কাসল হয়ে মণিকরণ
দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম। নদী,পাহাড় আর অরণ্য মিলিয়ে স্বর্গীয় সৌন্দর্যে নয়নাভিরাম হিমাচল প্রদেশ। তারই ঝলক এই ধারাবাহিক রচনায়। আজ দ্বিতীয় পর্ব। লিখছেন শ্যামলী বন্দোপাধ্যায়।
হিমাচলের অনির্বচনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টুকরো টুকরো ছবি তুলে ধরার চেষ্টা করছি পাঠকের সামনে। যে দিকে তাকাই, জুড়িয়ে যায় চোখ। অনেক দেখার পরও সাধ মেটে না। গতকালই আমরা সিমলা থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কুফরিতে গিয়ে, সেখানকার অবর্ণনীয় রূপসুধা পান করেছি। আজ গন্তব্য কাসল। প্রাতরাশ সেরে সকাল সকাল রওনা দিলাম। হিমাচল প্রদেশের অন্যতম জনপ্রিয়, নয়নাভিরাম এই অঞ্চলে যাচ্ছি ভেবেই বেশ চনমনে ছিলাম। তার মধ্যে সকাল থেকেই আকাশ পরিষ্কার। ঝলমলে রোদ্দুর মেখে নিয়েছে চারপাশের প্রকৃতি। সেই খুশি মনে নিয়েই চলেছি। এও ভাবছি, পাহাড়ী পথে যে কখন রোদ থাকবে আর কখন নামবে বৃষ্টি, তা প্রকৃতি দেবীই জানেন। আমাদের ভাগ্য ভালো, দেবী মোটামুটি সদয়ই রইলেন।
আর এভাবেই চড়াই উৎরাই পথে চলতে চলতে, প্রায় আড়াই ঘন্টা পর পৌঁছলাম মান্ডি জেলার সুন্দরনগর লেকের কাছে। শুধু নামে নয়, আসলেই অপূর্ব সুন্দর এই লেক। বিয়াস নদী আর সুতলেজ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জল দিয়ে তৈরি এই কৃত্রিম লেক সবুজ পাহাড়ে ঘেরা। সঙ্গে উঁচু উঁচু গাছ যেন লেকের পারিপার্শ্বিক সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তুলেছে। কিছুক্ষণ নিরিবিলিতে এর সৌন্দর্য উপভোগ করে আবার এগিয়ে চললাম। এরপরেই এল প্যানডো ড্যাম। বাঁধের ওপরের রাস্তা ধরে যেতে যেতে নজরে এল কীভাবে বিয়াস নদীর জল থেকে বিদ্যুৎ তৈরির জন্য ওই দুর্গম পাহাড়ে বাঁধ দিয়ে জলাধার বানানো হয়েছে। শেষ পর্যন্ত আঁকাবাঁকা পথ ধরে পৌছে গেলাম ভিউ পয়েন্টে। সেখান থেকে পুরো লেকটা খুব ভালোভাবে দেখা যায়।
মান্ডি-মানালির পথেই পড়ল হানোগি মাতার মন্দির। শুধু ধর্মীয় স্থান বলে নয়, এর আশপাশের সুন্দর সবুজে ঘেরা পরিবেশও নজর কাড়ে। মার্চ মাস বলে আবহাওয়া বেশ মনোরম ছিল। দেবীকে প্রণাম করে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলাম। কারণ ড্রাইভার আগেই বলে দিয়েছেন, এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। কুল্লু উপত্যকার আগেই পথ ভাগ হয়ে চলল পার্বতী উপত্যকার মিনি ইজরায়েল অর্থাৎ কাসলের দিকে। এখানে বহু ইজরায়েলি পর্যটক আসেন বলে অনেকেই কাসলকে মিনি ইজরায়েল বলেন। যদিও বলা হয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতি আকর্ষণ ছাড়াও এক ধরনের গাঁজার নেশার টানে তাঁরা এখানে এসে বছরের পর বছর কাটিয়ে যান। এ দেশের কম বয়সীরাও অনেকে এই নেশার আকর্ষণে যান বলে জানালেন গাড়ির চালক কাম আমাদের গাইড।
যাওয়ার পথে দেখলাম অনেক টেন্ট। ছবির মতো সেই সব টেন্টে অনেকে রাত্রিবাস করেন। আছে রিভার র্যাফটিং এর ব্যবস্থা। ক্ষীর গঙ্গা, মালানা ও তোষ গ্রামে অনেকেই ট্রেকিংয়ের জন্য যান। আবার হাইকিং-এর জন্যও অনেকে এই জায়গাটিকে বেছে নেন। কাসলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পায়ে হেঁটে দেখাই সবচেয়ে ভালো বলে, আমার মনে হয়েছে। পাহাড়ী সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে যখন হোটেলে পৌঁছলাম তখন সূর্য প্রায় ডুবতে বসেছে। হোটেলের বাইরে থেকেই দেখছি বিশাল বিশাল গাছের জঙ্গল। দূরে সাদা বরফ বিছানো শান্ত পাহাড় আর তার নিচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে অশান্ত পার্বতী নদী। কী ভীষণ তার আওয়াজ! রাতে ঘরের দরজা জানলা বন্ধ করেও সেই আওয়াজ মালুম হলো। বেশ ঠান্ডা পড়েছিল। কিন্তু ঠান্ডার জন্য রাতের পার্বতীকে অনুভব করার তীব্র ইচ্ছে কোনওভাবে ত্যাগ করতে চাইনি। বারবার দরজা খুলে দেখেছি তার ভয়ংকর অথচ সুন্দর রূপ।
পরদিন ভোরে ঘুম ভাঙল পাখির সুমধুর ডাকে। নানারকম পাখির ডাক, সবুজ প্রকৃতি আর নদীর আওয়াজ–সব মিলিয়ে মনে একটি গানের কলি গুনগুন করছিল–মাটিতে যে আজ স্বর্গ এসেছে নামি…! ওই দিনই কাসল থেকে মণিকরণ হয়ে মানালি যাওয়ার কথা। প্রথমে গেলাম মণিকরণ। হিন্দু ও শিখদের পবিত্র ধর্মস্থান। নানা বর্ণের পতাকা উড়ছে। গাড়ি পার্কিং-এ রেখে পার্বতী নদীর শব্দ অনুসরণ করে এগিয়ে চললাম ব্রিজের দিকে। ব্রিজ পার হয়ে যাব গুরুদ্বার। যদিও ব্রিজ থেকে যাওয়ার সময় কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই হবে। দু পাড়ের দৃশ্য এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই, এতটাই অনির্বচনীয় তার রূপ !
কথিত আছে, পুরাণের সময় থেকেই এই জায়গাটিতে দেবতাদের যাতায়াত। মণিকরণের উত্তরে হরেন্দ্র পর্বত, দক্ষিণে পার্বতী গঙ্গা, পূর্বে ব্রহ্ম নালা এবং পশ্চিমে বিষ্ণুকুণ্ড। মণিকরণ ঘিরে একটি সুন্দর কাহিনি প্রচলিত এখানে। শোনা যায়, শিব ও পার্বতী এখানে এসে জায়গার আকর্ষণে মুগ্ধ হয়ে যান। একদিন বেড়ানোর সময় পার্বতীর কানের দুলের মূল্যবান পাথর হারিয়ে যায়। অনেক খুঁজেও না পাওয়ায় শিব রুষ্ট হয়ে তাণ্ডব শুরু করেন। তাঁকে শান্ত করতে শেষনাগ নিজের ফনা দিয়ে নদীর জলে আলোড়ন তোলেন। তাতেই তৈরি হয় উষ্ণ প্রস্রবণ। আর সঙ্গে সঙ্গে উঠে আসে সেই মণিও। এতে পার্বতীও খুশি আর শিবও শান্ত।
অন্যদিকে শিখ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে আবার পৃথক একটা কাহিনি প্রচলিত। কাহিনি অনুযায়ী, গুরু নানক ১৫৭৪ সালে যখন এখানে আসেন, তখন, তাঁর এক ক্ষুধার্ত শিষ্যর খিদে মেটানোর জন্য সব কিছুর আয়োজন করলেও, আগুনের ব্যবস্থা করতে পারেননি তিনি। সেই সময় একটা পাথর তুলতেই, বেরিয়ে পড়ে এই উষ্ণ প্রস্রবণ। সেখানেই শিষ্যর জন্য খাবার তৈরি করেন। এখনও প্রস্রবণের জলে হাঁড়িতে চাল বসালে ভাত হয়ে যায়। এখানে ছেলে ও মেয়েদের জন্য আলাদা স্নানের ব্যবস্থা আছে। অনেকেই দেখলাম স্নান করছেন। জলে সালফার থাকায় নানারকম চর্মরোগ নাকি সেরে যায়। আমরাও একটু জল হাতে নিয়ে মাথায় ঠেকালাম।
প্রস্রবণের পাশেই আছে মূল শিব-পার্বতীর মন্দির, শ্রীকৃষ্ণ মন্দির, রামচন্দ্র মন্দির, হনুমান মন্দির আর অবশ্যই গুরুদ্বার। এখানে লঙ্গরখানায় নিয়মিত খাবার পরিবেশন করা হয় বহু মানুষের মধ্যে। রামচন্দ্র মন্দিরটি ১৭ শতকে তৈরি করেন রাজা জগত সিং। শোনা যায়, এই মন্দিরটি অযোধ্যা থেকে রামচন্দ্র নিজেই মণিকরণ নিয়ে এসেছিলেন। সব মন্দিরগুলো দেখে নিলাম। গুরুদ্বারে প্রসাদও পেলাম। তবে, এই জায়গা ঘিরে কাহিনি যাই থাক, মুখ্য আকর্ষণ অপরূপ প্রকৃতি ! সব মিলিয়েই এখানে একবার গেলে বারবার যেতে ইচ্ছে করবেই। আমাদের অবশ্য আর বেশিক্ষণ এখানে থাকার উপায় নেই। এবার যাব মানালির পথে। এগিয়ে চললাম গাড়ি পার্কিং জোনের দিকে। (চলবে)
***ছবি : লেখক