উপন্যাস : কৃষ্ণসঙ্গিণী রুক্মিণী।সুচেতনা সেন কুমার।প্রজ্ঞা পাবলিকেশন|পাঠ প্রতিক্রিয়া
লিখলেন – গৌতম বিশ্বাস
উপন্যাস : কৃষ্ণসঙ্গিণী রুক্মিণী
লেখক : সুচেতনা সেন কুমার।
প্রকাশক : প্রজ্ঞা পাবলিকেশন
মুদ্রিত মূল্য : ৩৮০/- টাকা
বাঁধাই – হার্ড বাউন্ড
—————————–
✪ কিছু কিছু উপন্যাস আছে , যে উপন্যাস পড়া হয়ে যাওয়ার পরেও তার রেশ থেকে যায় বহুক্ষন। এই কৃষ্ণসঙ্গিণী রুক্মিণী উপন্যাসটি ঠিক সেইরকমই একটি উপন্যাস। আমরা সাধারণত যে সমস্ত পৌরাণিক চরিত্রের উপরে লেখা উপন্যাস পাই , তারমধ্যে শ্রীকৃষ্ণের পত্নী তথা মহারানী রুক্মিণীর চরিত্রটিকে খুব কম খুঁজে পাই , আবার পেলেও সেখানে যৎসামান্য পরিচয়টুকু ছাড়া বিশেষ কিছু পাইনা। এই উপন্যাসটি আমাদের অর্থাৎ পাঠকদের সেই আক্ষেপ মিটিয়ে দিয়েছে।
★ প্রথমেই মাননীয়া লেখিকা যে সমস্ত মূল গ্রন্থ থেকে তাঁর এই উপন্যাসটি লেখার জন্য সাহায্য নিয়েছেন সেই গ্রন্থগুলোর নাম উল্লেখ করছি –
(০১) মহাভারত , অনুবাদ – হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ।
(০২) হরিবংশ , অনুবাদ – চন্দ্রমোহন তর্করত্ন।
(০৩) হরিবংশ , অনুবাদ – দীপক চন্দ্র।
(০৪) ভাগবত পুরাণ , সম্পাদনা – শ্রী সুবোধচন্দ্র মজুমদার।
(০৫) বিষ্ণুপুরাণ , অনুবাদ – পঞ্চানন তর্করত্ন।
(০৬) স্কন্দপুরাণ , অনুবাদ – পঞ্চানন তর্করত্ন।
(০৭) রামায়ণ , অনুবাদ – পঞ্চানন তর্করত্ন।
(০৮) ব্রক্ষ্মবৈবর্ত পুরাণ , অনুবাদ – পঞ্চানন তর্করত্ন।
★ এই কৃষ্ণসঙ্গিণী রুক্মিণী উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে প্রথমেই যে অংশটুকু আমার দৃষ্টিতে সবথেকে বেশী আকর্ষনীয় বলে মনে হয়েছে সেই অংশটুকু হ’ল লেখা শুরুর আগে লেখিকা মহাশয়া বলেছেন যে তিনি প্রথমে উপন্যাসটির নাম ‘কৃষ্ণভার্যা’ রাখবেন ঠিক করেছিলেন কিন্তু পরে তিনি উপন্যাসটির নামকরণ করেন ‘কৃষ্ণসঙ্গিনী রুক্মিণী’ , কারণ “ভার্যা” মানে যাঁকে ভরনপোষণ করা হয়। রুক্মিণীর সাথে ঠিক ভার্যা শব্দটি খাপ খায় না।
➤ একদমই ঠিক বলেছেন লেখিকা মহোদয়া। সত্যিই তো দেবী রুক্মিণী কী সত্যি সত্যিই শ্রীকৃষ্ণের ভরনপোষণের উপর নির্ভরশীল ছিলেন ?
➤ ভেবে দেখুন তো , শ্রীকৃষ্ণ যখন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জুনের সারথী , বলরাম তখন তীর্থ ভ্রমণ করছেন ! ঠিক ঐ সময় সমগ্র দ্বারকাকে কে পরিচালনা করছিলেন ?
➤ স্বয়ং কেশব যখন সমগ্র ভারতবর্ষের ভাগ্য নির্ধারণ করছিলেন , তখন ভিতর থেকে কে শ্রীকৃষ্ণের চালিকাশক্তি হয়ে তাঁর ঘর অর্থাৎ দ্বারকাকে সামলাচ্ছিলেন ?
✪ উপন্যাসের শুরুতেই দৃষ্টি আটকে যাবে দ্বারকার মহাদেবী রুক্মিণীর একটি মন্তব্যে – “শোন গাণ্ডীবী , আমি দ্বারকাধীশ কৃষ্ণের পট্টমহিষী , দ্বারকার মহাদেবী রুক্মিণী। মুকুন্দ ভিন্ন আমি কাউকে অনুসরণ করিনি , করবও না। তুমি প্রস্থান করতে পারো”।
➤ এখানে মহাদেবী তাঁর দার্ঢ্য দেখালেন কাকে ?
➤ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনূর্ধর অর্জুনকে !
➤ হ্যাঁ ঠিক এইখানেই রুক্মিণী শ্রীকৃষ্ণের অন্যান্য পত্নীদের থেকে সম্পুর্ন স্বতন্ত্র , তাঁকে ভার্যা শব্দটির দ্বারা অভিহিত করা বোধহয় সঙ্গত নয় , তিনি সঙ্গিনী।
➤ স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গিনী।
★ এবার আসা যাক স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের কথায় – বিদর্ভের রাজকুমারীর রূপের কথা শ্রীকৃষ্ণ শুনেছিলেন। কিন্তু রাজকুমারীর রাজনীতিতে জ্ঞান , প্রজাদের প্রতি স্নেহশীলতা শ্রীকৃষ্ণের মননে রুক্মিণীর একটি আলাদা চিত্র তৈরী করেছিল। একসময় যমুনার তীরে শ্রীরাধিকার নিক্কণ আর কেশবের বাঁশীর শব্দে যে প্রেমের স্রোত বয়ে যেত সেই প্রেম নয় , বর্তমানে কেশবের প্রয়োজন বৈদর্ভীর আশ্রয়। দেবী রুক্মিণী কেশবকে ভালোবেসেছিলেন এটা যেমন ধ্রুব সত্যি , ঠিক ততটাই ধ্রুব সত্যি ছিল দেবী রুক্মিণীর রাজনৈতিক জ্ঞান তথা রাজকার্য পরিচালনার ক্ষমতা শ্রীকৃষ্ণেরও প্রয়োজন ছিল।
★ এই উপন্যাসে মহাদেবী রুক্মিণীর সাথে আরও অনেক চরিত্রদের মাননীয়া লেখিকা বাস্তব আর তাঁর কল্পনার মিশেলে তৈরী করেছেন , যেগুলো আমার কাছে খুব সুন্দর লেগেছে। এই উপন্যাসটি পড়ার পর আমি বা আমার মতো অনেক মানুষই জানবেন যে “একলব্য” জন্মসূত্রে আদৌ নিষাদ ছিলেন না , তিনি ছিলেন একজন যাদব সন্তান , যাঁকে নিষাদরাজ নিজের পুত্র পরিচয়ে বড় করেছিলেন।
➤ তাহ’লে কে ছিলেন একলব্যের পিতা ?
➤ “দ্রোণাচার্য” যিনি আজীবন যে পক্ষপাত দোষে অভিযুক্ত হয়েছিলেন , সত্যিই কী তিনি একলব্যের দক্ষিন হস্তের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ চেয়েছিলেন , না রূপকের অন্তরালে তিনি অন্যকিছু চেয়েছিলেন ?
★ বৈদর্ভীর চোখে যে ক্লান্তি , এই ক্লান্তি কিসের দ্যোতক ?
➤ সে কী জরাসন্ধকে নিয়ে চিন্তিত ?
➤ উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে আমরা পাই দ্বারকার ভৌগোলিক পরিমণ্ডলের অবস্থা , এই দ্বারকা যে যাদবদের সুরক্ষিত আবাসস্থল হ’তে পারে এটা একমাত্র বুঝতে পেরেছিলেন বোধহয় স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। তাই এখানেও আমরা তাঁর রাজনৈতিক কুশলতাসম্পন্ন দুরদৃষ্টির পরিচয় পেয়েছি ?
➤ কিন্তু কী ছিল সেই রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ?
★ উপন্যাসে বৈদর্ভী আর কেশবের বিবাহকে অক্রূর বারংবার রাক্ষস বিবাহ বলেছিলেন কিন্তু সেখানে স্বয়ং কৃষ্ণ বলেন – ‘হত্বা ছিত্ত্বা চ শীর্ষাণি রুদতাং রুদতীং গৃহাৎ’ এই নীতি গৃহীত হয়নি তাই এটা রাক্ষস বিবাহ নয় , গান্ধর্ব মতে বিবাহ।
➤ দেবী রুক্মিণী যখন বুঝতে পারেন যে তিনি ভারতের আগামী ভাগ্যবিধাতার পত্নী হয়ে গিয়েছেন তখন তাঁর মানসিক অবস্থা ঠিক কিরকম ছিল ?
➤ দেবী রুক্মিণীর কৃষ্ণের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসার প্রমাণ আমরা পাই তাঁর নিজস্ব একটি আত্মগত চিন্তনে – “কাম দাম্পত্যের প্রয়োজনীয় অঙ্গ , কিন্তু তার ব্যাপ্তি ক্ষণস্থায়ী কিন্তু প্রেমের যে নির্ভরতাময় বহিঃপ্রকাশ ঘটে তা কিন্তু চিরস্থায়ী”। এই একটি মাত্র বাক্য , যে বাক্য প্রমাণ করে দেবী রুক্মিণী কেশবকে ভালোবাসতেন।
➤ কিন্তু কেশব ?
➤ তাঁর কাছে কী দেবী রুক্মিণী ভালোবাসার মানুষ , না শুধুই রাজনৈতিক প্রয়োজনে প্রয়োজনীয় একজন প্রেমিকা তথা পত্নী ?
★ উপন্যাসটিতে আমরা পাই দ্রৌপদীর সৃষ্টি এবং কৃষ্ণার স্রষ্টাকে , পাই পাণ্ডবদের চাতুরী এবং স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের রাজনৈতিক কর্মকুশলতার বিভিন্ন উদাহরণ।
★ উপন্যাসটি যে’হেতু দেবী রুক্মিণীকে কেন্দ্র করে লেখা তাই আমি উপন্যাসের কৃষ্ণা তথা দ্রৌপদী সম্পর্কিত কোন অংশকে বিশ্লেষণ ক’রলাম না। ঐ অংশটি থাক আগ্রহী পাঠকদের জন্য।
➤ সবশেষে এটা অতি অবশ্যই স্বীকার ক’রতে হ’বে দেবী রুক্মিণীকে নিয়ে বাংলা সাহিত্যে এইরকম একটি উপন্যাস আমি প্রথম পড়লাম। অসংখ্য ধন্যবাদ লেখিকা সুচেতনা সেন কুমার মহাশয়াকে এতো সুন্দর একটি উপন্যাস পাঠকদের উপহার দেবার জন্য। যাঁরা পৌরাণিক কাহিনী পড়তে ভালোবাসেন আশা করছি এই উপন্যাসটি অবশ্যই পাঠকপ্রিয় হ’বে সেই সমস্ত পাঠকদের কাছে ।
★★ চরৈবেতি ★★
—————————–
প্রাপ্তিস্থানঃ
- প্রজ্ঞা পাবলিকেশনের নিজস্ব বিপণী। বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট, প্যারামাউন্টের ঠিক বিপরীতে।
- ঘরে বসেই বইটি হাতে পাওয়ার জন্য WhatsApp করুন 9147364898 – এই নম্বরে।
অন্যান্য প্রাপ্তিস্থান –
- দে বুক স্টোর (দীপুদা)
- জানকী বুক ডিপো (সুখরঞ্জন দা)
- বইবন্ধু