Monday, February 3, 2025
ঠিকানা দিকশূন্যিপুর

ইতিহাস আজও কথা বলে

দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম প্রতি সপ্তাহে। শুরু হলো রাজস্থানের ওপর বিশেষ ধারাবাহিক ভ্রমনকাহিনি, রাজস্থান ডায়েরি। লিখছেন ছন্দা চট্টোপাধ্যায়। আজ প্রথম পর্ব।

রাজস্থানের কথা ভাবলেই কানে আর মনে ভেসে আসে সহস্র ঘোড়ার খুরের শব্দ, অস্ত্রের ঝনঝনানি, যুদ্ধ, রক্তপাত, জয়-পরাজয়ের কাহিনি। কল্পনায় দেখি, প্রেমিকা সংযুক্তাকে নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে প্রেমিক পৃথ্বীরাজ চৌহানের সদম্ভ পলায়নের দৃশ্য। হলদি নদীর ধারে মুঘলদের বিরুদ্ধে মেবারের বীর রানা প্রতাপের  আমৃত্যু লড়াই আর তাঁর বিশ্বস্ত ঘোড়া চৈতকের প্রাণত্যাগ–প্রভুভক্তির চরম নিদর্শন। অথবা বাদশা আলাউদ্দিন খিলজির লালসার প্রতিবাদে সম্মান বাঁচাতে রাজ অন্তঃপুরের মহিলাদের নিয়ে চিতোরগড়ের রানী পদ্মিনীর আগুনে ঝাঁপ দিয়ে সমবেত জহরব্রত পালন। মনে পড়ে যায় ধাত্রী পান্নার অসামান্য আত্মত্যাগের কাহিনি। রাজস্থানের আকাশে বাতাসে আজও ভেসে বেড়ায় কৃষ্ণপ্রেমে পাগল মীরাবাইয়ের ভজনের সুর। শৌর্য-বীর্য-ঐশ্বর্য-সংস্কৃতি, বিলাসিতা এবং ঐতিহ্যের ইতিহাস রাজস্থানকে এক বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত করেছে।

Img 20221228 Wa0043
ইতিহাস আজও কথা বলে 8

অন্যদিকে উল্লেখযোগ্য তার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য। ভারতের বৃহত্তম রাজ্য রাজস্থান বৈচিত্রময় তার পোশাক-আশাক, খাদ্যাভ্যাস, সংস্কৃতি–সব কিছুতেই।   রাজস্থান মূলত শুষ্ক অঞ্চল। রাজ্যের সত্তর শতাংশ জুড়ে ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান ডেজার্ট’–বিখ্যাত থর মরুভূমি পাকিস্তানের সঙ্গে সীমানা রচনা করেছে। প্রাচীন আরাবল্লি পর্বতশ্রেণী আর আদিগন্ত মরুভূমি রাজস্থানের পর্যটক আকর্ষণের মূল দুই বিষয়। আর আছে সারা বিশ্বে জনপ্রিয় মাকরানা মার্বেল পাথর (শ্বেতপাথর )। মরু অঞ্চলে ন্যূনতম বৃষ্টিপাত হলেও  দক্ষিণ পূর্বাঞ্চল এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলে প্রচুর লেক আছে এবং কিছু বৃষ্টিপাত হয় বলে এই এলাকাগুলো তুলনামূলকভাবে সুজলা-সুফলা। চাষবাসও হয়।

আক্ষরিক অর্থে রাজস্থান মানে যেখানে রাজারা বসবাস করে। ছোটো ছোটো এলাকা জুড়ে রাজস্থানে একদা যত রাজা, তত রাজত্ব ছিল। অত্যন্ত স্বাধীনচেতা জাতি হওয়ায়, নিজেদের মধ্যেও যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকতো। এছাড়া বহিঃশত্রুর আক্রমণ ঠেকানোর লড়াই তো ছিলই। প্রথম মুসলিম আক্রমণ হয়েছিল মহম্মদ ঘোরির নেতৃত্বে। এরপরে কুখ্যাত আলাউদ্দিন খিলজি। এরপরেও বারবার মুঘলদের আক্রমণের মুখোমুখি হতে হয় রাজস্থানকে। রাজাদের নিজেদের মধ্যে মিত্রতা না থাকায় পরাজয়ের ধাক্কা ছাড়াও প্রচুর ক্ষয়ক্ষতিও সহ্য করতে হয়েছে।

তবে, ব্যতিক্রমও ছিল। মুঘল বাদশা আকবর অম্বরের রাজকন্যা যোধাবাঈকে বিয়ে করে রাজপূতদের সঙ্গে বন্ধুত্বের সেতু তৈরি করেন। তাঁর রাজ দরবারে বহু রাজপূত কর্মচারীকে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করা হয়। ব্রিটিশরা রাজস্থানকে বলতো রাজপূতানা অর্থাৎ রাজপূতদের দেশ। ভারতের স্বাধীনতা লাভের পরে আরও কিছু এলাকা অন্তর্ভূক্তির পরে নামকরণ হয় রাজস্থান। ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে সিপাহী বিদ্রোহের পরে সরাসরি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে চলে আসে ভারত। সাম্রাজ্য গঠনের সুবাদে ব্রিটিশরা রাজস্থানের রানাদের হাতে রাজতন্ত্র কায়েম রেখে চুক্তিবদ্ধ মিত্রতা গড়ে তোলে।

Img 20221228 Wa0047
ইতিহাস আজও কথা বলে 9

যুদ্ধবিগ্রহের টেনশন কমে যাওয়ায় রাজারা ক্রমশ বিলাসব্যসনে মত্ত হয়ে অলস জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। নানান ধরণের বিলাসিতা, বিদেশ ভ্রমণ, খেলাধুলো এসবে নিমগ্ন হয়ে পড়ায় রাজকোষে ঘাটতি শুরু হয়ে যায়। স্বাধীনতার পরেও রাজন্য ভাতা চালু ছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আমলে রাজন্য ভাতা বিলোপ হওয়ার পরে রাজাদের অবস্থা সঙ্গীন হয়ে পড়ে। নিজেদের জীবনযাত্রার মান রক্ষা করতে বাধ্য হয়ে রাজ্যের উন্নয়নের দিকে নজর দিতে হয়। তার অন্যতম প্রধান ছিল উন্নতমানের পর্যটনশিল্প গড়ে তোলা। রাজস্থানের ছোটো-বড়ো রাজপ্রাসাদগুলিকে মান অনুযায়ী বিলাসবহুল (হেরিটেজ) হোটেল বা মিউজিয়ামে রূপান্তরিত করা হয়েছে।

সুসজ্জিত তো ছিলই। তার ওপর, পর্যটন আকর্ষণের জন্য রাজস্থানী স্থাপত্য এবং শিল্পকলায় রাজপ্রাসাদগুলোকে নতুনভাবে সাজানো হলো। সেইসঙ্গে বিনোদনের অফুরন্ত আয়োজন। তাই আজকের রাজস্থান শুধু ভারতবর্ষ নয়, অবশ্য দ্রষ্টব্য পর্যটনক্ষেত্র হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রেও স্থান করে নিয়েছে। বিদেশি পর্যটকদের জন্য চালু করা হয়েছে রাজকীয় সজ্জায় সুসজ্জিত অভিজাত বিলাসবহুল ট্রেন ‘প্যালেস অন হুইলস’! রাজস্থানের ওপর ভ্রমণকাহিনি লিখতে গেলে এই মুখবন্ধটুকু জরুরি ছিল। একটা অঞ্চলকে অনুভব করতে হলে, তার ইতিহাস সামান্য হলেও জানা প্রয়োজন। আর রাজস্থান যে ঐতিহাসিক ভাবে কতটা বর্ণময়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এরপরের পর্বগুলিতে পাঠকদের নিয়ে সেই বর্ণময় পথে যাত্রা করবো। সঙ্গে প্রকৃতি ও অন্যান্য অনুষঙ্গ তো আছেই। (চলবে)

# ছবি : লেখক