কপিলের ভক্তরাও দেখল না ‘জুইগাটো’?
নতুন ছবির মুক্তি হোক বা নির্মাণ। পোস্টার, ট্রেলার রিলিজ। ছবি হিট এবং ফ্লপ। তারকাদের জীবনের ওঠাপড়া। বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে সিনেমার দুনিয়ায় প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলেছে নানা বৈচিত্রপূর্ণ ঘটনা। সেইসবই এই বিভাগে, প্রতি সপ্তাহে। নন্দিতা দাশের ‘জুইগাটো’ র বক্স অফিস সাফল্য না পাওয়ায় ক্ষতি ভালো সিনেমার। লিখেছেন অজন্তা সিনহা।
পরিচালক নন্দিতা দাশের ছবি ‘জুইগাটো’র বক্স অফিস কালেকশন একেবারে মুক্তির দিন থেকেই নিম্নগামী। ছবির মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন ভারতের স্টার কমেডিয়ান ও চূড়ান্ত সফল সিটকম শিল্পী কপিল শর্মা ও সেরিব্রাল অভিনেত্রী সাহানা গোস্বামী। সমস্ত মিডিয়াই লিখছে, ছবিটি ভালো হলেও দর্শক গ্রহণ করেনি। দর্শকের কথায় পরে আসছি। তার আগে এক বিশ্ব নিন্দুকের কথা। ইনি বিশেষ করে বলিউড তারকাদের বুলি করেই খবরে থাকেন। পাঠক ঠিকই ধরেছেন, কমল আর খানের কথাই বলছি। তিনি বিশেষভাবে কপিলকেই আক্রমণ করে বলেছেন, জোকার দিয়ে কী আর সিরিয়াস ছবি হয় ? এ ছাড়াও তিনি আরও নানাভাবে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করেছেন টিম ‘জুইগাটো’র সদস্যদের। ছবিটি খুব কম টাকার ব্যবসা করেছে, তাই নিয়েও হাসাহাসি করেছেন কমল !
এক্ষেত্রে কেআরকে-র সামনে একটা প্রশ্ন রাখা অত্যন্ত জরুরি, বলিউড তারকাদের বিরুদ্ধে জিভ শানানো ছাড়া আপনি নিজে কিছু করে উঠতে পেরেছেন কী এ যাবৎ ? এর আগে শাহরুখ খানের ‘পাঠান’ নিয়েও প্রভূত কথা চালাচালি করেছেন তিনি। ছবি বাম্পার হিট হওয়ার পর মুখ বন্ধ হয়েছে তাঁর। এটাও ভেবে অবাক লাগে, কমল আর খানের মতো একটা তৃতীয় শ্রেণীর লোককে মিডিয়াই বা এত জায়গা দেয় কী করে ? কেআরকে-র কথা ছেড়ে দর্শকদের প্রসঙ্গে আসি। তার আগে সংক্ষেপে ‘জুইগাটো’র সম্পর্কে কিছু তথ্য। অ্যাপ্লজ এন্টারটেনমেন্ট ও নন্দিতা দাশ যৌথভাবে ছবিটি প্রযোজনা করেছেন। অর্থাৎ ছবিটি শুধু পরিচালনা নয়, এর পিছনে টাকাও লগ্নি করেছেন নন্দিতা। ভারতীয় সিনেমা জগতের প্রতিভাময়ী, মেধাবী, শিক্ষিত ও বুদ্ধিদীপ্ত এই কন্যাটি তাঁর কেরিয়ারের শুরু থেকেই অভিনয় হোক বা পরিচালনা–অর্থবহ, যুক্তিবাদী ও মুক্তচিন্তার প্রযোজনাগুলির সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। ‘জুইগাটো’ও তার বাইরে নয়।
ভয়াবহ অতিমারী পরিস্থিতিতে এক্স-ফ্যাক্টরি ফ্লোর ম্যানেজার মানস (কপিল শর্মা) চাকরি খুইয়ে ফুড ডেলিভারি পার্সনের চাকরি বেছে নেয়। ডেলিভারি পার্সন/বয়দের প্রতি চাকরি-দাতা সংস্থাগুলি থেকে গ্রাহকদের আচরণ বেশিরভাগ সময় কেমন থাকে, আমাদের জানা ! শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় ক্ষুধা-তৃষ্ণা, অসুস্থতা ভুলে ছুটতে হয় তাঁদের, শহরের এপ্রান্ত ওপ্রান্তের ঠিকানায় পৌঁছনোর লক্ষ্যে। মানসও ব্যতিক্রম নয়। অবস্থা সামলাতে মানসের স্ত্রী প্রতিমাও চেষ্টা করে কাজকর্মের। বলা বাহুল্য, তারও নানা তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়। দুই সন্তান ও অসুস্থ মাকে নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য মানস ও প্রতিমার যে যুদ্ধ, তা আমাদের খুব চেনা। মনে প্রশ্ন জাগে, এত চেনা বলেই কী বিষয়টা দর্শকের কাছে আকর্ষণ হারায় ? দর্শক প্রসঙ্গেই বলি, আমরা কী আজ আর পর্দায় নিজেদের সত্যিকারের অবস্থানকে দেখতে চাই না ? পর্দায় সেই জীবনই দেখতে চাই, যা আমাদের যাপন ক্ষমতার বাইরে ? যাকে আমরা প্যারালাল সিনেমা বা রিয়ালিস্টিক ছবি বলি, তার বাজার কী ক্রমশ সংকুচিত হওয়ার পথে ?
গত শুক্রবার ‘জুইগাটো’র হলমুক্তি ঘটে। তার আগে ২০২২-এ টরন্টো ওয়ার্ল্ডওয়াইড ফিল্ম সেলিব্রেশনে দেখান হয় ছবিটি এবং সেখানে তুমুলভাবে প্রশংসা অর্জন করে ‘জুইগাটো’। ছবির পাশাপাশি প্রশংসিত হয় কপিলের অভিনয়ও। এটা পৃথকভাবে বলার, কারণ, সাহানা গোস্বামী ইতিমধ্যেই একজন প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রী। গুল পনাগ, স্বানন্দ কিরকিরে, সায়নী গুপ্তও চেনা নাম। অন্যদিকে কপিল টিভির পর্দায় কমেডির বেতাজ বাদশা হলেও সিনেমায় তাঁর এখনও সেই বিশ্বাসযোগ্য ইমেজ তৈরি হয়নি। তার মধ্যে ‘জুইগাটো’ পুরোমাত্রায় এক সিরিয়াস ছবি। তা সত্বেও কপিল নিজের অভিনয়ের কৃতিত্ব দেখাতে সক্ষম হয়েছেন। নিজের কমিক ইমেজ ভেঙে পর্দায় যথার্থই ডেলিভারি পার্সন মানস হয়ে উঠেছেন। কপিলের প্রশংসা করতে কার্পণ্য করেননি বলিউডের তাবড় মানুষজন। পাশাপাশি কপিলের ভক্তরাও উচ্ছ্বসিত হয়েছে ‘জুইগাটো’ নিয়ে। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? এত প্রশংসার পরেও দর্শক বিরাগের কারণটি একেবারেই স্পষ্ট নয়।
নন্দিতার প্রথম ছবি ‘ফিরাক’ মুক্তি পায় ২০০৮ সালে। ছবিটি উচ্চ প্রশংসিত এবং বেশ কয়েকটি পুরস্কারে অভিষিক্ত। ২০১৮-য় মুক্তি পায় তাঁর দ্বিতীয় ছবি ‘মান্টো’। এই ছবিটিও দেশ বিদেশে চূড়ান্ত প্রশংসিত। দুটি ছবিই খানিকটা বিতর্কিত। বিতর্কের নানা কারণ। রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে যে নেতিবাচক দিকগুলি সাধারণ মানুষের জীবনকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয় বা দিয়ে চলে, সেগুলি সচরাচর সিনেমার পর্দায় আজকাল বিশেষ দেখতে চাই না আমরা। নন্দিতার মতো পরিচালকরা এমন বিষয় নিয়েই কাজ করতে পছন্দ করেন। তাঁরা দর্শককে ভাবনার রসদ যোগাতে নিজেদের কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ। আক্ষেপ, যাঁদের কথা ভেবে ওঁর মতো পরিচালকদের এই অঙ্গীকার, তাঁরাই এখন ভাবনার আলস্যে ভুগছেন। ‘জুইগাটো’ নন্দিতার তৃতীয় ছবি। ধারাবাহিক ভাবে চিন্তাশীল ছবি নির্মাণের চেষ্টা করে চলেছেন তিনি। এই ছবি দর্শকধন্য না হলে, কপিল শর্মার খুব বেশি ক্ষতি বৃদ্ধি নেই। তবে, নন্দিতার মতো পরিচালকরা ভালো ছবি বানাবার আগ্রহ হারালে ভারতীয় সিনেমার ক্ষতি।