কালের প্রবাহে ভালোটাই টিকে থাকবে
জীবনমরণের সীমানা ছাড়িয়ে ওঁরা আজ বহু আলোকবর্ষ দূরের এক জগতে। তবু আছেন ওঁরা আমাদের মাঝে। থাকবেন চিরদিন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সিনেমা জগতের সেইসব মানুষ, যাঁদের অবদান ছাড়া অসম্পূর্ণ আমরা, তাঁদের নিয়েই এই বিশেষ কলম।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিবস পালন উপলক্ষে প্রকাশিত হচ্ছে ‘তবু অনন্ত জাগে’-র বিশেষ পর্ব। বিষয় ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত : অনুধাবন ও পরিবেশন’। এই বিষয়ে এই সময়ের প্রখ্যাত শিল্পীদের ভাবনাসমৃদ্ধ প্রতিবেদন ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। আজ নিজের ভাবনার কথা জানিয়েছেন জয়তী চক্রবর্তী।
“রবীন্দ্রসংগীত গাইতে গেলে যে বিশেষ কিছু যোগ্যতার প্রয়োজন, সেই বিষয়টা নিয়েই মানুষ যেন এখন অবগত নন ! বলা বাহুল্য, এই যোগ্যতা অর্জনের জন্য বেসিক কিছু প্রশিক্ষণ ও চর্চা জরুরি। আমি এই সময়ে দাঁড়িয়ে, একজন এই সময়ের শিল্পী হয়েই কথাটা বলছি”–জানান জয়তী। তাঁর বক্তব্য একেবারে সোজাসাপটা। রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে তাঁর ভাবনা জয়তীর চরিত্রের মতোই ঋজু, স্পষ্ট ও স্বচ্ছ। আমি জয়তীকে চিনি তখন থেকে, যখন সুরেলা কন্ঠ, যথেষ্ট সাঙ্গীতিক প্রতিভা ও দক্ষতা ইত্যাদি যাবতীয় গুণাবলি নিয়েও লড়াই করতে হচ্ছে তাঁকে। প্রশিক্ষণ থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ নিবেদন–সঙ্গীতের প্রতি নিষ্ঠা, নিয়মিত চর্চা এসবই যদি প্রকৃত প্রতিষ্ঠার শর্ত হয়, চোখের সামনে দেখেছি এই শর্তাদি যথাযথ পালন করেও অনেকটা সময় লেগেছে তাঁর নিজের পরিচয় নির্মাণে। আজ সে রবীন্দ্রসঙ্গীতের একজন সুপ্রতিষ্ঠিত শিল্পী। সারা বিশ্বের বাংলা গানের শ্রোতা বিমুগ্ধ জয়তীর নিবেদনে।
রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনের ক্ষেত্রে অনুধাবন কতখানি জরুরি, তা জয়তীর বিশ্লেষণে খুব সুন্দরভাবে উঠে এসেছে এখানে। তাঁর কথায়,”চারপাশে এখন অনেক ভালো ভালো কাজ হচ্ছে। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেখছি আমরা। সেই কাজগুলির মধ্যে বেশকিছু তথ্যমূলক প্রচেষ্টাও রয়েছে। প্রচারও অনেক বেশি। এত ভাবনাচিন্তা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আগে করা হয়নি। এতদিন শুধু গানগুলোকেই হাইলাইট করা হতো। এখন অনেক নতুন নতুন বিষয় উঠে আসছে।” সত্যিই তাই। নতুন ও সময়ের সঙ্গে চলমান এবং প্রাসঙ্গিক এই প্রচেষ্টাগুলি রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এ প্রসঙ্গে জয়তী যথার্থই বলেন, “রবীন্দ্রসঙ্গীতের কিংবদন্তি শিল্পীরা যে ল্যান্ডমার্ক তৈরি করে দিয়ে গেছেন, তারপর তো আমাদের আর কিছু করার নেই। সবটাই হয়ে গেছে। তাহলে আমরা কী করবো ? সেই জায়গাটা থেকেই কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভাবনাটা এসেছে।”
এরপরই সেই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি উঠে আসে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা যে করা হবে, সেগুলো করার জন্য ঠিক কতটা স্বাধীনতা নেওয়া উচিত ? এক্ষেত্রে জয়তীর বক্তব্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য–”কতটা স্বাধীনতা আমরা প্রয়োগ করবো, সেটা অনুধাবন অত্যন্ত জরুরি। গানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে কাজটা করতে সক্ষম হবো তো ? মনে রাখা দরকার, স্বাধীনতার অপব্যবহার যেন না হয়ে যায় !” বস্তুত, এই জায়গাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ! কোথায় কতটুকু স্বাধীনতা নেব আর কোথায় প্রথা অনুযায়ীই প্রয়োগ পরিকল্পনা করা হবে, এই সূক্ষ সীমারেখাটা বোঝার জন্যও একটা বোধ বা মননের প্রয়োজন আছে। প্রথা ভাঙার আগে প্রথাটা তো শিখতে হবে !
আর এই সূত্র ধরেই জয়তী জানান, “বোধ ও মনন জিনিসটা আসে শিক্ষা থেকে। এর সঙ্গে আমি রুচির দিকটাও উল্লেখ করতে চাই। আমরা কার গান গাইছি, সেই জায়গাটা তো বুঝতে হবে! একটা রক, পপ বা বিদেশি সুরের গান আর রবীন্দ্রনাথের বিদেশী সুরের প্রয়োগ আছে এমন গান–দুটো আমি একভাবে গাইতে পারি না।” জয়তী মনে করেন, এরই পাশাপাশি বাংলা ভাষার প্রতিও আমাদের দায়বদ্ধতা থাকা দরকার। রবীন্দ্রনাথের গানের একটা দর্শন আছে। উনি নানা ধরনের সুর গ্রহণ করেছেন। কিন্তু সৃষ্টির ক্ষেত্রে স্বকীয়তা বজায় রেখেছেন। সবার আগে ভাবতে হবে রবীন্দ্রনাথের গান বাংলা ভাষায় রচিত। সেই ভাষার সঙ্গে আমি বিদেশি মিউজিক ব্যবহার করতে পারি। কিন্তু আমার গায়নভঙ্গি সেটা হবে না। হলে সেটা খুব বেমানান শোনাবে।
রবীন্দ্রসঙ্গীত একটা সময় এলিট ক্লাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। আম জনতার কাছে তাকে ছড়িয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব জয়তী আজকের প্রজন্মকে দিতে চান। নিঃসন্দেহে তাঁর এই ভাবনা ইতিবাচক। এও বললেন, “তার মানে যেভাবে খুশি গাওয়াকে আমি সমর্থন করি না। স্বরলিপি না মেনে, কিছু গিমিক দিয়ে, একটা গান গেয়ে, লোকের কাছে পৌঁছে গেলাম, সেটা সমর্থনযোগ্য নয়। আজকাল বিভিন্ন মাধ্যমে এক্সপোজার অনেক বেশি। তাই অল্প কিছু জেনেই নিজেকে প্রচারের আলোয় নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা ইদানীং খুব বেড়েছে।”
আমরা দুজনেই এই প্রসঙ্গে সহমত পোষণ করলাম, যে, একটি গানকে সঠিক জানা এবং তার যথাযথ প্রয়োগ–সবকিছুর জন্যই সময় দরকার। সময় ছাড়া সেই বোধ ও চেতনা তৈরি হয় না। কপিরাইট প্রসঙ্গে ভালোমন্দ দুই দিক নিয়েই বললেন জয়তী। তাঁর কথায়, “কপিরাইট থাকাকালীন বহু ভালো শিল্পীর গান আটকে থেকেছে। আমরা বঞ্চিত হয়েছি তাঁদের গান শোনার ক্ষেত্রে। আবার কপিরাইট উঠে যাওয়ার পর শুরু হয়েছে যথেচ্ছাচার। যাঁদের মধ্যে সেই শ্রদ্ধাটা রয়েছে, তাঁদের কাছে কপিরাইট কোনও ফ্যাক্টরই নয়। কপিরাইট উঠে যাবার পরও রবীন্দ্রনাথের গানের অমর্যাদা করার কথা ভাবতেই পারেন না তাঁরা।”
জয়তী তাঁর কথা শেষ করলেন গভীর এক উপলব্ধির আলোয়–”রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন যতদিন বাঙালির অস্তিত্ব থাকবে, ততদিন থাকবে এ গান। আমি বলবো যতদিন বাংলা ভাষা বেঁচে থাকবে, ততদিন রবীন্দ্রসংগীত। ওঁর গান ছিল, আছে, থাকবে। এই প্রশ্নটা উঠতে পারে যে কোন রূপে বা ফর্মে থাকবে? সেটা অবশ্য সময়ই বলবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটাই কথা বলার। মা দুর্গার মূর্তি থেকে প্যান্ডেল–আমরা অনেক বিবর্তন দেখলাম, কিন্তু তাঁর দশটা হাত বা ত্রিনয়নকে বদলাবার চেষ্টা কেউ করেনি। অর্থাৎ বেসিক জায়গাটা যদি আমরা ঠিক রাখি, তাহলে চিন্তার কিছু নেই। যেটা ভালো, সেটা মানুষ গ্রহণ করবেন। যেটা নয়, সেটা করবেন না। কালের প্রবাহে ভালোটাই টিকে থাকবে। শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালোবাসা এগুলো হলো শাশ্বত। এসব বদলায় না। রবীন্দ্রনাথের গানও আমাদের কাছে তেমন।”