ওরা কাজ করে… নগরে প্রান্তরে…
ঘুম ভাঙলেই ওঁদের সঙ্গে দেখা। আমাদের রোজকার জীবনে নানারূপে আছেন ওঁরা। কখনও মিষ্টি মুখে, কখনও ঝুটঝামেলায় দিনগুলি কাটে ওঁদের সঙ্গে। সেই অম্লমধুর কথকতা এই বিভাগে। পড়ছেন চয়নিকা বসুর কলমে।
কী মরমি ও গভীর এই উচ্চারণ ! দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ এই কবিতাতেই বলেছেন,
বিপুল জনতা চলে
নানা পথে নানা দলে দলে
যুগ যুগান্তর হতে মানুষের নিত্য প্রয়োজনে
জীবনে মরণে।
ওরা চিরকাল টানে দাঁড়, ধরে থাকে হাল,
ওরা মাঠে মাঠে বীজ বোনে, পাকা ধান কাটে–
ওরা কাজ করে
নগরে প্রান্তরে।
‘তাহাদের কথা ‘ বিভাগে ওদেরই আনার চেষ্টা করেছি আমরা। আজ এর অন্তিম পর্ব। আজ একজন নয়, অনেক মানুষের কথা। এ উপলব্ধি অতিমারী প্রথম যখন হানা দেয়, সেই সময়ের। সেই কঠিন সময়ে শহর বা গ্রামের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ যত দ্রুত পরিস্থিতি নিজেদের আয়ত্তে আনতে সক্ষম হন, সেটা খুব স্বাভাবিক কারণেই নিম্নবিত্তের মানুষ পেরে ওঠেননি। সে সময় আমরা দেখেছি ওঁদের দুরাবস্থা। সারা দেশ জুড়ে যে শ্রমজীবি মানুষ কাজ করছিলেন কলকারখানায়, ক্ষেতে-খামারে, তাঁরা শাটল ককের মতো দেশের এপ্রান্ত ওপ্রান্ত ছুটে বেড়াতে বাধ্য হন। এক রাজ্যের শ্রমজীবী মানুষ ভিনরাজ্যে কাজ করতে যান পেটের দায়েই। অতিমারীর পর লকডাউন ঘোষিত হতেই বিভিন্ন সংস্থার মালিকগণ তাদের শ্রমিকদের কাজ থেকে বসিয়ে দেয়। কাজ হারিয়ে ভিন রাজ্যে থাকা অসম্ভব ! স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা আপন রাজ্যে ফেরার চেষ্টা করে। কিন্তু সেখানেও যে ব্রাত্য তাঁরা !
এইসবই চেয়ে চেয়ে দেখেছি আমরা। দেখেছি, কী অমানবিক উপায়ে এঁদের স্থানান্তরিত করার ব্যবস্থা হয়েছে। রেললাইনের ওপর পড়ে থাকা মানুষের লাশ আর পোড়া রুটির মর্মান্তিক ইতিহাস রচিত হতে দেখেও আমাদের রাতের ঘুম নষ্ট হয়নি। কৃষক, শ্রমিক, মুটে, মজুর, রিকশাচালক, ঠেলাওয়ালা, পাড়ার ফেরিওয়ালা, হোটেলের বয়, অফিসের দারোয়ান, জমাদার, মালি, হকার প্রমুখ সবাই নিঃস্ব, রিক্ত, কর্মহীন হয়ে গভীর সংকটে পড়েছেন। ২০১৯-এর শেষ থেকে প্রকট এই সংকট, যা আজও স্বাভাবিক হতে পারেনি। একদা এই মানুষগুলোর পরিশ্রমের, নিত্য লড়াইয়ের মধ্যেও একটা ছন্দ ছিল। সেই ছন্দ হারিয়ে দিশেহারা আজ তাঁরা। আসল কথা হলো, অতিমারী শুধু কঠিন সত্যের সামনের পর্দাটা সরিয়ে দিয়েছে মাত্র। আদতে শ্রমজীবী মানুষের শোষণ ও বঞ্চনার কাহিনি ওই যুগান্তের, যা রবীন্দ্রনাথ বহুকাল আগেই লিখে রেখে গেছেন।
আপন ঘরে (পড়ুন রাজ্যে) ঠাঁই নেই। পরদেশে কাজ নেই। বিশ্বাস নেই। প্রত্যাশা নেই। ধাক্কা খেয়ে, পদদলিত হয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষগুলো এরপর কি করবে ? আবার সেই পরিযায়ী তকমা ? আবার শিকড়হীন হওয়া ? আমরা জেনেও ভুলে থাকি এই মানুষগুলোর সমস্যাকে। অথচ এঁরা হলেন সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। আক্ষেপ, তা সত্বেও এদেশের হতভাগ্য শ্রমজীবি মানুষ বার বার হার মেনেছে অন্যায়ের কাছে। সংগঠিত হোক বা অসংগঠিত–দিনের শেষে প্রাপ্তি ওই দারিদ্র্য, অবহেলা আর অবিচার ! মিথ্যে প্রতিশ্রুতি আর আশ্বাস। রাজনৈতিক থেকে তথাকথিত সমাজসেবী–এইসব চক্র যেন এই মানুষগুলোর অনুভূতিকেও ভোঁতা করে দিয়েছে। আজ এই চরম দুর্ভোগের দিনে কোথাও কি জাগ্রত হবে তাঁদের চৈতন্য ? তাঁরা কী এবার নিজেদের মূল্য বুঝবেন ? তাঁরা নিজেরা না বুঝলে, কেউ তো বোঝাবে না ! শ্রমজীবী মানুষের প্রতি বঞ্চনার ইতিহাস বহু পুরোনো যে এই কারণেই !!
***ছবি প্রতীকী