ওদের জন্য কিছুই করতে পারি না
ঘুম ভাঙলেই ওঁদের সঙ্গে দেখা। আমাদের রোজকার জীবনে নানারূপে আছেন ওঁরা। কখনও মিষ্টি মুখে, কখনও ঝুটঝামেলায় দিনগুলি কাটে ওঁদের সঙ্গে। সেই অম্লমধুর কথকতা এই কলমে। পড়ুন চয়নিকা বসুর কলমে।
কাকিমা, ও কাকিমা–মাছ নেবেন তো ? রুই, কাতলা, আইর, বোয়াল, মাগুর ! আজ একটু আইর মাছ নেন দেখি ! মাছটা খুব ভালো পাইসি।
জবাবে আমি, বলেছি না ওসব তেলা মাছ আমায়
দেবে না ?
রোজ রোজ রুই-কাতলা ভালো লাগে ? তাই বলি !
আচ্ছা ঠিক আছে। রুইই নেন। বিহারের মাছ। খুব স্বাদ। টাটকাও আছে মাছটা।
বিহার-উড়িষ্যা বুঝি না। আমাকে অল্প দাও। চারশো টাকার বেশি উঠবে না কিন্তু।
মাছটা দেখেন আগে।
তুমি কাটো। আমি টাকা নিয়ে আসি।
পাঁচ মিনিট পর–
নেন।
কত হলো ? সাড়ে চারশো।
চারশোর বেশি এক পয়সাও পাবে না। আমি আগেই বলেছি।
আরে, মাছটা তো দেখেন !
দরকার নেই। আমি বাজেটের বেশি পারবো না।
শেষ পর্যন্ত চারশো কুড়ি টাকায় রফা হয়।
আমার লস হয়ে গেল–বলতে বলতে চলে যায় আমার মাছওয়ালা।
দু তিনদিন পরপরই এই নাটক মঞ্চস্থ হয় আমার বাড়ির গেটে। বাজার থেকে মাছ কেনার পাট সেই কোভিড পরিস্থিতি শুরু হওয়ার পর থেকেই বন্ধ। তখন থেকেই ইনি, আমার রোজকার পেটপুজোয় মাছের জোগানদার।
যতই ক্যাচাকেচি হোক, লোকটা মাছ ভালো দেয়। আজ পর্যন্ত খারাপ মাছ দেয়নি সে আমায়। আর দিলেই বা কী করতাম ? বাজারে মাছ কিনতে যাওয়ার অভ্যাস চলে গেছে। মাছ ছাড়া আমার মতো বঙ্গবাসী ভাতের পাতে নিতান্তই অসহায়। অতএব প্রায় প্রতি সকালেই এনার শরনাপন্ন হওয়া। আশপাশের আরও দুয়েকটি পরিবারও ওর বাধা খদ্দের। তবে, তারা দরদাম করে, ওজন দেখে। আমি অত পেরে উঠি না। অন্ধের মতো বিশ্বাস করি। এটাও জানি, দরদাম করে, ওজন দেখেও কিছুই করতে পারতাম না আমি। এর থেকে বিশ্বাসে আত্মসমর্পনই ভালো।
নিয়মিত দেখাসাক্ষাৎ। কোথাও একটা ভরসা, বিশ্বাসের সম্পর্ক হয়েই যায়। ওর কাছে আমার টাকা বা আমার কাছে ওর টাকা থেকে যাওয়া, এসবও হয়। সেখানেও ঠকিনি, ঠকাইওনি আজ পর্যন্ত।
মানুষটা হাসিখুশি। হইহই করে আসে। আমাকে কাকিমা, উল্টোদিকের বাড়ির অল্প বয়েসী বউটিকে বৌদি। আমার কোনাকুনি বাড়িতে থাকা এক মহিলাকে দিদি–এভাবেই সম্পর্ক পাতিয়ে ফেলেছে সে। আজ দেখলাম কিছুটা ম্রিয়মান। মাছ নেওয়ার পর বললো, আমার মেয়েটার খুব অসুখ গো কাকিমা। শিরদাঁড়ায় কী যেন হইসে, বাইক্যা যাইতাসে সমানে। ডাক্তার অপারেশন করাইতে বলসে। দু আড়াই লাখের ব্যাপার। অত টাকা নাই গো। বাড়ি বন্ধক দেব ভাবছি।
মনটা খারাপ হয়ে গেল। দুশ্চিন্তাও হলো। ও যে ডাক্তারকে দেখিয়েছে মেয়েকে, তিনি নিশ্চয়ই প্রাইভেট প্র্যাকটিশনার। নার্সিংহোম বা প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা করানো মানে সকলেই জানে, সর্বশান্ত হয়ে যাওয়ার যোগাড়। শিলিগুড়িতে সরকারি হাসপাতাল একটাই–উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ। সেখানে চিকিৎসার আধুনিক ব্যবস্থা এখনও অপ্রতুল। পরামর্শ দিলাম কলকাতায় গিয়ে সরকারি হাসপাতালে দেখাতে। হয়তো যাবে বা যাওয়ার বন্দোবস্ত করেই উঠতে পারবে না। হোটেলে থেকে চিকিৎসা করানো অসম্ভব ওর পক্ষে। আত্মীয়স্বজন থাকলেও সাহায্য করবে কিনা, কে জানে !
কী অসহায় অবস্থা এদেশের এই আর্থিক স্তরের মানুষদের। আমাদের রোজকার জীবনে ওরা অপরিহার্য। কিন্তু ওদের জন্য কিছুই করতে পারি না। ভাবনাটুকুই সার। অপরাধ বোধ কুরে কুরে খায়।
ছবি : প্রতীকী