদ এক লহমায় আমায় কাছে টেনে নিয়েছিল। পেডং তারপর অনেকবার গেছি। সিলেরি গাঁও-ও গেছি, তবে থাকিনি–ওই পেডং থেকেই গিয়ে ঘুরে এসেছি।
পেডংয়ে বারবার যাবার অনেকগুলি কারণ ছিল। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য –প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং অবশ্যই পূর্ণ তামাং বলে মানুষটি। প্রথমবার ওঁর হোমস্টে-তেই উঠেছিলাম। আজও পর্যন্ত পেডং গেলে, পূর্ণজির কাছেই থাকি। এত যত্ন, এত আন্তরিকতা–নিঃসন্দেহে ঘরের বাইরে ঘর বলতে পারি ওঁর হোমস্টে-কে। মনে পড়ছে, আমার উত্তরবঙ্গ বেড়াতে যাওয়ার নানা স্মৃতি। সারাদিন অফিস করে, রাতের ট্রেনে উঠে নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছে বিভিন্ন স্পটে বেড়াতে যেতাম। পেডংয়ের ক্ষেত্রে একটা মজার ব্যাপার হতো। স্টেশনে নেমেই পূর্ণজিকে ফোন করে বলতাম, লাঞ্চ রেডি করতে। আর পেডং পৌঁছে স্নান সেরে ফ্রেশ হয়েই লাঞ্চ–গরম গরম ভাত, ডাল, ডিমের কারি আর আলুর চোখা! আহ,ওই সাদামাটা পদই যেন অমৃত মনে হতো। আদতে পূর্ণজির হাতের রান্নার স্বাদ আমি আজ পর্যন্ত উত্তরবঙ্গের আর কোথাও পাইনি। থাকা-খাওয়া নিয়ে পরে আবার আলোচনায় যাব। এবার পেডং প্রসঙ্গে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছাড়াও পেডং ঐতিহাসিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। উত্তরবঙ্গ আর সিকিমের বর্ডারে অবস্থিত পেডং প্রাচীন সিল্ক রুটের প্রবেশপথ। এছাড়াও এখানে রয়েছে অঞ্চলের সবচেয়ে পুরোনো গুমফা, গির্জা এবং একটি দুর্গের ধ্বংসাবশেষ। এসবের পাশাপাশি আর একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য ইতিহাস রয়েছে পেডং-এর। এবার সেই ইতিহাসেরই তত্ত্বতালাশ। অনেকেরই ধারণা, ব্রিটিশরাই এদেশে চা শিল্পের পত্তন করে। কিন্তু না। ব্রিটিশরা এদেশে আসার অনেক আগেই ভারতের কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে ‘চা’-কে গুরুত্বের কেন্দ্রে নিয়ে আসে চিনেরা, যা গড়ে ওঠে এই অঞ্চলকে ঘিরেই। সেই সময় এদেশে চা পানের ব্যাপারটা স্বল্প সংখ্যক মানুষের বিলাসিতা হলেও, তাদের জীবনযাপনে চায়ের ভূমিকা ছিল অসীম। অর্থাৎ চাহিদাটা তীব্র ছিল। শুধু তাই নয়, ক্রমশ একটা সময় সাধারণ মানুষের মধ্যেও চা পানের অভ্যাস বাড়তে শুরু করলো।
সেই সময় চা পাতার আমদানি হতো চিন দেশ থেকে। প্রাচীন সিল্ক রুট ধরে চা ব্যবসায়ীরা আসতেন। একটা সময়ের পর দূরত্ব ও দুর্গমতার কারণে সেই ব্যবসায়ীদের কাছে বিষয়টা ‘ঢাকের দায়ে মনসা বিকিয়ে যাওয়া’র মতো হলো। দীর্ঘ পথ ধরে মালবাহী গাড়ি, পশুযান বা মানুষের পিঠে চাপিয়ে আনার যে প্রক্রিয়া, সেটাও কোনও এক সময় বাস্তবের পক্ষে প্রতিকুল বলে উপলব্ধ হলো। আর এই জায়গা থেকেই এদেশে চা উৎপাদনের ভাবনার উন্মেষ। চিন থেকে আমদানীকৃত চা প্রথমে পৌঁছোত উত্তরবঙ্গের ছোট্ট পাহাড়ী শহর কালিম্পঙে। প্রসঙ্গত, সেই সময় কালিম্পং-কে কেন্দ্র করে চিন, তিব্বত, নেপাল, ভুটান, বার্মা ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। চা পাতা আমদানি ও সরবরাহও তার অন্যতম অঙ্গ ছিল।
অসুবিধা, বাধাবিপত্তি, দীর্ঘ ও সময়সাপেক্ষ যাত্রাপথ ইত্যাদি প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হতেই বিকল্প পথের খোঁজ। তখনই চিনা চা ব্যবসায়ীরা উত্তরবঙ্গের এই অঞ্চলটিতে চা উৎপাদনের কথা ভাবে। এক্ষেত্রে আর একটি তথ্যের সংযোজন জরুরি। চিন থেকে আমদানিকৃত চা কালিম্পং বাজার হয়ে সব থেকে বেশি পরিমাণে যেত তিব্বতের রাজধানী লাসায়। চিনের ইয়েনান প্রদেশের জেলাগুলিতে মূলত চা উৎপন্ন হতো। সময়টা কল্পনা করুন। তখনকার পরিবহন ও পরিকাঠামোর নিরিখে চিনের ইয়েনান থেকে কালিম্পং হয়ে লাসায় চা সরবরাহ ছিল অসম্ভবকে সম্ভব করার মতোই এক কাজ। পথ ছিল ভীষণ দুর্গম। যদি উৎপাদনের কাজটা কালিম্পঙেই করা যায় ? গবেষকরা বেশ কিছু অনুকূল পরিস্থিতিও খুঁজে বের করলেন ভাবনা ও প্রয়োগের ভিত্তিতে। আর এভাবেই এদেশে তৈরি হলো চা উৎপাদনের প্রথম রূপরেখা। পরিকল্পনার শুরুতেই যেটা সব থেকে উল্লেখযোগ্য বলে উপলব্ধ হলো, সেটা হলো চা চাষের ক্ষেত্রে এই অঞ্চলের মাটি ও জলবায়ুর উপযোগিতা। অঞ্চলটি তখন আংশিকভাবে ভুটানের অন্তর্গত ছিল। চা বাগানগুলি পল্লবিত হলো আলগড়া, পেডং, লাভা ও জেলেপ লা-কে কেন্দ্র করে। প্রসঙ্গত জেলেপ লা হলো লাসা যাওয়ার পথ। জমি তো উপযোগী ছিলই। দেখা গেল, হিমালয়ের অন্তর্গত কুয়াশায় ঘেরা, ঈষৎ ভেজা ও ঠান্ডা আবহাওয়াও চা চাষের জন্য দারুণ সহায়ক হচ্ছে। বীজ আনা হলো চিন দেশ থেকে। আর এই সম্পূর্ণ কর্মকাণ্ডকে ঘিরেই এই ছোট্ট জনপদ জায়গা করে নিল ভারতের চা উৎপাদন ইতিহাসের খাতায়। শুরুয়াত চিনেরাই করলেও পরে ভারতীয় বাণিজ্য সংস্থাগুলিও আগ্রহী হয়ে উঠলো চা উৎপাদনে। ভারতের শিল্প-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে চায়ের উৎপাদন, বিপণন ও রপ্তানি যে এক উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে নেবে, সেই ভূমিকা লেখা হলো সেদিনই। সাল ১৮০০। ভারত, চিন ও তিব্বতের মধ্যে তখন মৈত্রীর সুবাতাস বইছে। ফলে পরিকাঠামোগত দিক থেকে অভ্যন্তরীণ ও অন্তরদেশীয় সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে চা উৎপন্ন ও বিপণনের উপযোগী এক পরিবেশ গড়ে তুলতে কোনও সমস্যাই হলো না। রাস্তা তৈরি হলো। যারা বাগান ও কারখানায় কাজ করবেন তাদের থাকার জন্য জঙ্গল কেটে,পাহাড়ের পাদদেশে বসতি স্থাপন করা হলো। বেশ কিছু মানুষের কর্ম সংস্থান হলো স্বাভাবিকভাবেই। একই সঙ্গে এলেন মিশনারিরা। প্রথম দিকে মূলত স্কটিশ মিশনারিদের উদ্যোগে গড়ে উঠলো গির্জা। গির্জার পাদ্রীরা বুঝেছিলেন চা শিল্পকে ঘিরে যে জনবসতি তৈরি হয়েছে, তার উন্নয়নের দিকটাকে প্রাধান্য দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফলে তৈরি হলো স্কুল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ইত্যাদি।
পরবর্তীতে সুইস ফাদারদের আনুকূল্যে এখানে খ্রিস্টান ধর্মের উত্থান ও প্রসার ঘটলো। তারই সঙ্গে আঞ্চলিক স্তরে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া ও পরম্পরায় ওঁরা সৃষ্টি করলেন এক নতুন প্রজন্মের সমাজ। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলো। চিনাদের চা বাগানের পত্তন, উৎপাদন, রফতানি। তার সঙ্গে এদেশের ব্যাবসায়ী শ্রেণীর যুক্ত হওয়া। বসতি স্থাপন। সামাজিক বিবর্তন চলতে থাকলো কালের নিয়মে। এর পর দেশে ব্রিটিশ শাসনকাল এলো। আরও অনেককিছুই মতোই চা শিল্পের নিয়ন্ত্রণও চলে গেল তাদের হাতে। স্বাধীনতা পরবর্তীতে দেশীয় বাণিজ্য সংস্থাগুলি এলো চা শিল্পে। এর আগেই উত্তরবঙ্গের এই অঞ্চল ছাড়াও দেশের আরও অনেক রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে শুরু হয়ে গেছিল চা উৎপাদন। তারপরের দীর্ঘ ইতিহাস পর্যবেক্ষণের নিরিখে আমরা ফিরে আসবো পেডং-এর আলোচনায়। যেটা দেখা যাচ্ছে, প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা থেকে রাজনৈতিক জটিলতা, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ক্ষমতার পট পরিবর্তন–ক্রমশ বিলুপ্তির পথে নিয়ে গেল এখানকার চা উৎপাদন ও বাণিজ্য। অযত্ন, অবহেলা, যথাযথ দেখভালের অভাবে ধ্বংস হয়ে গেল একের পর এক চা বাগান। কালের গর্ভে হারিয়ে গেল পেডং ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের গৌরবময় চা উৎপাদনের ইতিহাস। সেই ইতিহাসের একমাত্র সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে একটি বাংলো, যেখানে থাকতেন বাগানগুলির পরিচালন আধিকারিকরা। যেমন বহু ইতিহাসের সাক্ষী ড্যামসাং দুর্গের ভগ্নাবশেষ। উল্লেখ্য একদার ড্যামসাং টি এস্টেট হাত বদলের ফলে পরবর্তীতে পরিচিত হয় ডুয়ার্স টি কোম্পানি নামে। পরের ইতিহাস ছড়িয়ে যায় ভারতীয় চা উৎপাদন ও বাণিজ্যের বৃহৎ ক্ষেত্রে, যার বাইরেই থেকে যায় পেডং ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা। এদিককার চা বাগানগুলি প্রসারিত হয় তরাই ও ডুয়ার্স অঞ্চলে।
প্রসঙ্গত, পেডং-এর ড্যামসাং উপত্যকাকে ঘিরে বিস্তার লাভ করেছিল চা বাগানগুলি, যা কালিম্পং থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে অবস্থিত। এই ড্যামসাং উপত্যকার ওপরেই দাঁড়িয়ে ড্যামসাং দুর্গ, আজ যা শুধুই ধ্বংসাবশেষ। দুর্গটি একদা ছিল ভুটানের রাজার অধীনে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রাচীন এই দুর্গের দু-একটি ভগ্ন দেওয়াল ছাড়া এখন আর কিছুই নেই। তবে প্রকৃতির উপহার স্বরূপ জঙ্গল রয়েছে। জঙ্গলে পাখিদের রাজত্ব। ফুল-প্রজাপতিরাও আছে। ফুলের মরশুমে (মার্চ-এপ্রিল) দারুণভাবে সেজে ওঠে অবহেলিত এই ঐতিহাসিক দুর্গ সংলগ্ন জঙ্গল। অনেকটা উঁচু থেকে পুরো পেডং ও তার আশপাশের জায়গাগুলি ছবির মতো দৃশ্যমান, পর্যটকের জন্য যা খুবই আকর্ষণীয়। রাস্তা থেকে ঘন্টা দুয়েকের পথ ট্রেক করে উঠতে হয় এখানে। সাল ১৮৮২। ফাদার অগাস্তে দেগোদাঁ এলেন পেডং। পেডং হয়ে তিব্বত যাবেন এই ফরাসি পাদ্রী। ভারতে তখন ব্রিটিশ রাজত্ব। আর তিব্বতে প্রবল বৌদ্ধ শাসন। খ্রিস্টান বলে ফাদার অগাস্তে তিব্বতে প্রবেশের অনুমতি পেলেন না। জীবনের বাকি দিনগুলি তিব্বত মিশনেই কাটাবেন, এই ছিল ফাদারের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন কি পূর্ণ হবে না ? কি করবেন তিনি ? তিব্বতে তো যেতে পারছেন না ! সেবার আদর্শে যাঁর জীবন উৎসর্গীকৃত, তাঁকে কি থামিয়ে রাখা যায় ? তিব্বত না হোক, পেডং তো আছে ! কাজের জন্য এই অঞ্চলকেই শেষে বেছে নিলেন ফাদার অগাস্তে। নিজের দেশ থেকে আনা ওষুধপত্র আর লেখাপড়ার ভান্ডারকে সঙ্গী করে নেমে পড়লেন কাজে। প্রতিষ্ঠিত হলো চার্চ ও তাকে কেন্দ্র করেই সামাজিক উন্নয়ন। সেই সময় থেকে আজকের পেডং। মিশনারিদের পাশাপাশি এখানে ব্যবসায়িক প্রয়োজনে এসেছেন বিহারী ও মারওয়ারীরা। নেপাল থেকে বসবাসের জন্য এসেছেন নেপালীরা। ভুটানিদের আগমন ঘটেছে ড্যামসাংকে ঘিরে। সব মিলিয়ে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান অর্থাৎ এক মিশ্র ধর্ম ও সংস্কৃতির আবহ গড়ে উঠেছে এখানে। শান্তিপূর্ণ সেই অবস্থান আজও অব্যহত। সেনা হেড কোয়ার্টার থাকায় নিরাপত্তার দিকটিও সুনিশ্চিত। ফলে পর্যটকদের কাছে পেডং বরাবরই আকর্ষণীয়। ইদানীং চলছে আপার পেডং-কে ঢেলে সাজানোর কাজ। রাস্তা তৈরি হচ্ছে। পেডং বাজার ছেড়ে একটু এগিয়ে গেলেই চার্চ। আর এই চার্চের উল্টোদিকেই একটা রাস্তা উঠে গেছে আপার পেডং-এ। আপার পেডং-এরও এক গর্বের ইতিহাস আছে। সেটা ১৯৫৬ সালের কথা। ভারত সরকারের নৃতত্ত্ব বিভাগ একে আদর্শ গ্রাম হিসেবে ঘোষণা করেছিল। তখন জনা পঞ্চাশেক লোকের বসবাস সেখানে। আজ হাজারের ওপর অধিবাসী থাকেন আপার পেডং-এ। কাশ্যম জঙ্গলের একেবারে গা ঘেঁষে এই গ্রাম। ফলে, এখানে প্রচুর ওষধি গাছ রয়েছে, যা গবেষকদের জন্য বাড়তি আকর্ষণ। এছাড়াও রয়েছে নানা প্রজাতির গাছপালা, তার মধ্যে বেশ কিছু খুবই বিরল প্রজাতি। এতে একদিকে যেমন নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মেলে। অন্যদিকে দেশবিদেশের উদ্ভিদবিদদের কাছেও আপার পেডং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
আপার পেডং পুরোপুরি তৈরি হয়ে গেলে পেডং-এর পর্যটন আকর্ষণ যে বহুগুণ বেড়ে যাবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। উচ্চতা ৬০০০ ফুট। দূষণমুক্ত চমৎকার আবহাওয়া। কাঞ্চনজঙ্ঘার পুরো রেঞ্জটাই দৃশ্যমান এখান থেকে। ৩ কিলোমিটার দূরত্বে জিলাপি লা, নাথু লা ও জুলুক। সমস্তটা মিলে অনির্বচনীয় এক ছবি ! ২০০৬ সাল থেকে নাথু লা আনুষ্ঠানিক ভাবে নতুন করে খুলে গেছে। এর ফলে, ভারত ও তিব্বতের মধ্যেকার পর্যটন শিল্পে নতুন জোয়ার এসেছে। অর্কিড ও রডোডেনড্রোনের স্বর্গ জেলা কালিম্পং। পেডং-এও সেই স্বর্গীয় সৌন্দর্যের ছোঁয়া দারুণভাবে পাবেন প্রকৃতিপ্রেমীরা। কাশ্যম জঙ্গলে রয়েছে হরিণ, লেওপার্ড, রেড পান্ডা। আর দেখবেন নানা বর্ণ ও বিচিত্র প্রজাতির পাখি। বার্ড ওয়াচারদের বিশেষ আকর্ষণ তাই এই গ্রামকে ঘিরে। কাঞ্চনজঙ্ঘা ছাড়াও এখান থেকে সিকিমের অনেকটাই দৃশ্যমান। আপার পেডং থেকে দেখা যায় ঝাঁ চকচকে রাজধানী গ্যাংটক ও সিকিম এয়ারপোর্ট। আর কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার সব থেকে উপযুক্ত সময় নভেম্বর। মার্চ-এপ্রিলে রডোডেনড্রনের প্রাচুর্য।
ঐতিহাসিক নানা সৌধ–ক্রশ হিল পয়েন্ট, সাংচেন দোরজি মনাস্ট্রি, ড্যামসাং ফোর্ট, বিলুপ্ত চা বাগান সংলগ্ন পরিত্যক্ত বাংলো পেডং-কে পর্যটক আকর্ষণে বেঁধে রেখেছে। প্রসঙ্গত ফাদার অগাস্তে দেগোদাঁই ক্রস হিল পয়েন্টের চার্চটি প্রতিষ্ঠা করেন। ক্রস হিল পয়েন্ট-এর কাছেই কাশ্যম জঙ্গল ও কাশ্যম গ্রাম। এই গ্রামে বসবাস করে অঞ্চলের শেষ লেপচা পরিবারটি। এঁরা এখনও তাঁদের স্বতন্ত্র রীতি-রেওয়াজ মেনে জীবন অতিবাহিত করেন। এঁদের বাড়িটিও সেই বিশেষ লেপচা ঘরানায় তৈরি। মাটির দেওয়াল, খড়ের চাল। রাস্তা থেকে অনেকটা নেমে দেখতে হবে এই হেরিটেজ বাড়িটি। অবশ্যই এক অতুলনীয় অভিজ্ঞতা।
সাংচেন দোরজি মনাস্ট্রি ১৭০০ সালে প্রতিষ্ঠিত । এখন পুরোনো ভবনটি বন্ধ। সংস্কার চলছে । কাছেই নতুন ভবন। দর্শকদের জন্য খুলে গেছে এর দরজাও। পুরোনোটি ছিল ছোট আকারের এক দোতলা। সারা শরীরে তার প্রাচীন গন্ধ। মোম-পালিশ কাঠের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠা। চারপাশ নিঃশব্দ, সুশৃঙ্খল,পরিচ্ছন্ন। প্রথমবার যাই বেশ কয়েক বছর আগে। রাস্তা থেকে খাড়া পাথরের সিঁড়ি উঠে গেছে। দোতলায় প্রার্থনাঘর। বুদ্ধের বিশাল মূর্তি ছাড়াও ছোটবড় নানা মূর্তি, বাঁধানো ফটো, বাঁধানো লিপি, বইপত্র, পূজার উপকরণে সজ্জিত ঘরের একটি দিক। আর এইসবের মাঝে প্রজ্জ্বলিত সেই প্রদীপ, যা কখনও নিভতে দেওয়া হয় না। এঁদের সংগ্রহে প্রায় ৩০০টি ফ্রেস্কো পেন্টিং রয়েছে, যা মুগ্ধ করে। এই সমস্ত সংগ্রহ এবং আরও নতুন উপকরণ ও সজ্জায় সেজে উঠেছে নতুন সাংচেন দোরজি মনাস্ট্রি। পুরোনোটি ছিল রাস্তা থেকে অনেকটা উঁচুতে। নতুনটির ক্ষেত্রে রাস্তা থেকে কয়েক ধাপ নেমে যেতে হবে। অনেকটা জুড়ে বিশাল দালান । স্থাপত্যে সামান্য আধুনিকতার ছোঁয়া। এর বাইরে বাকি সব এক। অলংকরণ, আভরণের বাইরে পুরোটাই বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শনের অসাধারণ পরম্পরা ধরে রেখেছে। প্রতি বছর এখানে অনুষ্ঠিত হয় বর্ণাঢ্য ছয়ম নৃত্যানুষ্ঠান (মুখোশ নৃত্য )। দেখেছিলাম তার পোশাক ও অন্যান্য উপকরণ সযত্নে রক্ষিত রয়েছে একটি কক্ষে।
এবার কিছু অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেব পাঠকের সঙ্গে। আগেই বলেছি, পেডং একটা সময় এতটাই টানতো (আজও টানে, ব্যস্ততায় যাওয়া হয় না) আমায় যে ফিরে ফিরে যেতাম সেখানে। কখনও একা, কখনও দলে। তেমনই একবার। একাই গেছি সেবার, কোনও এক পুজোর ছুটিতে। আগের দিন পৌঁছে খুব ক্লান্ত ছিলাম। লাঞ্চের পর কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে পায়ে হেঁটে এদিক ওদিক ঘুরেছি। পাহাড়ের মানুষ অপরিচয়ের গণ্ডি খুব তাড়াতাড়ি সরিয়ে ফেলতে পারে। দেখা হলেই হাসিমুখে সম্ভাষণ জানায়। সেই আন্তরিকতা হৃদয়ের ঝুলিতে পুরে যখন হোমস্টে-তে ফিরছি, তখন সূর্য অস্তাচলে যাওয়ার পথে। একটু পরেই সন্ধ্যা নামে। শুক্লপক্ষের সপ্তমী। চাঁদ ক্রমশ উজ্জ্বলতার পথে। ঝকঝকে আকাশে তারারা মিটিমিটি হাসে। সেই আলোর সঙ্গে তাল মিলিয়েই জ্বলে দূরের সিকিম মনিপালের আলো। এই বাড়িটা আসলে একেবারে সিকিম বর্ডারে। বাড়িটার পর থেকেই সারি সারি পাহাড়, যা সিকিম রাজ্যের অন্তর্গত। ঘরের জানালা দিয়ে সেই পাহাড়দের দেখি। বুনো গাছপালার গন্ধ এসে নাকে ঝাপটা দিয়ে যায়। চারপাশ একেবারে শান্ত। পূর্ণজি একটু আগে চা আর পেঁয়াজের পকোড়া দিয়ে গেছেন। কিছুক্ষণ নিজের সঙ্গে থাকা। তারপর ডিনার করে ঘুমের দেশে। পরদিন ঘুম ভাঙতেই বেরিয়ে পড়ি। যাব ক্রসহিল পয়েন্টে। কাছাকাছির মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্পট।
হোমস্টে থেকে বেরিয়ে ডানদিকে বাঁক নিয়ে চলতে শুরু করি চড়াই-উৎরাই পথ ধরে। বাঁ দিকে পাহাড়ের গা ঘেষে ধাপে ধাপে ঘরবাড়ি,গাছপালা। ডানদিকে শুধুই পাহাড়, যাদের কথা আগেই বলেছি। প্রথম সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ছে চরাচর জুড়ে। পাখির কাকলি ভাঙ্গছে নিঃশব্দ প্রকৃতির ঘুম। চারপাশের মায়াবী সৌন্দর্য চোখে মেখে এগিয়ে চলেছি। আর সামান্য যেতেই সামনের দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে যাই। অনেকটা দূর। তবু স্পষ্ট সাদা সেই তিন শৃঙ্গ। কাঞ্চনজঙ্ঘা ! এরজন্যই তো এত কান্ড করে ছুটে আসা। বেশ কয়েকবছর আগে দেখা সেই বিস্ময়ে অভিভূত হওয়ার স্মৃতি আজও অমলিন। এটা মিডল পেডং। আপার পেডং থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা বিস্তৃত দৃশ্যমান শুনেছিলাম। এখান থেকেও এমন দর্শন মিলবে, এটা অভাবনীয়।
আগেই বলেছি বেশ কয়েকবার গেছি পেডং-এ। এখান থেকেই ঘুরেছি কাগে, রামধুরা, বারমেক, মুনসং গ্রাম, জলসা বাংলো, সিলেরি গাঁও, রোমিতে ভিউ পয়েন্ট, সাইলেন্ট ভ্যালি, রংপো নদী, সিকিমের ঋষি খোলা ও আরিটার লেক ইত্যাদি। পূর্ণজিই ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। যাঁরা পাহাড় ভালোবাসেন তাঁদের জন্য পেডং তুলনাহীন। ইতিহাসের গন্ধ মেখে পল্লবিত নয়নাভিরাম প্রকৃতি। পথেপ্রান্তরে কত না কাহিনি ছড়িয়ে! সেসবের কিছু দেখবেন সৌধ ও ধ্বংসাবশেষ, গির্জা ও গুম্ফায়। কিছু শোনাবেন পূর্ণজি স্বয়ং। এখানকার ইতিহাস ও অন্যান্য তথ্য নখদর্পণে ওঁর। এছাড়া, হোমস্টে-র যথাযথ ও পরিচ্ছন্ন ব্যবস্থা, সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে তৈরি খাবার আপনাকে তৃপ্ত করবে। খাওয়ার মধ্যে লাঞ্চ ও ডিনারে পাবেন, ভাত/রুটি, ডাল, সবজি, ভাজা, চিকেন বা ডিম। এখানকার আলু চোখা আর বেগুন পোড়া বা ভর্তার স্বাদ একবার খেলে ভুলবেন না গ্যারান্টি। ইদানীং পেডং বাজারে মাছ পাওয়া যাচ্ছে। চালানি মাছের স্বাদ যেমন হয় ! তবে, শাকসবজি অর্গানিক পদ্ধতিতে চাষ করা। তাই অতীব সুস্বাদু। ব্রেকফাস্টে রুটি/পুরি, সবজি আর সন্ধ্যায় স্ন্যাকস দেওয়া হয়। চা দিনে ২/৩ বার। থাকা খাওয়ার খরচ দিনপ্রতি জনপ্রতি ১২০০-১৫০০ টাকা।
কালিম্পং থেকে আলগড়া হয়ে যেতে হয় পেডং। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন বা শিলিগুড়ি তেনজিং নোরগে বাসস্ট্যান্ড থেকে কালিম্পং যাওয়ার শেয়ার গাড়ি পাবেন। বাসও যায়। কালিম্পং থেকে পেডং যাওয়ার জন্যও আঞ্চলিক সার্ভিস গাড়ি পাবেন শেয়ারে। শুধু কালিম্পং থেকে পেডং যেতে গাড়ি রিজার্ভ করতে পারেন। এ ব্যাপারে পূর্ণজির সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে। এছাড়া সবদিক থেকেই যাওয়ার জন্য গাড়ি রিজার্ভ করতে পারেন। যাওয়ার পথে কালিম্পং পর্যন্ত মাঝে মাঝেই উঁকি দেবে তিস্তা। তার আকর্ষণ তো চিরন্তন। কালিম্পং থেকে দূরত্ব সামান্যই, ৪৫ মিনিট মতো সময় লাগে। সে পথও গেছে দু’পাশে পাহাড় রেখে, জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। বর্ষা এড়িয়ে যে কোনও সময় যেতে পারেন। শীতে বেশ ঠান্ডা পড়ে। উপযুক্ত শীত-পোশাক সঙ্গে রাখবেন। যখনই যান–টর্চ, জরুরি ওষুধ, ফার্স্টএড বক্স, টি ব্যাগ ও কফির প্যাকেট, বিস্কুট ও কিছু শুকনো খাবার সঙ্গে রাখবেন।
বুকিং ও অন্যান্য তথ্যের জন্য যোগাযোগ– পূর্ণ তামাং 9933615828