উত্তরকাল ক্ষমা করবে না
পরিচালক কুমার চৌধুরীর ‘প্রিয় চিনার পাতা, ইতি সেগুন’ নিয়ে লিখেছেন অজন্তা সিনহা।
একটা সুখবর পৃথকভাবে আগেই জানাই। আজ থেকে প্রতিদিন নজরুলতীর্থ-এ, দুপুর ১টা ৫০মিনিটে দেখানো হচ্ছে ‘প্রিয় চিনার পাতা, ইতি সেগুন’।
দুর্ভাগ্যবশত ‘প্রিয় চিনার পাতা, ইতি সেগুন’ আমার দেখা হয়নি। শিলিগুড়িতে এ ছবির প্রদর্শন সম্ভব নয়, জানাই ছিল। অধীর অপেক্ষায় আছি, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কবে এই সময়কার সবচেয়ে আলোচিত ছবিটি দেখতে পাব, তার। এমনিতে কলকাতা ছেড়ে চলে আসার কারণে কোনও আক্ষেপ নেই আমার। কদাচিৎ আফসোস করি। তবে, ‘প্রিয় চিনার পাতা ইতি সেগুন’-কে কেন্দ্র করে সেই আফসোসটা হচ্ছে। বিশেষ করে যখন এই ছবি সম্পর্কে বিদগ্ধ জন থেকে আম দর্শক–সকলেই এমন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন, তখন আক্ষেপ তো তীব্র হবেই।
যদিও দেখিনি বলে,’প্রিয় চিনার পাতা, ইতি সেগুন’-কে ঘিরে আমার আবেগ কিছু কম নয়! আর সেই আবেগের জায়গা থেকেই যখন জানতে পারলাম, হাউসফুল হওয়া বা দর্শকের তীব্র আগ্রহ-উৎসাহ থাকা সত্ত্বেও ছবিটি হল থেকে সরিয়ে দিল নন্দন কর্তৃপক্ষ, তখন আর ‘শিলিগুড়ি থাকি, ছবি দেখিনি, কী আর বলবো এই বিষয়ে’–ভেবে, চুপ করে বসে থাকতে পারলাম না। আদতে ছবির পরিচালক কুমার চৌধুরী, প্রযোজক পিয়ালী চৌধুরী–দুজনের সঙ্গেই ‘প্রিয় চিনার পাতা, ইতি সেগুন’-কে ঘিরে একজন সিনেমা সাংবাদিক হিসেবে এবং বহুদিনের পরিচিত এই তরুণ দম্পতির আন্তরিক প্রচেষ্টার প্রতি শ্রদ্ধা থেকে ছবি প্রসঙ্গে নানা আলোচনা ঘুরেফিরে করেছি। যত আলোচনা, তত মানসিক সংযুক্তি। স্বাধীন ছবি নির্মাতাদের ক্ষেত্রে এমনিতেই আমার কিছু বাড়তি শ্রদ্ধা আছে বরাবর। শুধু সিনেমা দর্শককে ভালো ছবি দেখাবার তাগিদে কী না করেন ওঁরা ! বাড়ি বন্ধক থেকে ঘরের শেষ সম্বলটুকু বিক্রি, কিছুই বাকি রাখেন না।
আমার নিজের অনুভব, আবেগ, চুলচেরা বিশ্লেষণের আগে কয়েকজন অন্য মানুষের কথা। এঁরা ছবি দেখার পর ‘প্রিয় চিনার পাতা ইতি সেগুন’-কে ঘিরে মুখর হয়েছেন। এঁদের ক্ষোভ ও আবেগের উষ্ণতা কয়েকশো কিলোমিটার দূরে বসেও অনুভব করতে পারছি। বলা বাহুল্য, সকলেরই বলার প্ল্যাটফর্ম সোস্যাল মিডিয়া। কারণ, মেনস্ট্রিম মিডিয়ার সেই অর্থে তেমন মাথাব্যথা নেই, এই বিষয়ে। দু-একটি ছাড়া সাধারণভাবে অধিকাংশই স্বাধীন ছবির নির্মাতাদের তেমন গুরুত্ব দেয় না। তাঁদের সব মনোযোগ বিগ হাউসকে ঘিরে। তার মধ্যে,‘প্রিয় চিনার পাতা, ইতি সেগুন’-এর পরিবর্তে হলে জায়গা পেয়েছে রাজ চক্রবর্তীর ‘ধর্মযুদ্ধ’, যাঁর প্রতি এখন মিডিয়া থেকে কর্তৃপক্ষ–সকলেরই হাত প্রসারিত। এই প্রেক্ষিতে কে আর ঝামেলায় জড়ায় ? আদতে ঝামেলা না হলেও, ঝামেলা হতে পারে, শুধু এই ভয়ে আমরা নিজেদের শিরদাঁড়া যে কতখানি বাঁকিয়ে ফেলেছি, নিজেরাই জানি না। এমতাবস্থায় বরং সোস্যাল মিডিয়া অনেকবেশি প্রভাবমুক্ত ও ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে আসছে বরাবর।
পরিচালক অতনু ঘোষের কথায়, “অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিপন্নতার সিনেমা শুধুই হতাশা ও যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে। কঠোর বাস্তবতার তুলনায় মায়া, দরদ, মুগ্ধতায় খামতি দেখা দেয়। কিন্তু পরিচালক কুমার চৌধুরী পেরেছেন। সরল, অনাড়ম্বর প্রেমের গল্পে মোহ, চমক, ফ্যান্টাসি সবই আছে। শুধু হল নেই। কাল নন্দন ২-এ সন্ধে ৬টায় ‘প্রিয় চিনার পাতা, ইতি সেগুন’-এর শেষ শো। এমন একটা হল যদি থাকতো, শহরের কোনও এক প্রান্তে, খুব ছোট, ওই ১০০টা সিটই যথেষ্ট, যেখানে বিনা শর্তে, বিনা তদ্বিরে এমন ছবি আরও কয়েক সপ্তাহের মেয়াদ পেত ! যেসব ছবিতে ঝিনচ্যাক নেই, কিন্তু প্রাণ আছে…!” অতনু এই সময়ের একজন ব্যতিক্রমী ও লব্ধপ্রতিষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালক। তাঁর এই বক্তব্য অনেক না বলা কথা বলে দেয়।
‘প্রিয় চিনার পাতা, ইতি সেগুন’ ছবিটি দেখার জন্য নন্দনে দর্শকের ভিড় হচ্ছে নিয়মিত। চমৎকার সব প্রতিক্রিয়াও পাওয়া যাচ্ছে। তবুও আশ্চর্যজনকভাবে আগামিকালই শেষ শো। যাঁরা বড় পর্দায় দেখতে চান, আগামিকালই শেষ সুযোগ। হাউসফুল করে দিন–জানিয়েছেন আর এক তরুণ প্রতিভাবান পরিচালক প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য। পরিচালক তমাল দাশগুপ্ত তাঁর বক্তব্যে অনেকগুলি দিক তুলে ধরেছেন। তার কিছুটা অংশ উল্লেখ করবো এখানে, “যে ছবিটি এত ভালো ব্যবসা দিচ্ছিল সেই ছবিটিকে জোর করে তুলে দেবার যুক্তিটা কী ? শুধুমাত্র এটি একটি ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম, তাই তার সাথে যা কিছু করা যায়, এই মনোভাব নিয়েই নন্দন কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্ত ? শুনলাম, নন্দন কর্তৃপক্ষ বলেছেন, বড় ব্যানার বা বড় প্রচার মাধ্যম যে ছবির সাথে নেই, সেই ছবিকে নাকি নন্দন ১-এ শো দেওয়া যাবে না। এঁরা কি জানেন নন্দন সৃষ্টির মূল লক্ষ্য কি ছিল? নন্দনকে আর্ট হাউস সিনেমার কেন্দ্র হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল, নিছক ব্যবসায়িক ভিত্তিতে সিনেমা প্রদর্শনের জন্য নয়। ব্যাবসায়িক সাফল্য না হলেও নন্দনে ছবি প্রদর্শনের ক্ষেত্রে বিশেষ মাপকাঠি হতো ছবির শৈল্পিক শ্রেষ্ঠত্ব। আজ সেই নন্দনকে নামিয়ে আনা হয়েছে নিছক এক ব্যবসাভিত্তিক সাধারণ প্রেক্ষাগৃহে।”
“সাহস লাগে এমন ছবি বানাতে। কুর্নিশ কুমারবাবুকে! এমনভাবে কলকাতাকে শেষ বোধহয় মৃণাল সেন দেখিয়েছিলেন। এই ছবির অন্যতম প্রধান চরিত্র হল সিনেমাটোগ্রাফি আর এডিটিং। ছবির মূল বিষয়কে ধরতে যেভাবে একের পর এক দৃশ্যকল্প সাজানো হয়েছে, শুধু সেটা দেখতেই বারবার দেখা যায় এ ছবি। ছবির বিষয়বস্তু আজকের পৃথিবীর সবচেয়ে সংবেদনশীল সমস্যা–স্টেটলেস পিপল। বিশেষত, রোহিঙ্গাদের নিয়ে এমন কিছু কাজ করা দরকার ছিল, যা মানুষকে সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার অধিকারের কথা মনে করিয়ে দেয়।”–বলেছেন কৃষ্ণেন্দু মিত্র। ছবিটির গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি সুন্দর বিশ্লেষণ করেছেন কৃষ্ণেন্দু। ‘প্রিয় চিনার পাতা, ইতি সেগুন’-কে কেন্দ্র করে এটাও উঠে আসছে, সচেতন ও বোদ্ধা সিনেমা দর্শক যথেষ্ট পরিমাণে আছেন এই বাংলায়।
হীরক করের কথায়, “গত ১২ই আগস্ট থেকে ১লা সেপ্টেম্বর–নন্দনে পর পর তিন সপ্তাহ টানা প্রতিটি দিন হাউসফুল। ভাবা যায় ! তা সত্বেও নন্দন কর্তৃপক্ষ চতুর্থ সপ্তাহে দর্শকদের ছবিটি দেখার সুযোগ দিলেন না। পরিচালক কুমার চৌধুরীর লক্ষ লক্ষ টাকা বাজারে ঋন। প্রযোজক পিয়ালীর সপ্তাহে দু’দিন ডাইলোসিস চলে, তবুও তিনি তাঁর গহনা বেঁচেছেন। এবং গোটা টিমটা অমানুষিক পরিশ্রম করেছে। কোনও প্রচার নেই। টাকার অভাবে ডিস্ট্রিবিউটর পাওয়া যায়নি। সম্বল শুধুমাত্র নন্দনের সামনে দু’টি স্ট্যান্ডি, আর মুখে মুখে প্রচার।” আরও অনেক কথা লিখেছেন তিনি। সেসব নিছক আবেগের প্রকাশ বললে কম বলা হবে। বলা উচিত, যথার্থ পর্যবেক্ষণ।
ভালো লাগে পরিচালক তথাগত মুখার্জির ইতিবাচক কথা–”কুমারদাকে এটাই বলার, ক্ষমতা প্রদর্শনী বন্ধ করতে পারে, সিনেমার অভিঘাতকে নয়। তোমার সিনেমা নিজগুণে যদি কালের সীমা অতিক্রম করতে পারে, মানুষের মননে স্থান তৈরি করতে পারে, তবে, হলে চলা না চলার সঙ্গে ব্যবসায়িক লোকসান জড়িয়ে থাকতে পারে। কিন্তু,সিনেমার সুদুরপ্রসারি প্রভাবকে, কোনও ক্ষমতা কোনও অর্থ–কেউ আটকাতে পারবে না। চিনার পাতা তার নিজ গুনেই থেকে যাবে সিনেমার ইতিহাসে।” তাঁর কথারও খানিকটাই লিখলাম এখানে। বলেছেন আরও অনেক জরুরি কথা।
‘প্রিয় চিনার পাতা, ইতি সেগুন’ দেখতে এসে উচ্ছ্বসিত, আবেগতাড়িত হয়েছেন দেবদূত ঘোষ, সুদীপ্তা চক্রবর্তী প্রমুখ অভিনেতারা। এই যে বাংলা ছবির অন্য পরিচালক বা অভিনেতারা স্বতস্ফূর্ত ভাবে এই ছবি সম্পর্কে নিজেদের অনুভব ব্যক্ত করতে এগিয়ে আসছেন, এটা খুব ছোট ব্যাপার কিন্তু নয় ! মাত্র তিনটি সপ্তাহের হল-প্রদর্শনে এমন ঝড় তুলে দেওয়া শেষ কবে দেখেছে কলকাতার বাঙালি সিনেমাপ্রেমী বা সিনেমা জগৎ ? তাও কোনও রকম তারকা চমক, ভরপুর একশন, বিদেশে শুটিং বা গ্রাফিক্স-এর ম্যাজিক ছাড়াই। জীবনের রঙিন মোড়ক নয়, যাপনের নগ্ন ও কঠিন বাস্তবের হাত ধরে চলা কিছু মানুষের কথা সততার সঙ্গে বলেছেন কুমার এ ছবিতে। আর সেটাই তুমুল সাড়া জাগিয়েছে সকল দর্শকের মনে। এই প্রেক্ষিতে আশিসকুমার মজুমদার যথার্থই বলেছেন, “আপনার তৈরি ‘প্রিয় চিনার পাতা, ইতি সেগুন’ দেখলাম। আপনাদের পুরো টিমকে অভিনন্দন।
রাজনৈতিক কারণে উদ্বাস্তু হওয়া বিপন্ন মানুষের সীমাহীন যন্ত্রণার মতো একটা শক্ত বিষয়বস্তুকে নিয়ে এই ধরনের প্রযোজনা অবশ্যই একটা সাহসী পদক্ষেপ। অত্যন্ত সীমিত সংখ্যক কুশীলব বা অভিনেতা অভিনেত্রীর মুখে বলা সহজ সরল সংলাপের মাধ্যমে অভিনয়। এইরকম উদ্বাস্তু মানুষের সামাজিক অবস্থান চ্যুতির বিষাক্ত দংশনের যন্ত্রনা এই ছবিতে যেভাবে দর্শকহৃদয়ে হাতুড়ির ঘায়ের আঘাত হানে, তা অবশ্যই পরিচালকের বলিষ্ঠ পরিচালন ক্ষমতার গুণে।” বলা বাহুল্য, এনার ক্ষেত্রেও বক্তব্য হিসেবে লেখার অংশবিশেষ মাত্র জানালাম !
শুভাশিস মণ্ডল বলেছেন, “অবিলম্বে সহৃদয় ডিস্ট্রিবিউটর এগিয়ে এসে, আরও দর্শকের দরবারে এই ছবিকে পৌঁছে দিন। ক্ষুদ্র স্বার্থে নয়, বৃহৎ স্বার্থে এই ছবির পাশে দাঁড়ান। নইলে, আগামীর সিনেমাপ্রেমীরা আপনাদের মার্জনা করবেন না!” খুবই অর্থবহ তাঁর বক্তব্য। আমি এর সঙ্গে যোগ করতে চাই, সেইসব সিনে ক্লাব, সংগঠন, যাঁরা জেলায় জেলায়, মফস্বলে নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে ভালো ছবি দেখান, তাঁদের কথা। তাঁদের কাছে অনুরোধ, আপনারাও এগিয়ে আসুন। এ ছবির গল্প কোনও বিশেষ অঞ্চলের মানুষের নয়। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে এমন অগণিত মানুষ। দেশ-কাল ভেদে তাঁদের নাম ও পরিচয় বদলায়। কিন্তু বেঁচে থাকার লড়াইটা একই থাকে।
প্রশংসার উষ্ণ বাতাস উড়ে এসেছে সীমানার ওপার থেকেও। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের মনজুরুল ইসলাম মেঘের অবস্থাটা ঠিক আমারই মতো। তিনিও ছবিটি দেখতে পারেননি। কিন্তু মনে মনে সঙ্গী হয়ে গেছেন চিনার পাতার উড়ানের। তাঁর কথায় শুনুন সেই আবেগের প্রতিধ্বনি–”আমাদের পশ্চিমবঙ্গের বন্ধু কুমার চৌধুরী এবং পিয়ালী চৌধুরীর ছবি ১২ তারিখ মুক্তি পেয়ে টানা চলছিল নন্দনে। একটু আগে জানতে পারলাম আগামিকালই লাস্ট শো। কলকাতার বন্ধুদের দেখার আমন্ত্রণ জানালাম। অসাধারণ এই সিনেমা আমাদের Cinemaking International Film Festival 2021-এ মনোনীত হয়েছিল এবং প্রশংসা অর্জন করেছে। বহু দেশে ‘প্রিয় চিনার পাতা, ইতি সেগুন’ প্রদর্শিত হয়েছে, প্রশংসাও অর্জন করেছে। শুভ কামনা ছবিটির জন্য।”
এত মানুষের আবেগ ও শুভকামনা কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের জন্য ব্যর্থ হয়ে যাবে ? ব্যর্থ হয়ে যাবে এক সৃজনশীল দম্পতির স্বপ্ন ? নাহ নেতিবাচক মন নিয়ে এই প্রতিবেদন শেষ করতে চাই না আমিও। সমকাল কুমারের ছবির কদর করেছে। মাত্র তিন সপ্তাহের সময়সীমায় অনেকেই রিপিট শো দেখেছেন। কেউ কেউ আর একবার দেখার পরিকল্পনা করছিলেন। এই সবই কুচক্রী অসাধুদের মুখের ওপর জবাব। কোনও রকম প্রচারের আনুকূল্য ছাড়াই, শুধুমাত্র লোকের মুখে মুখে ছাড়িয়েছে ‘প্রিয় চিনার পাতা, ইতি সেগুন’-এর নাম। ভালো সিনেমার পক্ষে নিঃসন্দেহে এটা সুলক্ষণ ! বাকি রইলো বাণিজ্যিক সাফল্য। বহু বাণিজ্যসফল বস্তাপঁচা ছবি আলোর মুখ দেখে হারিয়ে গেছে। ‘প্রিয় চিনার পাতা, ইতি সেগুন’ কিন্তু ইতিহাস সৃষ্টি করে ফেলেছে তার স্বতন্ত্র ব্যঞ্জনার গুণে। সেটা কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।
এরপর এ ছবি হয়তো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের দৌলতে সারা বিশ্বের মানুষ দেখবে। তবে, তার জন্য দর্শকের এমন বিশাল চাহিদা থাকা সত্ত্বেও ‘প্রিয় চিনার পাতা, ইতি সেগুন’ হল থেকে তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত সমর্থনযোগ্য নয়। অবাক করে দেয়, এই সময়ের তথাকথিত প্রতিষ্ঠিত পরিচালক, অভিনেতাদের একাংশের নিরুত্তাপ উদাসীনতা। বাংলা সিনেমা নিয়ে তাঁদের সব আবেগ তাহলে নিছক কুমীরের কান্না ? মেনস্ট্রিম মিডিয়ার কথা তো আগেই বললাম। আর কতকাল গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসাবে তারা ?
শেষে আর একবার অন্তর থেকে দীর্ঘ এক কুর্নিশ কুমার ও পিয়ালীকে। কুমার একজন শক্তিশালী অভিনেতা। অসাধারণ থিয়েটার ব্যাকগ্রাউন্ডের অধিকারী। শুধু অভিনয় করে গেলে যথেষ্ট আর্থিক স্বচ্ছলতার মধ্যে জীবন কাটিয়ে যেতে পারতেন। যেমনটা অনেকেই করেন। কিন্তু নিজের শেষটুকু দিয়ে একটি মহৎ সিনেমা বানাতে চেয়েছেন। সৎ সিনেমা নির্মাণের আদর্শ তাঁর মধ্যে এসেছে এই বাংলার ঋত্বিক ঘটক, সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তপন সিংহ প্রমুখর উত্তরাধিকার সূত্রেই। সেই আদর্শ ব্যর্থ হবে না। পিয়ালীর মতো এক শক্তিময়ী আছে কুমারের পাশে। নিছক নিটোল ধনসম্পদের মোহ ছুঁড়ে ফেলা নয়, নিজের চরম শারীরিক অসুস্থতাকেও অগ্রাহ্য করে ‘প্রিয় চিনার পাতা, ইতি সেগুন’ এর মতো ছবি নির্মাণ সম্ভব করেছেন তিনি, কুমারের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে।
আর্থিক সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে এক স্বাধীন ছবির প্রযোজক-পরিচালক যা যা করতে পারে, সবই করেছেন ওঁরা। এবার আমাদের দায়িত্ব এর পাশে দাঁড়ানো। যাঁর যেখানে যতটুকু ক্ষমতা আছে, নন্দন কর্তৃপক্ষের এই হিটলারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করুন। সোস্যাল মিডিয়ায় নানা অকিঞ্চিৎকর বিষয়ে দিবারাত্র ঝড় তুলি আমরা। এই ছবির ক্ষেত্রে কোথায় সেই প্রতিবাদের ঝড় ?! আজ যদি আমরা চুপ করে থাকি, তাহলে, উত্তরকাল কিন্তু আমাদের ক্ষমা করবে না।