উবার উবাচ
জীবন নিজেই এক রঙিন জলছবি। চলার পথে কত না বাঁক! প্রতি মুহূর্তে নিজেই সে নিজের রঙ বদলায়। সেই বিচিত্র জীবনের কথা এই বিভাগে। পড়ছেন অজন্তা সিনহার কলমে।
জন্ম ইস্তক যে শহরে কাটিয়েছি, সে শহর ইদানীং বেশ অচেনা। আসলে আমি বুড়ি হয়েছি আর শহরের বয়স বাড়লেও ক্রিম-পাউডার মেখে ক্রমশ তরুণী সে। কলকাতা এখন দৃশ্যত তিলোত্তমা, একথা মানতেই হবে। উত্তরবঙ্গে পাকাপাকি চলে যাওয়ার পর ইদানীং কলকাতায় এসে এই অনুভূতিটাই ঘুরেফিরে মনে আসে। দ্রুতগতি আর অতি ভিড়ের এই শহর আজকাল প্রায়ই মনে করিয়ে দেয়, এখানে পুরোপুরি ব্রাত্য আমি এখন। বাসে, ট্রামে বা বহুল প্রচলিত পাতাল রেলে এদিক ওদিক যাওয়ার অভ্যাস চলে গেছে বললেই হয়। অগত্যা ভরসা ট্যাক্সি।
এখন শহরের পথে-ঘাটে ক্রম বর্দ্ধমান ওলা-উবার। হলুদ ট্যাক্সির প্রাচীন ছন্দে পতন ঘটেছে অনেক আগেই। বলা বাহুল্য, ট্যাক্সি চালকদের ধারাবাহিক অসহযোগের ফলেই ওলা-উবারের বাড়বাড়ন্ত। এতে যাতায়াতের বাজেট অনেকটাই পকেট-আনফ্রেন্ডলি হলেই বা কি করনীয় ! ছয়-ছয়টি বসন্ত পার করার পর এক দৌড়ে বাসে ওঠা, মেট্রোরেলের গর্ভে ঝাঁপিয়ে পড়ে জায়গা করে নেওয়া ইত্যাদি এখন ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। হলুদ ট্যাক্সির কথা তো আগেই বললাম। অতএব বাজেট ক্রস করার ব্যাথা বুকে চেপেই আরও অনেকের মতো কলকাতায় এলেই ওলা-উবারে সওয়ারি এই অধমও।
এটা অতিমারীর আগে, শেষ যেবার কলকাতায় যাই, তখনকার অভিজ্ঞতা। সময়টা নভেম্বরের শুরু। তবু কলকাতার বাতাসে প্রবল উত্তাপ। ঘেমেনেয়ে উবারের গর্ভে ঢুকলেই, মেলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের আরাম। তখন আর সত্যি হিসেবের কথাটা খেয়াল থাকে না। এমনিতে ওলা এবং উবার, ভাড়ার ক্ষেত্রে পারদ চড়িয়ে দিতে কেউই কম যায় না। দু’পক্ষেরই আবার সময়ের হিসেবে ভাড়া ওঠানামা করে। এত কিছুর পরেও বলবো, আমি প্রতিবারই উবারের ভাড়াই তুলনায় কম পেলাম। অতএব উবার জিন্দাবাদ।
অভিজ্ঞতায় এও দেখলাম, যেদিকেই যাই, কয়েকটা বিষয় কমন। সেটা হলো ড্রাইভারদের সেলফোন চর্চা, এফএম বা মিউজিক সিস্টেম শোনা, তুলনায় কম চেনা জায়গায় ওদের নিজেদের ম্যাপ মেনে চলতে গেলে হারিয়ে যাওয়া। সেলফোন চর্চার কথাই যদি ধরি, গাড়ি কিছুটা চলার পরেই রাহুল, অরুণ, মিঠুন, ইয়াসিন, বরুণ, সুরেশ, শ্যামল প্রমুখের কানে ফোন। এঁরা উবারের চালক। বিভিন্ন বয়সী। কেউ বাঙালি, কেউ বা ভিন রাজ্যের। ভাষাতেও তেমনই মিশ্র প্রভাব। হয় বান্ধবী (এটা জাস্ট কথোপকথনে বুঝে নিতে হয়), নয় অন্য উবারের চালক। স্ত্রী, মা, ভাইও হতে পারে। কারও না কারও সঙ্গে এঁদের বাক্যালাপ চলতেই থাকে।
আমাদের সবার ক্ষেত্রেই সচরাচর যেটা ঘটে, পারিবারিক কথায় কোনও সীমারেখা টানা যায় না। প্রেমালাপ তো আরওই সীমাহীন। অন্য উবারের চালকদের সঙ্গে কথাবার্তার ব্যাপারটা অবশ্য পাক্কা পেশাদারি টেনশন, ‘তুই কাল কটা রাইড করলি’, ‘আমার আজ এখনও দুটোর বেশি হলো না’ গোছের। সেলফোনে কথা বলতে বলতে গাড়ি চালানো উচিত নয়, বার কয়েক এই সুপরামর্শ দিতে গিয়ে দেখলাম, তাতে স্থায়ী কোনও কাজ হচ্ছে না। বেশিরভাগ ড্রাইভারের এটাই স্টাইল। ক্ষণে ক্ষণে তাদের ফোন বাজে আর কথার স্রোত বয়ে যায়।
এফএম রেডিওর ক্ষেত্রে গানেরই প্রাধান্য। তাছাড়াও ‘সানডে সাসপেন্স’ জাতীয় রহস্য সিরিজের ভালো ডিমান্ড রয়েছে। যারা এফএম বা গাড়িতে লাগানো মিউজিক সিস্টেম চালিয়ে ড্রাইভিং করে, তাদের ক্ষেত্রে এমনিতে টেনশন কম, কানটা তো অন্তত খোলা ! অর্থাৎ দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা কম। রহস্য কাহিনি পর্যন্তও চলতে চলতে শোনা যায়। কিছুক্ষণ সময়ের জন্য হলেও একটু ভিন্ন স্বাদ ! কিন্তু গান ? মুষ্টিমেয় ড্রাইভার ভালো গানের কদর করে। সেটা চলার পথে শুনতে মন্দ লাগে না। কিন্তু ইদানীং বেশ কিছু গান কিছু ড্রাইভারের নির্বাচনে থাকে, যেগুলো তৈরি হয়েছে শ্রোতার কান, মনন ও মস্তিষ্ককে চিরতরে যমের বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। উবার-চারণ কালে বেশ কয়েকবার এমনই দশা হলো আমার। বলা বাহুল্য, সবটাই ড্রাইভার ভেদে বদলে যায়।
সব থেকে বিড়ম্বনা জিপিএস ট্র্যাকিং-এর পাগলপনা ! ডিজিটাল ইন্ডিয়ার ডিজিটাল মস্করা। সব রাস্তার হালহকিকত জানা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। তার মধ্যে তিলোত্তমা এখন প্রতি মুহূর্তেই আরও রূপসী হওয়ার প্রক্রিয়ায় সতত ক্রিয়াশীল। এমন অবস্থায় উবার বা ওলা, যেটাই হোক, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের আরামের ঘেরাটোপে বসে কে আর জানালার কাচ তুলে রাস্তার লোক থামিয়ে ঠিকানা খোঁজে ? হিসেব মতো, গন্তব্যের ঠিকানা লিপিবদ্ধ করে নিশ্চিন্ত আরামে জিপিএস ম্যাপের ভরসায় বসে থাকারই কথা। কিন্তু যেটা ঘটে, প্রায়ই রাস্তা হারিয়ে বাড়তি কড়ি গোনার অভিজ্ঞতা হয়, যা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়। ঠিকানায় সময়ে না পৌঁছনোর হয়রানির কারণেও ভুগতে হয়।
যে রাস্তা চিনি না, তার কথা নাহয় ছেড়েই দিলাম। চেনা অঞ্চলে ঢুকেও দেখেছি, ঘুর পথে ঠিকানার খোঁজে চক্কর কাটছে গাড়ি। ড্রাইভারকে বলতেই জবাব ওই ‘জিপিএস সূত্র’ ! এরপর আর কি যুক্তি দেখাবো ? ডিজিটাল ব্যাবস্থার কাছে আমার এই ছোট মাথার কিই বা দাম ! উবার চর্চার ক্ষেত্রে আমার এহেন দিকদর্শনে পাঠক শুধুই নেতিবাচক ভাবনার প্রতিফলন ঘটছে, এ অভিযোগ আনতেই পারেন। তবে, অভিজ্ঞজন নিশ্চয়ই সহমত হবেন।
এক্ষেত্রে একটা কথা উল্লেখ্য, কানে সেলফোন নিয়ে গাড়ি চালানোর অভ্যাসটুকু ছাড়া ড্রাইভারদের নিয়ে তেমন নিন্দার কিছু পাইনি। আমার-আপনার মতোই খেটে খাওয়া মানুষ ওরা। সবাই দিন যাপনের সংগ্রামে ব্যস্ত। যাঁরা ভিন রাজ্যের বাসিন্দা, তাঁদের লড়াই কঠিনতর। চলার পথে সুযোগ পেলেই তাদের সঙ্গে আলাপকালে জেনেছি মানুষগুলির অন্তরকথা। তাদের সম্পর্কে যে অভিযোগগুলি প্রায়ই ওঠে, সেসব মুষ্টিমেয় মানুষের কাজ। সে তো সব পেশাতেই আছে। বেশিরভাগই ভালো।
প্রতিবেদনের শেষে এক মন ভালো করা অভিজ্ঞতার গল্প। মনোহরপুকুর রোড থেকে উবারে উঠেছি। যাব নাকতলা। গাড়ির চালক এক তরুণ, দেখে মনে হলো সদ্য কৈশোরের গন্ডি পার হয়েছে। ওঠার পরেই কানে ফোন। বিরক্ত হলাম। ভাবছি, কিছু বলবো। তার আগেই কানে এলো ফোনের কথোপকথন, “হ্যালো দিদা, ঘরে আছো ? আমার জন্য একটু আলুসেদ্ধ ভাত করবে। আর কিচ্ছু লাগবে না। খুব খিদে পেয়েছে। সকাল থেকে গাড়ি চালাচ্ছি।” উল্টোদিকের কথা শোনা না গেলেও বুঝলাম তার খাবারের ব্যাবস্থা হয়েছে।
তারপর কথায় কথায় ছেলেটি জানায়, তার দিদিমার বাড়ি বাঁশদ্রোনি। নাকতলার কাছে, অতএব এখানেই দুপুরের খাওয়াটা খেয়ে নিলে তার সুবিধা। লাজুক হেসে বলে, “দিদিমার বয়স হয়েছে। তাঁকে বিরক্ত করতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু কি করবো? এরপর আর খাওয়ার সময় পাব না।” যেতে যেতে দিদিমার নানা গল্প। তাঁকে বারণ করলেও শুধু আলুসেদ্ধ ভাত দেবেন না। ফ্রিজ থেকে মাছ বের করে রান্না করবেন। নাহলে দোকান থেকে ডিম এনে কারি বানাবেন। অতি সাধারণ যাপনকথা। একেবারেই চেনা জীবনের ছন্দ। অথচ কি মধুর ! কি অমূল্য উপলব্ধি ! যাকে বলে কুড়িয়ে পাওয়া সম্পদ ! সেদিন গন্তব্যে পৌঁছই সেই মাধুর্য্য নিয়েই।
ছবি প্রতীকী