এক গুঢ়, গোপন ও নীরব সম্পর্কের ইতিবৃত্ত ‘নীহারিকা’
নতুন ছবির মুক্তি হোক বা নির্মাণ। পোস্টার, ট্রেলার রিলিজ। ছবি হিট এবং ফ্লপ। তারকাদের জীবনের ওঠাপড়া। বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে সিনেমার দুনিয়ায় প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলেছে নানা বৈচিত্রপূর্ণ ঘটনা। সেইসবই এই বিভাগে, প্রতি সপ্তাহে। বিষয় ভাবনায় ব্যতিক্রমী ও সংবেদনশীল পরিচালক ইন্দ্রাশিস আচার্য, তাঁর ‘নীহারিকা’-য়। লিখেছেন চারুবাক।
আমরা সবাই জানি, প্রায় প্রতিটি একান্নবর্তী বা যৌথ পরিবারে বাবা-মা, ভাইবোন, কাকা-জ্যাঠা মিলে থাকার যেমন দেখনদারী সৌন্দর্য আছে–তেমনই তার একটু তলাতেই থাকে পারস্পরিক সম্পর্কের কিছু অস্পষ্ট, আভাসিত চেপে থাকা ও রাখা জটিলতাও। সেই জটিলতার অনেকটা জুড়ে থাকে পরিবারের ভিন্ন ভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষের মাঝে যৌনতার কানঘেঁষা সম্পর্ক! পরিচালক ইন্দ্রাশিস আচার্য তাঁর চার নম্বর ছবি ‘নীহারিকা’-য় তেমনই কয়েকটি চরিত্র নিয়ে গল্প নয়, ঘটনা সাজিয়েছেন।
বলতেই হবে, তাঁর চিত্রনাট্য সাজানোর মধ্যে রয়েছে গভীর মনন, সহানুভূতি ও সংবেদনশীলতা। বিষয়টি প্রকাশে কোথাও তিনি সম্পর্কের চেনা ‘নোংরামি’-কে জায়গা দেননি। বরং প্রধান দুই চরিত্র–ডাক্তারমামা আকাশ ও তরুণী ভাগ্নি দীপার সম্পর্কের রসায়নকে ইন্দ্রাশিস সস্নেহে সযত্নে মুড়ে, নিয়ে গিয়েছেন এক সুন্দর পরিণতিতে। সেখানেও দীপার হৃদয়ের অন্ধকার কোণে যে মামার জন্য চিনচিনে ব্যথাটা রইল, সেই ইঙ্গিতও রেখেছেন তিনি। অন্যদিকে আমরা দেখি, তার আকাশ মামা দীপাকে মানসিক ও শারীরিক অসুস্থতার সময় কী সুন্দর ডাক্তারি যুক্তির সাহায্যে নারী-পুরুষের শারীরিক মিলনের ব্যাপারটি বিশ্লেষণ করে দিচ্ছেন !
চিত্রনাট্যে আরও একটি গুরুত্বপূর্ন চরিত্র হচ্ছে ছোট মামী। সন্তানহীন, অসুস্থ স্ত্রী তার চোখের সামনে মামা-ভাগ্নির মেলামেশা দেখে নীরবে, কখনও বাঁকা দৃষ্টিতে অন্তর্জ্বালায় জ্বলেছে। কিন্তু প্রকাশ করেনি কিছুই। তাঁর অসময়ে মৃত্যুর কারণ হতেই পারে অবদমিত কষ্ট! ইন্দ্রাশিস স্পষ্ট করেননি কিছুই। কিন্তু কয়েকটি ক্লোজআপ শটে ইঙ্গিত রেখে গেছেন। আর এখানেই তিনি সাহিত্যকে অতিক্রম করে সিনেমার ভাষাকে এগিয়ে দিয়েছেন।
‘নীহারিকা’ সম্পূর্ণভাবেই অনুভবের ছবি। নিটোল গল্প থাকলেও, ইন্দ্রাশিস চিত্রনাট্য সাজিয়েছেন দুটি চরিত্রের অন্তরের অনুভূতি প্রকাশের তাগিদে। তাই এই ছবির লোকেশনও বেছে নেওয়া হয়েছে নিরিবিলি এবং রুক্ষ ও অনাবিল প্রকৃতির, মন কেমন করা শিমুলতলাকে। ছবির আলোকচিত্রী শান্তনু দে পরিচালকের ফটোগ্রাফিক সেন্সকে মনে রেখেই কোরিওগ্রাফি সাজিয়েছেন লংশট, মিড-লংশট এবং ক্কচিৎ ক্লোজআপ দিয়ে। শিমুলতলার ছোট্ট টিলা, অনামী ঝোরা, পাতলা জঙ্গল এবং সর্বোপরি নিস্তরঙ্গ পরিবেশ যেন ছবির চরিত্রদুটির না বলতে পারা, অসহায় দুঃখ-যন্ত্রণাকে জীবন্ত করে তোলে।
ইন্দ্রাশিস তাঁর প্রথম ছবি ‘বিলু রাক্ষস’ থেকেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি টালিগঞ্জের চলতি ভাবনার বাইরে দাঁড়িয়ে। পরবর্তী তিনটি ছবিতেও তিনি তথাকথিত বাণিজ্যিক ভাবনা ঝেড়ে ফেলে, আপোষহীন! ‘নীহারিকা’ তাঁর এ পর্যন্ত সেরা ছবি বলতেই পারি। কারণ, এমন সুগঠিত চিত্রনাট্য এবং তার সনিষ্ঠ চিত্রায়ন, চরিত্রগুলির প্লেসিং, ঘটনা পরম্পরার কোলাজ–নিঃসন্দেহে পুরোটাই আধুনিক সিনেমা ভাষার অনুসারী।
জয় সরকারের আবহ নিশ্চিতভাবে পরিচালককে সঙ্গ দিয়েছে। বিশেষ করে দ্বিজেন্দ্রগীতির ব্যবহার অসাধারণ এবং সুপ্রযুক্ত। এ ছবিতে প্রায় অদেখা দুই কলকাতার শিল্পী অনুরাধা ও মল্লিকাকে নির্বাচন করেও ইন্দ্রাশিস বাজারি টালিগঞ্জকে টেক্কা দিয়েছেন বলব। এঁরা দুজনেই অভিনয় করেননি, জীবন্ত চরিত্র হয়ে উঠেছেন! ছোটমামার চরিত্রে পরিচিত মুখ গায়ক শিলাজিৎ! তিনি ক্যামেরার সামনে আসেন খুবই কম, এলেই ছক্কা হাঁকান, সেটাও দেখি আমরা !!