ওটিটি প্ল্যাটফর্মে অভিনয়ের সুযোগ তুলনায় বেশি
নতুন ছবির মুক্তি হোক বা নির্মাণ। পোস্টার, ট্রেলার রিলিজ। ছবি হিট এবং ফ্লপ। তারকাদের জীবনের ওঠাপড়া। বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে সিনেমার দুনিয়ায় প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলেছে নানা বৈচিত্রপূর্ণ ঘটনা। সেইসবই এই বিভাগে, প্রতি সপ্তাহে। উত্তরপাড়ার সাবেকি বং সংস্কৃতির আবহে বেড়ে ওঠা বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী অমিকা শীল মুম্বইয়ের বিনোদন দুনিয়ায় কীভাবে নিজের জায়গা করে নিচ্ছেন, বিশেষ সাক্ষাৎকারে তারই ঝলক। কথা বলেছেন অজন্তা সিনহা।
বিনোদন জগতে তুমি পা রেখেছ শৈশবেই। কত বছর বয়স ছিল তখন তোমার ?
আমি যখন গান গাইতে শুরু করি, তখন আমার ৫ বছর বয়স। আমার মা টিঙ্কু শীল একজন গায়িকা। আমরা হাওড়া জেলার অন্তর্গত উত্তরপাড়ায় থাকতাম। অঞ্চলটি শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার জন্য ঐতিহাসিক ভাবে খ্যাত। মায়ের গানবাজনা চর্চা থেকেই অনুপ্রাণিত হই আমি এবং গান শিখতে শুরু করি শাস্ত্রীয় সংগীত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। মা-ই ছিলেন আমার প্রথম গুরু। পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের পর আমি মুম্বই চলে আসি। আর এই সময় থেকেই আমার পেশাদারী ভাবে গান গাওয়া শুরু হয়। তার আগে অবশ্য প্রচুর রিয়ালিটি শো-তে অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। সা রে গা মা, লি’ল চ্যাম্পস, আমূল স্টার ভয়েস অফ ইন্ডিয়া, ভারত কী শান ইত্যাদি শোয়ে অংশ নেওয়ার জন্য প্রায়ই মুম্বই আসতাম আমি। আর এভাবেই মুম্বই আমার দ্বিতীয় বাড়ি হয়ে গেছে বলা যায়। তবে, পুরোপুরি কেরিয়ার হিসেবে নিলাম পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে, পাকাপাকিভাবে এখানে থাকতে আসার পর।
গানের পাশাপাশি অভিনয়ও করছো। সেটা কী করে শুরু হলো ?
বেশ কয়েক বছর হয়ে গেছে আমার গানের জগতে। আমি সিনেমায় প্লেব্যাক করেছি। প্রচুর মিউজিক এলবামেও গেয়েছি। আমার নিজের মিউজিক এলবামও প্রকাশিত হয়েছে। আমার নিজের ইউটিউব চ্যানেল আছে, যার সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা ৮০ হাজারের ওপর। অর্থাৎ, আমি পুরোমাত্রায় গানেই ডুবে আছি। অভিনয়ের ব্যাপারটা আচমকাই ঘটে–অভাবিত ভাবে বলা যায়। এখন অভিনয় করছি, সেটাও দু বছর হয়ে গেল। মজার ব্যাপার হলো, একটা মিউজিকাল শোয়ের মাধ্যমেই আমার অভিনয়ের কাজটা শুরু হয়। প্রোডিউসারের একজন সিঙ্গার-এক্টরের দরকার ছিল। ওঁরা আমায় অফারটা দেন এবং আমি রাজি হয়ে যাই। যদিও, প্রথমে অডিশনে আটকে গিয়েছিলাম। কারণ, আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। পরে কাজ পাই এবং নিজেকে দরকার মতো গ্রুম করি। আমার প্রথম কাজ কালারস-এর ‘উড়ান’ সিরিয়ালে অভিনয়। এরপর টিভিতে আরও অনেক কাজ করেছি। এক্ষেত্রেও সুযোগ আসে অযাচিতভাবে। কাজ করেছি সিনেমায় এবং প্রচুর এড ফিল্মে।
ওয়েব সিরিজেও তো অভিনয় করেছ তুমি।
বেশ কয়েকটি কাজই করেছি। একটা কথা, ওটিটি প্ল্যাটফর্মের রমরমার পর অনেকের মতোই আমার কাছেও কাজের একটা বিরাট দরজা খুলে গেছে। আমার সৌভাগ্য, আমি মির্জাপুর ২, মাস্ক ম্যান, গন্দি বাত ৫, ছত্তিস আউর ময়না ইত্যাদি পপুলার সিরিজে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছি। সব মিলিয়ে এখনও পর্যন্ত আমার যা অভিনয়ের অভিজ্ঞতা, নিজের জার্নিতে খুশি আমি।
অভিনয়ের ক্ষেত্রে গান গাইতে পারাটা কতটা সাহায্য করেছে তোমায় ?
অবশ্যই সাহায্য করেছে। সঙ্গীত আমার প্রাণ এবং আমি সবার আগে একজন সঙ্গীতশিল্পীই হতে চেয়েছি। ইন্ডাস্ট্রিতে আমার জার্নিটা গান দিয়েই শুরু হয়। সেই ছোটবেলা থেকে গান গাইছি। জীবনের অনেকটা সময় সঙ্গীত প্রশিক্ষণ ও চর্চায় দিয়েছি আমি। এমনকী আমার অভিনয়ের ব্যাপারটাও গানের সূত্রেই আসে, যেটা আমি আগেই বলেছি। অভিনয় কখনও আমার স্বপ্ন বা কেরিয়ার প্ল্যানে ছিল না। এটা ভাগ্যক্রমে ঘটেছে বলা যায়।
অভিনয়ে আসার পরও তো গান গাইছ পেশাদারিভাবে। একসঙ্গে সবটা কীভাবে ম্যানেজ করো ?
হ্যাঁ। আমি এখনও একজন সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে পারফর্ম করি। যদিও, অভিনয়ে একটু বেশি ফোকাস করার ফলে গানের শো কিছুটা কমাতে হয়েছে। শুটিংয়ে ব্যস্ত থাকায় মিউজিক সংক্রান্ত এসাইনমেন্টগুলিতেও ততটা সময় দিতে পারি না। কিন্তু আমি গানের চর্চাটা নিয়মিত করি, রেওয়াজ ইত্যাদিতে সময় দিই। সম্প্রতি আমি ইজিপ্টে ওয়ার্ল্ড ইয়ুথ ফোরামে পারফর্ম করি, যেখানে সারা বিশ্বের নামকরা সঙ্গীতশিল্পীদের সঙ্গে এক মঞ্চে গাইবার সুযোগ ঘটে।
তোমার এই সব কাজে পরিবার থেকে কতটা উৎসাহ পাও ?
আমার পরিবার সবসময় আমার পাশে থেকেছে। আমি প্রায় রাতারাতি মুম্বই চলে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। বাবা মায়ের সমর্থন-উৎসাহ ছাড়া সেটা সম্ভব ছিল না। আমি একজন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। মুম্বই আসার ক্ষেত্রে টাকাপয়সার ব্যাপারটা অন্তরায় হতে পারতো। কিন্তু হলো না। আমার মা তাঁর যাবতীয় সেভিংস এ বাবদ খরচ করেছিলেন সেদিন। আমি শুরু থেকেই সব কাজে, তাঁদের পরামর্শ নিয়ে চলেছি। তাঁরাও সবসময় আমার প্রতি আস্থা রেখেছেন। আমার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন ও সম্মতি দিয়েছেন। গাইডও করেছেন দরকার মতো। যখনই মেগা ধারাবাহিকে কাজ করতে গিয়ে কোনও সংশয়ে পড়েছি, ওঁরা বলেছেন, ফোকাস ঠিক রাখো। যেটা করতে চাও মন থেকে, সেটাতেই মনোযোগী হও।
সিনেমা, টেলিভিশন ও ওয়েব মাধ্যম তিনটিতেই কাজ করেছ। কিছু পার্থক্য অনুভব করেছ কী ?
আমি যদিও টিভিতেই আমার একটিং কেরিয়ার শুরু করি এবং তার জন্য আমি যথেষ্ট কৃতজ্ঞও। তবু, আমি টিভিতে কাজ করায় ততটা আগ্রহী নই। অন্যদিকে, ওয়েব সিরিজে কাজ করাটা সিনেমা, টিভি দুটো থেকেই আলাদা। আমার সৌভাগ্য, আমি তিনটে মাধ্যমেই কাজ করেছি। তাই উপলব্ধি করেছি, তিনটি মাধ্যমই একে অপরের থেকে আলাদা। ওটিটি হলো, একেবারে ফ্রেশ একটি বিনোদন মাধ্যম, যেখানে স্বপ্ন দেখা নতুন অভিনেতারা সমান সুযোগ পায় কাজ করার, নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। আর একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এখানে একজন শিল্পীর চেহারা বিবেচ্য হয় না, গুণটাকেই দেখা হয়। অর্থাৎ কাজের ক্ষেত্রে নিরাপত্তাবোধের অভাব ঘটার সম্ভাবনা কম থাকে। সবাই এখানে মন খুলে কাজটা করতে পারে। সিনেমা বা টেলিভিশনে এটা মেলে না। এখানে তথাকথিত ভাবে একটা ‘স্ট্যান্ডার্ড বিউটি’ ঠিক করা থাকে এবং সবাইকে সেই ছাঁচে ফেলেই কাজ করানোর চেষ্টা চলে। ওটিটি প্ল্যাটফর্মে এটা হয় না। এখানে প্রতিটি চরিত্রের আলাদা গুরুত্ব বা পরিচয় থাকে। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, ‘চরিত্র’ই একজন অভিনেতাকে তাঁর শিকড় অর্থাৎ দাঁড়াবার জমিটা দেয়।
আর টেলিভিশনের ব্যাপারটা এখানে এমন, অভিনেতারা নিজেদের চরিত্রের জন্য প্রস্তুত করার সময়-সুযোগ কোনওটাই পান না। সাধারণত, শুটিংয়ের দিন তাঁদের হাতে স্ক্রিপ্ট দেওয়া হয়। সময় নেই। তাই হেয়ার ড্রেসিং বা মেকআপের সময়ই স্ক্রিপ্ট পড়ে নিতে হয় এবং বিষয়টা আত্মস্থ করতে হয়। এরপরেও রয়েছে, বিনা নোটিশে আচমকা স্ক্রিপ্ট বদলে যাওয়ার ট্রেন্ড। এটাও প্রায়ই ঘটে। সিনেমায় অন্তত একটি যথাযথ স্ক্রিপ্ট পাওয়া যায়। চরিত্র নিয়ে ভাবার, গবেষণা করার সময় মেলে। এতে চরিত্রে প্রবেশ করার সুযোগ থাকে এবং অভিনয়টা মন দিয়ে করা যায়। একজন অভিনেতা হিসেবে আমি তাই সিনেমা আর ওটিটি-কেই বেশি পছন্দ করি।
বলা বাহুল্য, দর্শকের চরিত্রও তিনটি মাধ্যমের ক্ষেত্রে একেবারে আলাদা। টিভি সিরিয়াল দিনের পর দিন চলতে থাকে। দর্শক বাড়িতে বসে, হালকা মেজাজে আমোদ উপভোগ করেন। সেখানে সিনেমায় গল্পটা তিন ঘন্টার মধ্যে বলা, দর্শককে ধরে রাখার জন্য তাকে মুচমুচে ও আকর্ষনীয় করে তুলতেই হয়। ওয়েব সিরিজে আবার অন্যরকম, সেটা স্থায়ীভাবে দর্শকের জন্য থেকে যায়। এই সবকিছু মাথায় রেখেই নির্মাতাদের কাজটা করতে হয়।
অক্ষয় কুমারের সঙ্গে ‘লক্ষ্মী’ ছবিতে অভিনয় করেছ তুমি। কেমন সেই অভিজ্ঞতা ?
অক্ষয় কুমারের সঙ্গে পর্দা ভাগ করে নেওয়া নিঃসন্দেহে এক দারুণ অভিজ্ঞতা। অক্ষয় স্যারের সঙ্গে শুটিংয়ের মুহূর্তগুলি আমি কোনওদিন ভুলতে পারবো না। এই ছবিতে আমি ওঁর এন্টাগনিস্ট গার্লফ্রেন্ডদের একজন হয়েছিলাম। বলিউডের সবচেয়ে জনপ্রিয় সুপারস্টারদের একজন হলেন অক্ষয় কুমার। তাঁর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাওয়ার মতো ভালো আর কী হতে পারে ? তার মধ্যে এটাই ছিল আমার প্রথম সিনেমায় অভিনয়। তাই চরিত্রটা ছোট হলেও রাজি হতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করিনি।
মির্জাপুর ওয়েব সিরিজ দারুণ প্রভাব বিস্তার করেছে দর্শকমনে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে কেমন লাগছে ?
একজন অভিনেতা হিসেবে আমি সবসময় চেয়েছি এমন কাজ করতে, যেখানে অভিনয়ের সুযোগ অনেক বেশি। চরিত্রটি হবে গুরুত্বপূর্ণ ও গভীর। সেটা দৈর্ঘ্যে কত, সেটা কোনও ব্যাপার নয়, কতটা প্রভাবিত করবে দর্শকমনকে, বিবেচ্য সেটাই। শুধু নিজের নামটা কোনওভাবে একটি প্রজেক্টের সঙ্গে যুক্ত করতে রাজি নই আমি। আমি সবসময় এমন কাজ করতে চেয়েছি, যেখানে অভিনেতা হিসেবে আমার কিছু করার থাকবে। ‘মির্জাপুর’ আমাকে সেই সুযোগ দিয়েছে। দর্শক ‘মির্জাপুর’-এ আমার কাজ পছন্দ করেছেন। এই সিরিজে কাজের সূত্রেই আমি আরও কিছু ভালো কাজের সুযোগও পাই।
তুমি বেশ কিছু ছবিতে ডান্স নাম্বার করেছ। তোমার ডান্স কেরিয়ার সম্পর্কে জানাও।
আমি এটা বলবো না যে ডান্স নিয়ে আলাদাভাবে আমি কিছু পরিকল্পনা করেছিলাম বা পৃথক কোনও কেরিয়ার আছে আমার। আগেই বলেছি, অভিনয়ের ব্যাপারটাও আমার ক্ষেত্রে আচমকা ঘটেছে। ডান্সও সিনেমার হাত ধরেই এসেছে। গান শেখার কারণেই তালের ব্যাপারটা আমার রপ্ত ছিল। ফলে, ডান্স আয়ত্তে আনতে আমার খুব বেশি সময় লাগেনি। সম্প্রতি আমি দুটি মালয়ালম ছবিতে ডান্স নাম্বার করলাম। দারুণ অভিজ্ঞতা। খুব শিগগিরই আমার একটি মিউজিক এলবামও প্রকাশিত হবে। এতেও আমি একটি পেপি ডান্স নাম্বার করেছি। এর আগে আমি ‘নাচনিয়া’ বলে একটি ওয়েব সিরিজ করি, সেখানে নিজের গানের সঙ্গেই আমার কয়েকটি ডান্স নাম্বার ছিল। ডান্স আমি উপভোগ করি। তবে, পর্দায় আরও এই ধরণের ডান্স নাম্বার করতে হলে, দরকার মতো প্রশিক্ষণ নেব।
তোমার আগামী কাজগুলোর কথা বলো।
আমার আপকামিং প্রজেক্টের মধ্যে আছে তিনটি ছবি। একটি হৃদয় ভি শেট্টির (রোহিত শেট্টির ভাই) সঙ্গে, আরেকটি শৈলেন্দ্র সিং এবং তৃতীয়টি অধিকারী ব্রাদার্স-এর ছবি। তিনটিতেই আমি মুখ্য ভূমিকায় কাজ করছি। মিউজিক ভিডিও ও মালয়ালম ছবির কথা তো আগেই বলেছি। সব মিলিয়ে এই বছরটা আমার পক্ষে বেশ এক্সাইটিং হতে চলেছে।
সবশেষে জানতে চাই অভিনয় নিয়ে তোমার স্বপ্নের কথা।
আগামী দিনে একজন অভিনেতা হিসেবে এটাই আমার সবচেয়ে বড় লক্ষ্য, নিজেকে বিনোদন জগতে একটা শক্ত জমিতে প্রতিষ্ঠিত করা। প্রিয়াঙ্কা চোপড়া বা আলিয়া ভাট যেমনভাবে ইন্ডাস্ট্রিতে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছেন, আমি প্রবলভাবে সেটাকে কুর্নিশ করি। আমি ঠিক এভাবেই নিজেকেও দেখতে চাই।