Monday, February 3, 2025
দর্পণে জীবন

একাকীত্ব দূর করে ভার্চুয়াল শুভেচ্ছাবার্তা

জীবন নিজেই এক রঙিন জলছবি। চলার পথে কত না বাঁক! প্রতি মুহূর্তে নিজেই সে নিজের রঙ বদলায়। সেই বিচিত্র জীবনের কথা এই বিভাগে। পড়ছেন অজন্তা সিনহার কলমে।

ইদানীং ফেসবুকে মুখ্যত লেখা শেয়ার করে থাকি। সরাসরি লেখা পোস্ট আর হয়ে ওঠে না, যেটা একটা সময় ঘন ঘন চলতো। তারপর নানা কারণে কমতে কমতে ইদানীং একেবারে বন্ধ। সম্প্রতি অনেক দিন পর লিখলাম, উত্তরবঙ্গের নয়নাভিরাম প্রকৃতি নিয়ে, সেও কার্যকারণে। একটা শুটিংয়ে গিয়ে ডুয়ার্সের মেটলি চা বাগানের কিছু ছবি তুলি, যা দেখে আমার ফেসবুক বন্ধুকুল বড়ই পুলকিত হন ও তাঁদের আগ্রহেই লিখি ওই জায়গার বিষয়ে। তবে, এই প্রতিবেদন লেখার উদ্দেশ্য একেবারে অন্য–ফেসবুককে ঘিরেই এক ভিন্ন অনুভব প্রকাশে কলম ধরেছি আজ।

ঘটনাচক্রে আমার দু’খানা ফেসবুক একাউন্ট। দুটি একাউন্টের ক্ষেত্রেই কয়েকজন বন্ধু আছেন, যাঁরা সকাল-সন্ধ্যা নিয়ম করে মেসেঞ্জারে গুড মর্নিং, গুড ইভনিং পাঠান। কেউ কেউ গুড নাইটও। এঁদের অনেকের সঙ্গেই আমার সেই অর্থে কোনও ব্যক্তিগত সম্পর্ক নেই, ফেসবুকেই পরিচয়। এঁরা কিন্তু যথেষ্ট আন্তরিকভাবেই এই প্রভাতী ও অন্যান্য সময়ের শুভেচ্ছা সম্ভাষণ পাঠান। সারা বছর ধরে যে সব পালন, উদযাপন ঘটে আমাদের সামাজিক জীবনে, সেই উপলক্ষেও বার্তা বিনিময় চলে। জন্মদিন এলে তো কথাই নেই। শুভেচ্ছার বন্যা বয়ে যায়। আমি বেশিরভাগ সময় জবাব দিতে পারি না বললেই চলে। ইচ্ছাকৃত নয়, সময়ের অভাবটাই কারণ। মজা হলো, এঁরা কিন্তু তাই নিয়ে মোটেই মাথা ঘামান না। আমার প্রতি এঁদের যাবতীয় শুভবার্তা একেবারে ঝর্ণার মতো স্বতোৎসারিত। সেখানে উল্টোদিক থেকে কিছু প্রাপ্তির প্রত্যাশা থাকে না। ফেসবুক দেওয়ালের কথাও যদি বলি, সেখানেও যে কাজই করি–লেখা বা ছবি পোস্ট, কিছু ভালো লাগা বিষয় শেয়ার করলে, সবসময় সাড়া পাই। এক্ষেত্রে আমিও চেষ্টা করি, অন্যদের হাতের কাজ, গানের রেকর্ডিং বা ভালো কোনও পোস্ট দেখলে, আমার আগ্রহ বা মনোযোগ জনিত অভিব্যক্তি প্রকাশ করার।

নিছক ব্যাক্তিগত আবেগ প্রকাশের জন্য এই প্রতিবেদন নয়, সেটা পাঠক আশা করি বুঝবেন। এটাও ঠিক, ব্যাক্তিগত অনুভব থেকেই আমরা সমষ্টির পথে এগিয়ে যাই। সোস্যাল মিডিয়ায় আমাদের সক্রিয় ভূমিকা পালনের সময়কাল ইতিমধ্যেই দু’দশকের কাছাকাছি হয়ে গেছে বলা যায়। বন্ধুত্বের তালিকা দীর্ঘ হয়েছে। বন্ধুত্বের সম্পর্কে অনেক যদি-অথবা-কিন্তু যোগ হয়ে, আজ আমরা এমন এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে, যেখান থেকে উপলব্ধির প্রক্রিয়াটা শুরু হয়। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে এই উপলব্ধির মূল্য কম নয় ! অনেকেই অনেক খারাপ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন। আবার পাশাপাশি এমন মহৎ কিছু প্রাপ্তিযোগ ঘটেছে, যা এককথায় তুলনাহীন। এই সবকিছুর যোগবিয়োগ করলে দেখা যাবে, সবটুকুই আসলে পাওয়া। মন্দ অভিজ্ঞতাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এর পিছনে কিছু খারাপ মানসিকতার লোক নিশ্চয়ই আছে। আবার, আমাদের নিজেদের অন্ধ আবেগ, বিচারবুদ্ধি প্রয়োগে আলস্য, তাৎক্ষণিক আনন্দ প্রাপ্তির লোভ–এই বিষয়গুলিও দায়ী।

অনেকেই অভিযোগ করেন, আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কের রসায়ন তলানিতে ঠেকেছে এই সোস্যাল মিডিয়ার জন্য। উল্টোদিক থেকে এটাও কী বলা যায় না, তলানিতে ঠেকে যাওয়া সম্পর্ককে টেনে তুলেছে সোশ্যাল মিডিয়া, বিশেষত, হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক বা মেসেঞ্জার ! আত্মার সঙ্গে সম্পর্ক হলেই তো তাকে আমরা আত্মীয়তা বলি ! সেই আত্মীয়তার পরিভাষা যদি কেউ সোস্যাল মিডিয়ায় খুঁজে পান, অপরকে অনুভব করান, সেটা কী প্রশংসনীয় নয় ? অস্বীকার করবো না, জবাব দিই না দিই, আমি যে প্রতি সকালে বা সন্ধ্যায় শুভেচ্ছা বার্তা পাই, তা আমার মন ভালো করে দেয়। অনুভব করি, প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় যে মানুষগুলি একে অপরকে প্রত্যাশাবিহীন ভাবে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠান, সেটা মোটেই  মূল্যহীন নয়। এক মিনিট সময়ও কোনও মানুষ যখন আমার জন্য ব্যয় করছেন, আমি তখন তাঁর মনে রয়েছি। আজকের উদাসীন, আত্মকেন্দ্রীক, স্বার্থপর দিনে এই পাওয়াও কী কম ?

একটা সময় ছিল, কারও কারও মতো আমারও মনে হতো, এসব নিছক সময়ের অপব্যয়। এমনও ভেবেছি, লোকজনের সত্যি খেয়েদেয়ে কাজ নেই। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, আমার এই ভাবনা নিজের অন্তরের কাছেই লজ্জিত হয়েছে। ক্ষমা চেয়েছে সেই ভার্চুয়াল জগতের মানুষগুলির কাছে, যাঁরা ক্ষণিকের জন্য হলেও মনে রাখে তাঁদের চারপাশের পরিচিত মানুষদের। এই পরিচয় ভার্চুয়াল জগতকেন্দ্রীক হলেই বা কি ? মানুষগুলোর অস্তিত্ব তো আছে ! যে আমরা সোস্যাল মিডিয়াকে দিবারাত্র গালি দিই, তারা কী দেখছি না, দিনের পর দিন, একই ছাদের নিচে বসবাস করে আমরা একে অপরের কাছে কতটা অস্তিত্বহীন হয়ে যাচ্ছি। একা করে দিচ্ছি পাশের মানুষটিকে। আমার আজকের উপলব্ধি বলে, এই একা সময়ে এই তুচ্ছ শুভেচ্ছাবার্তা আর তুচ্ছ থাকছে না। বহু একা মানুষকে তাঁদের জীবনের প্রতি বিশ্বাস ফিরিয়ে দিচ্ছে। একে তাই কোনও ভাবেই নিছক সময়-নষ্ট, একথা আমি অন্তত বলতে পারলাম না। আপনারাও ভেবে দেখবেন বন্ধুরা।