ওয়েব থ্রিলারে অনবদ্য ঋত্বিক
হাতে হাতে স্মার্টফোন। তরুণ প্রজন্মের চোখ ইদানীং নিত্যনতুন ওয়েব সিরিজে। সারা বিশ্বের স্ট্রিমিং বিনোদন এখন হাতের মুঠোয়। সেইসব সিরিজ নিয়েই নানাকথা এই বিভাগে। দুটি সিজন ঘিরে ‘গোরা’-র পরিক্রমা। বাংলার ওয়েব দর্শক মজেছেন থ্রিলারের ভিন্ন মেজাজে। লিখেছেন সোমনাথ লাহা।
পর্দায় বরাবরই ভিন্ন অবতারে ধরা দেন তিনি। ছকবাঁধা হোক কিংবা গতের বাইরে–সবেতেই সাবলীল ঋত্বিক চক্রবর্তী। স্বতস্ফূর্ত অভিনয় দিয়ে চিত্রনাট্যের খামতি ঢেকে পর্দায় জীবন্ত হয়ে ওঠার ম্যাজিকও জানেন তিনি। এহেন ঋত্বিক যখন গোয়েন্দা হিসেবে ওটিটি-র আঙিনায় অবতীর্ণ হলেন, তখনও তিনি অন্য পাঁচটা ডিটেকটিভের তুলনায় শুরু থেকেই ছিলেন আলাদা। পাঠক বুঝতেই পারছেন, হইচই-এর ওয়েব সিরিজ ‘গোরা’র কথাই বলছি। সিরিজে নাম ভূমিকায় ঋত্বিক। বলতে দ্বিধা নেই, গৌরব সেন ওরফে গোরা হিসেবে নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তিনি।
প্রসঙ্গত, প্রাইভেট ডিটেকটিভ ‘গোরা’ চরিত্রটি অদ্ভুত স্বভাবের। একটু খ্যাপাটে গোছের মানুষ। সে হলো সিরিয়াল কিলার স্পেশালিস্ট। অথচ সে কোনও হিন্ট যেমন মনে রাখতে পারে না, তেমনই নামও ভুলে যায়। কমেডি এবং থ্রিলারের মিশ্রণে তৈরি এই সিরিজে গোরার বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি, বেসুরো গান গাওয়া, নাম মনে রাখতে না পারায় যে মজাটা সৃষ্টি হয়েছে, তাতেই মজেছে বং ওয়েব দর্শক। তার অঙ্গভঙ্গি খানিক লাউড মনে হলেও, তা দেখে বিরক্তি নয়, বরং, হাসি পায় দর্শকের। বাংলা ওয়েব সিরিজগুলোর দিকে তাকালে আমরা বহু গোয়েন্দার উল্লেখ পাই। কিন্তু এমন গোয়েন্দা খুব কমই এসেছে, শুধুমাত্র চরিত্রের কারণে যে দর্শকমনে জায়গা করে নিয়েছে। ‘গোরা’ সেইরকমই একজন গোয়েন্দা। একজন মানুষকে একবার দেখে, গোরা তার সম্পর্কে অনেককিছু বলে দেওয়ার পাশাপাশি সাধারণ কথার মধ্যে থেকেই খুঁজে বের করে গুরুত্বপূর্ণ তদন্তের অংশ।
সায়ন্তন ঘোষাল পরিচালিত ‘গোরা’-র প্রথম সিজনের গল্প পরিবেশনার পদ্ধতি এতটাই সুন্দর ছিল যে আট পর্বের সিজনটি রীতিমতো বেঁধে রেখেছিল দর্শকদের। পাশাপাশি গোরা চরিত্রে ঋত্বিকের অনবদ্য অভিনয় তো আছেই। ঋত্বিকের পাশাপাশি তার সহকারী সারথী (একইসঙ্গে গোরার বোনের হবু বর) চরিত্রে সুহোত্র মুখোপাধ্যায়ও দারুণ সঙ্গত করেছেন। প্রথম সিজনে তিনজন লেখকের খুনের কিনারা করতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাওয়া পুলিশ শরণাপন্ন হয় গোরার। বিষয়টা ছিল এই–তিনজনের দাঁত উপড়ে সেখানে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে পেনের নিব। এছাড়াও আরও একটি সমস্যা নিয়ে আসে সোমলতা বলে একটি মেয়ে। সেই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ইশা সাহা। মূল কাহিনিটি আবেগমাখা হলেও, তার সঙ্গে থ্রিল-কমেডির বুনন, ঋত্বিকের লুক, সকলের অভিনয় এবং সর্বোপরি সিরিজের চিত্রনাট্য ‘গোরা’-কে অচিরেই অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল।
প্রথম সিজনের তুমুল জনপ্রিয়তার কারণেই ‘গোরা ২’-কে নিয়ে আসেন নির্মাতারা। এবার সিরিজের ক্রিয়েটর হিসেবে সাহানা দত্ত থাকলেও, পরিচালকের আসনে জয়দীপ মুখোপাধ্যায়। আট পর্বের সিজন ২-এর কাহিনির সূত্রপাত হয় ন্যাড়া হওয়ায় বিয়ে হচ্ছে না গোরার। কিন্তু সে পণ করেছে দু’সপ্তাহের মধ্যে পাত্রী খুঁজে বিয়ে করবে। এমতাবস্থায় তার কাছে একটি কেস নিয়ে হাজির হয় শ্রেয়সী মিত্র। শ্রেয়সীর দিদির তিনবছরের বাচ্চা মেয়ে রক্তবমি হয়ে মারা গিয়েছে। সেই বাড়িতে আরও দুটি বাচ্চা মেয়ের ভাগ্যেও ঘটে একইরকম ঘটনা। শ্বশুরবাড়িতে সবাই শ্রেয়সীর দিদিকেই সন্দেহ করছে।
পাশাপাশি একটি নার্সিংহোমে দু’জন নার্স ও একজন ওয়ার্ডবয় সিঁড়ি থেকে অস্বাভাবিক ভাবে পড়ে গিয়ে মারা গিয়েছেন। একাধিক ব্যক্তি সেই বিষয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছে। এই দুটি ঘটনা কি একসূত্রে গাঁথা ? এদিকে তদন্ত করার সময় গোরার বাড়িরও অদ্ভুত পরিস্থিতি। তার মায়ের চোখের অপারেশন হয়েছে। তাকে দেখার জন্য অর্ণা নামে একজন নার্স রাখা হয়েছে। মা তার ওপর বেশ নির্ভর করলেও, গোরা অর্ণাকে পছন্দ করে না। এমতাবস্থায় সবদিক সামাল দিয়ে, গোরা রহস্য উদঘাটন করতে পারে কি? তার বিয়ে কি হয় ? উত্তর রয়েছে কাহিনির পর্বে পর্বে। আগের সিজনের মতোই এবারেও গোরার মা, বোন কঙ্কা এবং পুলিশ ইন্সপেক্টর তারাপদ সরখেলের চরিত্রে অভিনয় করেছেন অনুরাধা রায়, অনন্যা সেন ও অভিজিৎ গুহ। শ্রেয়সী মিত্রর ভূমিকায় রয়েছেন উষসী রায় এবং অর্ণার চরিত্রে অভিনয় করেছেন মানালি দে। এছাড়াও অন্যান্য চরিত্রে রয়েছেন মিমি দত্ত, বিপ্লব দাশগুপ্ত প্রমুখ।
এবারের সিজনেও গোরা এবং সারথীর চরিত্রে ঋত্বিক ও সুহোত্রর অনস্ক্রিন কেমিস্ট্রি রীতিমতো নজর কেড়েছে। অন্যদিকে ঋত্বিক-মানালি জুটিও বেশ মজাদার হয়ে উঠেছে পর্দায়। শেষে গিয়ে যেভাবে এই দুই চরিত্র কাছাকাছি আসে সেটাও উপভোগ্য। যদিও কিছু খাপছাড়া ব্যাপার ঘটেছে। উষসী অভিনীত চরিত্রটিকে চিত্রনাট্যে যথাযথ জায়গা দেওয়া হয়নি। ক্লাইম্যাক্স অবশ্য বেশ থ্রিলিং। যে পদ্ধতিতে এখানে খুনগুলি দেখানো হয়েছে, সেটিও ইন্টারেস্টিং। কিন্তু কিছু দৃশ্যকে অহেতুক টেনে বড় করা ও জোর করে কমেডি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা বহুক্ষেত্রেই বিরক্তির সৃষ্টি করে। এতকিছুর পরও নিজের অভিনয় দিয়ে চিত্রনাট্যের খামতি ঢেকেছেন ঋত্বিক। বেশ কিছু দৃশ্যকে প্রায় একাই টেনেছেন তিনি। ‘গোরা ২’ -এর হাত ধরেই প্রথমবার একসঙ্গে কাজ করলেন জয়দীপ ও ঋত্বিক। যদিও অভিযোগ, এত ভালো আইডিয়াকে ঠিক মতো মেলে ধরতে পারেননি পরিচালক। তা সত্বেও বলা যায় ঋত্বিকের গুণেই উৎরে গেছে ‘গোরা ২’।