Monday, February 3, 2025
ঠিকানা দিকশূন্যিপুর

গঙ্গাসাগর একবার

দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম। সব তীর্থ বারবার, গঙ্গাসাগর একবার ! চিরাচরিত এই প্রবাদ কতটা মিথ আর কতটা প্রাণের অনুভব, সেই বিষয়েই নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন লিপি চক্রবর্তী

তিনি মনুর বংশধর, মানে ব্রহ্মার বংশলতিকায় তাঁর স্থান। শুধু শুধুই তাঁকে চোর অপবাদ দিয়ে বসল সগর রাজার ষাট হাজার ছেলে! এই সগর রাজা আবার রামচন্দ্রের বংশধর। আসলে হয়েছিল কী, দেবরাজ ইন্দ্র তো সর্বদাই সিংহাসন খোয়ানোর ভয়ে অস্থির থাকতেন। সব রাজারাই চিরকাল তাই থাকেন। তখনও পর্যন্ত একমাত্র দেবরাজ ইন্দ্রই একশোটা অশ্বমেধ যজ্ঞ সমাপন করেছেন। এদিকে সগর রাজা নিরানব্বই খানা অশ্বমেধ যজ্ঞ করে ফেলেছেন। যেই না সগর রাজা একশোতম যজ্ঞ করতে গেলেন, ইন্দ্রের তো মাথায় হাত! দুষ্ট বুদ্ধি খেলে গেল তাঁর মাথায়। সগর রাজার অশ্বমেধের ঘোড়াটাকে চুরি করে তিনি লুকিয়ে রাখলেন কপিল মুনির আশ্রমে। বেচারা সাধাসিধে মুনি জানতেও পারলেন না। এবার সেই ঘোড়া খুঁজতে বেরিয়ে সগর রাজার ষাট হাজার ছেলে ঘোড়াটিকে আবিষ্কার করল কপিল মুনির আশ্রমে। ব্যাস, আর যায় কোথায়! বলে কিনা কপিল মুনি চোর!

সাংখ্য দর্শনের প্রবক্তা এই নির্লোভ মুনি রেগে গিয়ে ভস্ম করে দিলেন ষাট হাজার সগর-সন্তানকে। দেবরাজ ইন্দ্রের কী হয়েছিল, তা অবশ্য জানা যায় না। যাই হোক, সগর রাজার আর এক বংশধর অংশুমান অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে কপিল মুনিকে সন্তুষ্ট করে সেই ষাট হাজার সগর-পুত্রের প্রাণ ফিরে পাওয়ার প্রতিশ্রুতি পেল। শর্ত এই, গঙ্গা দেবী মর্ত্যে এসে সেই ভস্ম স্পর্শ করলেই, সগর-সন্তানরা প্রাণ ফিরে পাবেন। অংশুমান আর তাঁর জীবৎকালে সেটা পেরে ওঠেননি। পরে তাঁর বংশধর ভগীরথ তপস্যা-বলে মা গঙ্গাকে মর্ত্যে নিয়ে আসেন এবং মা গঙ্গার স্পর্শে সগর-পুত্ররা প্রাণ ফিরে পান। ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ এ নয়। ‘সব তীর্থ বারবার, গঙ্গাসাগর একবার’–সেই গঙ্গাসাগরের প্রাণকেন্দ্র হল কপিল মুনির আশ্রম।

কলকাতা থেকে ডায়মন্ড হারবার রোড ধরে ডায়মন্ড হারবার পেরিয়ে নামখানার রাস্তায় খানিক এগিয়ে গঙ্গাসাগর লেখা বিশাল গেট ডানহাতে। সেই গেট দিয়ে তিন কিলোমিটার মতো এগোলে মুড়ি গঙ্গার ধারের ঘাটটির নাম লট ৮। আধঘন্টার লঞ্চ জার্নিতে ওপারে গঙ্গাসাগর। তবে সাগর পারে পৌঁছতে আরও বেশ কিছুক্ষণ গাড়িতে চাপতে হবে। আমাদের গন্তব্যস্থল ইয়ুথ হস্টেল। ঝাঁ চকচকে, বিশাল বাগান ঘেরা ইয়ুথ হোস্টেলে ঢুকেই মনটা বেশ ভালো হয়ে গেল। বারান্দা থেকেই কপিল মুনির আশ্রমের চূড়া দেখা যাচ্ছে। যাওয়ার আগে অনেকের কাছেই অনেক নেতিবাচক কথাবার্তা শুনেছিলাম। কিন্তু, যেহেতু সময়টা মেলার কিছুদিন আগে, তাই পরিচ্ছন্নতার অভাব দেখিনি।

আমাদের পৌঁছতে দুপুর দেড়টা হয়েছিল। তাই বিকেলে একেবারে বের হলাম। প্রথমেই কপিল মুনির আশ্রম দর্শন। তারপর বাকি সব। বিশাল মন্দির চত্বর। কপিল মুনি, গঙ্গাদেবী সহ আরও অনেক দেবতার অবস্থান মন্দিরে। চত্বর ঘিরে অসংখ্য দোকানপাট, যার মধ্যে বেশিরভাগই খাবারের। আশ্রমের সামনের রাস্তা সোজা গিয়ে মিশেছে সাগরে। আমরা অনেকটা দূরে হেঁটে গেলাম, লাইট হাউসের দিকে। সেখানে তখন সাগরমেলার প্রস্তুতি চলছে। বাঁধ তৈরির কাজ হচ্ছে। জেলেরা চিংড়ি মাছ বাছাই করছে জাল পেতে। অন্যান্য মাছও আছে। কিছু এমনিই বিক্রি হবে। কিছু শুঁটকি তৈরি হবে। কপিল মুনির আশ্রমে সন্ধের আরতি বাকস্তব্ধ করে দিল। শাঁখ-ঘণ্টা-মন্ত্রধ্বনি–সব মিলিয়ে এক অপূর্ব পরিবেশ !

পরদিন সকালে গঙ্গাসাগরে স্নানের প্রস্তুতি। একে তো শীত পড়তে শুরু করেছে। তার ওপর সাগরের হাওয়া। বেশ নার্ভাস অবস্থা। তাও একটা টোটো চড়ে একটু দূরে গেলাম পুণ্য করতে। হাঁটুডোবা ঘোলা জল। এখানেই নাকি স্নানের জন্য বেশি জল আছে, টোটো চালকের বয়ানে। আমি সকলের শুকনো জামাকাপড়ের দায়িত্ব বহন করেই পুণ্য সঞ্চয় করলাম, বাকিরা জলে নেমে ! আগের দিন পুজো দিতে পারিনি। এখন সকলে মিলে চললাম কপিল মুনির আশ্রমে পুজো দিতে। পুজো তো নিশ্চিন্তে দেওয়া হলো। কিন্তু তারপর গরুর আদরের অত্যাচার ! সে এক অসহনীয় অবস্থা। তাড়াতাড়ি পুজোর সামগ্রী সহ মন্দির চত্বর ছাড়লাম আমরা। তবে, তারই মধ্যে দারুন মিষ্টি জলের নরম নারকেল সহ ডাব খেয়ে উপবাস ভঙ্গ করতে ভুলিনি।

মন্দির ট্রাস্টের ধর্মশালা মন্দির লাগোয়া। সেখানে দুপুরের প্রসাদ পেলাম। আমাদের সঙ্গী এক দাদা আগের দিন কীভাবে যেন ব্যবস্থা করেছিলেন। দুপুর একটু বিকেলের দিকে গড়াতেই দুটো টোটো নিয়ে আমরা বের হলাম জায়গাটা ঘুরে দেখতে। অনেক মন্দির আছে দেখার মতো। মনসা মন্দিরের পাশেই আয়লার ক্ষতচিহ্ন এখনও বর্তমান। সামনেই সমুদ্রের ঠিকানা। বহু পুরোনো নাগেশ্বর মন্দির আর জলাশয় ঘিরে আধুনিক আনন্দউদ্যান সময় কাটানোর জন্য খুব ভালো ব্যবস্থা। বিশাল জলাশয়ের মাঝখানে আলোর কারিকুরি। আছে গোষ্ঠমাতার মন্দির। অনেক দেবদেবীর মাঝখানে অধিষ্ঠিত দেবতা শিব ঠাকুর। মূল শিবের মন্দিরটি বহুদিনের। তবে দক্ষিণ ভারতীয় রীতি অনুযায়ী সাজানো মন্দির এবং তার বাইরের অংশে আধুনিকতার ছাপ স্পষ্ট। পুরাতন বা আধুনিক যাই বলা হোক, মন্দিরটি ভারী সুন্দর। মন ভরে যায়।

পরদিন ঘরে ফেরার পালা। ফিরব নামখানা হয়ে। তাই টোটো চড়ে যেতে হবে বেণুবন। সেখান থেকে লঞ্চে চেপে হাতানিয়া-দোয়ানিয়া নদী পেরিয়ে নামখানা। এই দেড় ঘণ্টার নদী পেরোনো যে এত আনন্দের হবে, ভাবিনি। চারিদিকে জঙ্গলে ঘেরা ছোট ছোট দ্বীপ। আর আমাদের সঙ্গী অসংখ্য ঝাঁকে ঝাঁকে সীগাল। দেড় ঘণ্টা সময় কোথা দিয়ে পার হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। লঞ্চ থেকে নেমে টোটোতে নামখানা স্টেশন। তারপর যেন অনিচ্ছা সত্বেও ফিরতেই হবে জেনে ট্রেনে চড়ে বসা। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে জানাই, ইয়ুথ হোস্টেলে খাবারের ব্যবস্থা নেই। তবে ঠিক গেটের বাইরে একটি দোকান আছে। সেখানে যেমন বলবেন, তেমনই রান্না খাবার মিলবে। থাকা বা ঘোরার জন্য টোটো ভাড়ার কথা লিখলাম না। কারণ সময় ভেদে সব কিছুরই পরিবর্তন হয়। তবে সাধ্যের মধ্যে এটুকু বলতে পারি।

ছবি : লেখক