Tuesday, May 13, 2025
ঠিকানা দিকশূন্যিপুর

চপল ঝর্নার দেশে কয়েকদিন

দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম। পর্যটন আকর্ষণে অতুলনীয় ওড়িশার কেওনঝর নিয়ে লিখছেন লিপি চক্রবর্তী। তিন পর্বে প্রকাশিতব্য এই ধারাবাহিক ভ্রমণ রচনার দ্বিতীয় পর্ব আজ।

ভীম ফলসের বিশালত্বের মোহ কাটিয়ে বের হতে কেটে গেল অনেকটা সময়। এবার দৌড় গুন্ডিচা ঘাগী দেখার জন্য। ঠিক এই সময়ই ঝেঁপে এল বৃষ্টি। গাড়ি থেকে নামতেই মনে হলো, ঝরঝর আওয়াজে বৃষ্টি গতি বাড়িয়ে দিল আমাদের জন্যই। কিন্তু ছাতা খুলতে গিয়ে ভাবলাম, আরে এইটুকু বৃষ্টিতে আবার ছাতা মাথায় দেয় নাকি কেউ ! অথচ, কী আওয়াজ জলের! কান পেতে রইলাম একটু সময়। এবার খানিকটা বুঝলাম–অনেক উঁচু থেকে জল পড়ার আওয়াজ যেন। কিন্তু গাছপালায় ছাওয়া পাহাড়ী পরিবেশ। জল কই!

Img 20230815 Wa00312
চপল ঝর্নার দেশে কয়েকদিন 15

দু’ চারটে অল্প বয়সী ছেলেমেয়ের উৎসাহ দেখে, তাদের পিছু পিছু গিয়ে হঠাৎ যে প্রপাতের সামনে পড়লাম, তাকে দেখে যুগপৎ ভয় আর বিস্ময়–একসঙ্গে আবিষ্ট করে ফেলল। বিশাল উঁচু পাহাড়ের গা বেয়ে বিস্তৃত জলরাশি ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এত তার গতি যে, জলের কণা ধোঁয়ার মতো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ঢেকে দিচ্ছে চারদিক। গতির মতোই তার আওয়াজ ! তেমনই তার রূপ। সিঁড়ি দিয়ে তার পায়ের কাছে নামতেই যেন হেসে গড়িয়ে জলের ঝাপটা দিয়ে এক নিমেষে ভিজিয়ে দিল আমাদের। অমোঘ টানে তবুও পিছল পাথরে পা রেখে রেখে নেমে গেলাম আরও একটু তার ছোঁয়া পেতে।

এরপর গুন্ডিচা ঘাগীর বিস্তৃতি দেখতে উঠলাম ওয়াচ টাওয়ারে। যেখান থেকে মূল জলের ধারা ছুটে আসছে, সেটা পাহাড়ের ওপরে প্রায় সমতল এক বিস্তৃত প্রান্তর। বিশাল এক জলরাজ্যের রাজা এই ঝর্না। ছোট্ট একটা নির্জন ব্রিজ পেরিয়ে সেই প্রান্তরের কাছাকাছি যাওয়া যায়। মন্ত্রমুগ্ধের মতো এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ঘুরে বেড়াচ্ছি। বৃষ্টির তোড় সত্যি এবার বেড়েছে। তাতে ঝর্নার রূপ পরিবর্তিত হচ্ছে বারবার। এমন রূপসীর সামনে বাকস্তব্ধ হওয়া ছাড়া উপায় নেই।

গুন্ডিচা ঘাগী দেখার অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতাকে সঙ্গী করে এবার যাব সীতাভিঞ্জ। এখানে এক বিশাল পাথরের গায়ে আছে ফ্রেস্কো আর শিলালিপি। প্রায় দু’শো ফুট উঁচুতে উঠলাম। অর্ধেক খোলা ছাতার মতো আকার নিয়ে পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে আর একটি পাথর। এখানেই নাকি রাম-রাবণের যুদ্ধ হয়েছিল। লব আর কুশকে নিয়ে সীতাদেবী এই পাথরের নীচে মন্দিরের মতো জায়গায় পূজিতা। পাথর বেয়ে বেয়ে উঠে যাওয়া যায় একদম পাহাড়ের মাথায়। সে এক রোমাঞ্চকর অভিযান হল আমাদের।

পাহাড়ের উল্টো দিকে ঘাসজমির ওপর দিয়ে হেঁটে গেলাম জলের আওয়াজ লক্ষ্য করে। সীতানদী বয়ে চলেছে প্রবল গতিতে। ওই পাহাড়ের পিছন থেকে ঝর্না হয়ে বেরিয়ে এসে নদীতে রূপান্তরিত হয়েছে। বলা বাহুল্য, এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ খুবই মনোমুগ্ধকর। এককথায় প্রায় জনহীন, শান্ত ও অপূর্ব। মনের যাবতীয় ক্লেদ, অসূয়া উধাও হয়ে যায় এমন অবর্ণনীয় জায়গায় এসে।

Img 20230815 Wa0045
চপল ঝর্নার দেশে কয়েকদিন 16

যখন ফিরে আসছি, মনে হচ্ছে যেন নিজেকে জোর করে টেনে আনতে হচ্ছে। দুপুর গড়াচ্ছে তখন বিকেলের দিকে। কথা আছে, ফেরার পথে ঘাটগাঁও-এর তারিণী মন্দির দেখব। সেই মতোই পৌঁছে গেলাম। বিশাল মন্দির চত্বর। অনেকগুলো মন্দির রয়েছে এখানে। লোকশ্রুতি বলে, কেওনঝরের রাজা পুরী থেকে মা তারিণীকে কেওনঝরে নিয়ে আসছিলেন। মা তারিণী শর্ত দিয়েছিলেন, তিনি রাজার সঙ্গে আসবেন, কিন্তু,  রাজা যেন কখনও পিছন ফিরে না দেখেন। যদি দেখেন, তবে, মা সেখানেই থেকে যাবেন। আর রাজার সঙ্গে যাবেন না।

রাজা আসছিলেন ঘোড়ায় চেপে। মা রাজার পিছনে। মায়ের গায়ের গয়নার ঝমঝম আওয়াজে রাজা নিশ্চিন্ত ছিলেন যে মা আসছেন তাঁর পিছনে। সেই সময় ঘাটগাঁওতে ছিল গভীর জঙ্গল। হঠাৎ রাজা খেয়াল করেন মায়ের গায়ের গয়নার আওয়াজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আসলে জঙ্গলের কাদায় গয়না ঢেকে গিয়ে আওয়াজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেটা রাজা বোঝেননি। পিছন ঘুরে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে মা তারিণী থেমে যান এখানে। এই হল মা তারিণী মন্দির তৈরির গল্প। কিন্তু সন্ধের আগে মন্দির খুলবে না। তাই বাইরে থেকে মন্দিরগাত্রের কারুকাজ দেখেই বিদায় নিতে হলো। আগামিকাল আবার যাব ঝর্নাদের খোঁজে।

◾ছবি : লেখক