Monday, February 3, 2025
তবু অনন্ত জাগে

কবি সরোজিনী

জীবনমরণের সীমানা ছাড়িয়ে ওঁরা আজ বহু আলোকবর্ষ দূরের এক জগতে। তবু আছেন ওঁরা আমাদের মাঝে। থাকবেনও চিরদিন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সিনেমা থেকে সামাজিক ও রাজনৈতিক জগতের সেইসব মানুষ, যাঁদের অবদান ছাড়া অসম্পূর্ণ আমরা। তাঁদের নিয়েই এই বিশেষ কলম। ১৩ ফেব্রুয়ারি ছিল সরোজিনী নাইডুর জন্মদিন। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এই প্রতিবেদন

লিখেছেন মন্দিরা পান্ডা

‘বুলবুল-ই-হিন্দ’, ভারতের নাইটিঙ্গেলকে সভায় বক্তব্য রাখার জন্য অনুরোধ করছি। তবে তা গদ্যে নয়, তাঁর বক্তব্য কবিতায় শুনব আমরা। দিনটা ছিল ১৯৪৬ সালের ১১ ডিসেম্বর। গণপরিষদের বৈঠকে অস্থায়ী সভাপতি সচ্চিদানন্দ কিছুটা এমনই আবেদন করেছিলেন সরোজিনী চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। বিস্ময়ের মোড়ক সরিয়ে কাশ্মীরি কবির লেখা কয়েক পঙতি শোনা গেল তার কন্ঠে–বুলবুল কো গুল মুবারক/গুল কো চারমান মুবারক/রঙ্গিন তাইবিয়াতোঁ কো রঙ্গ-এ-সিখান মুবারক। যার বাংলা অর্থ, বুলবুল সুখী থাকে ফুলের কাছে, ফুল সুখী থাকে বাগানে আর রঙিন ব্যক্তিত্বের মানুষেরা কবিতায় আনন্দিত হন। একাধারে অনেকগুলি খেতাবের তিনি দাবিদার। কংগ্রেসের বার্ষিক সভায় সভাপতিত্ব করা প্রথম মহিলা, স্বাধীন ভারতের প্রথম মহিলা গভর্নর, এমনকি তাঁর নেতৃত্বেই গড়ে উঠেছিল ‘উইমেন্স ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’। কিন্তু সরোজিনীর এই সব পরিচয়ের মাঝেই আরও একটি পরিচয় ক্রমশ মূর্ত হয়ে উঠেছিল, তা হলো তাঁর কবি-পরিচয়।

১৮৭৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি হায়দ্রাবাদের এক হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে সরোজিনীর জন্ম। বিজ্ঞানী, দার্শনিক শিক্ষাবিদ অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় ও কবি বরদাসুন্দরী দেবীর জ্যেষ্ঠা কন্যা। সেই যুগে বাংলা ভাষায় যে মহিলারা কবিতা লিখতেন, তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্যা ছিলেন বরদাসুন্দরী। বাবা চাইতেন মেয়ে তাঁর মতো বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করুক। কিন্তু বিজ্ঞান বা অঙ্কের নিয়ম-নীতিতে তাঁর মন ছিল না। একদিন এলজেব্রা করতে গিয়ে বইয়ের পাতায় কবিতা লিখে ফেললেন। মূলত স্যার ওয়াল্টার স্কটের দীর্ঘতম কবিতা পড়ে তিনি উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। বাবা দেখলেন মেয়ের আকর্ষণ সাহিত্যে। তাই তিনিও কবিতা লেখার জন্য মেয়েকে উৎসাহ দিলেন।

সরোজিনী উর্দু, বাংলা, তেলেগু, ইংরেজী ও ফারসিতে সমানভাবে পারদর্শী ছিলেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি ‘মাহের মুনির’ নামে ফারসিতে একটি নাটক লেখেন। এই নাটক পড়ে হায়দ্রাবাদের নিজাম মুগ্ধ হন। এই সময়ে তিনি বৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ডে পড়তে যান। প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সমালোচক আর্থার সাইমন, এডমন্ড গস প্রমুখের সংস্পর্শে আসেন। গস তাকে বুঝিয়ে বলেন ভারতীয় সমাজ থেকে লেখার বিষয়বস্তু বেছে নিতে। সরোজিনীও এ কথা মনে রেখেছিলেন। তিনি কবি টেনিসন, শেলী, এলিজাবেথ ব্রাউনিংদের লেখায় প্রভাবিত হয়েছেন। তবে, অক্ষুন্ন রেখেছেন স্বকীয় ভাবধারা।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সরোজিনীর স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদান। সেই বছরেই প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কবিতা সংগ্রহ ‘দ্য গোল্ডেন থ্রেসহোল্ড’। সমস্ত রাজনৈতিক জীবনপর্ব জুড়েই কালির আঁচড়ে তৈরি করেছেন একের পর এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। ১৯১২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় বই ‘The Bird of Time: Songs of Life, Death & the Spring’। এরপর ‘The Broken Wing: Songs of Love, Death and the Spring’ কবিতাগ্রন্থ। স্বল্প বিরতির পর ১৯৪৩ সালে প্রকাশিত হয় ‘The Sceptred Flute: Songs of India’ বইটি। ১৯৬১ সালে ‘The Feather of the Dawn’। সেই সময় সরোজিনী পৃথিবীর সেরা কবিদের মধ্যে অন্যতম রূপে বিবেচিত ছিলেন। বিশ্বনন্দিত অনেক মার্কিন ও ব্রিটিশ কবি-সাহিত্যিকই তাঁর সাহিত্যকর্মের অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন। কবিতা সংক্রান্ত একটি ওয়েবসাইটে তাঁকে পৃথিবীর ইতিহাসের সেরা কবির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। যেখানে তাঁর স্থান ছিল ১৯তম।

তিনি নিপুণ বর্ণনায় বলেছেন ‘তাঁতি’ কবিতায় তাঁতিদের কথা, যারা অক্লান্ত পরিশ্রমে রকমারি কাপড় বোনে মানুষের প্রয়োজনে ও নানা উৎসবের জন্য। তাঁর আরেকটি বিখ্যাত কবিতা ‘বেহারা’। তিনি চার বেহারার পালকি টানা ও সুর করে গান গাওয়ার চিত্র এঁকেছেন। সেই সঙ্গে বলেছেন একজন নববধূর মনের কথা। ঔপনিবেশিক ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অনুপ্রাণিত করার জন্য সরোজিনীর শব্দচয়ন প্রশংসার দাবি রাখে। সাহিত্যশৈলি, গান, নৃত্য এবং দৈনন্দিন সাদাসিধে জীবনযাপনের মাধ্যমে তিনি গর্বের সাথে তুলে ধরেছেন তাঁর ভারতীয় সংস্কৃতিকে। ‘চুড়ি বিক্রেতা’ কবিতায়, ভারতীয় চুড়ি তাদের স্ব-গৌরবে মহিমান্বিত। চুড়িগুলি ভারতীয় জীবনযাত্রায় একটি তাৎপর্যপূর্ণ অর্থ বহন করে। কারণ, তারা জীবনের বিভিন্ন স্তর এবং সংগ্রামের প্রতিনিধিত্ব করে।

সরোজিনীর কবিতায় উঠে এসেছে গ্রামীণ সমাজের সংস্কৃতি ও চিত্র। তেমনি এসেছে প্রেম, মৃত্যু, বিরহ, আধ্যাত্মিকতা, জীবনবোধ ও দেশপ্রেম। তাঁর কবিতা গীতিময়, সুরময়, ছন্দময়, উপমা ও চিত্রকল্পে পূর্ণ। বীরাঙ্গনা সরোজিনী হাতে তুলেছেন অস্ত্র, প্রতিবাদ করেছেন অত্যাচারের বিরুদ্ধে। সমান্তরালে কবি সরোজিনী হাতে তুলে নিয়েছেন কাগজ, দোয়াত,কালি‌। লিখেছিলেন একের পর এক উদ্দীপনা। স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষেত্রে যা অনুঘটকের কাজ করে। সময়ের আবর্তে তাই শিরার স্পন্দনে থাক বিদ্রোহিনী, আর মননে কবি সরোজিনী।