Monday, February 3, 2025
তবু অনন্ত জাগে

ছবি ও ছায়া

জীবনমরণের সীমানা ছাড়িয়ে ওঁরা আজ বহু আলোকবর্ষ দূরের এক জগতে। তবু আছেন ওঁরা আমাদের মাঝে। থাকবেন চিরদিন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সিনেমা জগতের সেইসব মানুষ, যাঁদের অবদান ছাড়া অসম্পূর্ণ আমরা–তাঁদের নিয়েই এই বিশেষ কলম মাসে একবার। এবারে আমরা শ্রদ্ধা জানাব ভারতীয় ছবির কিংবদন্তি অভিনেত্রী ছায়া দেবীকে। লিখেছেন শ্যামলী বন্দোপাধ্যায়

অনেকেরই মনে আছে, ‘থানা থেকে আসছি’ ছবির সেই দৃশ্যের কথা। সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছেন গৃহকর্ত্রী (ছায়া দেবী)। তখন তার সামনে সাব ইনস্পেক্টর হিসেবে দাঁড়িয়ে উত্তমকুমার। আগন্তুককে দেখে বিরক্ত হলেও, গৃহকর্ত্রী সৌজন্য দেখিয়ে নমস্কার জানিয়ে বলেন, এ বিষয়ে (যে বিষয়কে ঘিরে ইন্সপেক্টরের আগমন) আমার কিছু করার আছে বলে তো মনে হয় না। তখন তাঁকে থামাতে এগিয়ে আসে মেয়ে (অঞ্জনা ভৌমিক)। মেয়ে পরিস্থিতি সামলানোর জন্য মাকে ইনস্পেক্টর আসার পর থেকে কী কী ঘটনা ঘটেছে, তা জানাতে থাকে। তখন গৃহকর্ত্রী ইন্সপেক্টরকে আপাদমস্তক দেখে বলেন, এর মধ্যেই দেখছি আপনি আমার মেয়ের মনে বেশ ছাপ ফেলে দিয়েছেন। ইন্সপেক্টর সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেন, ওটা বয়সের ধর্ম মিসেস সেন। নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে গৃহকর্ত্রী ইন্সপেক্টরকে বলেন, বুঝেছি। অনেক রাত হয়েছে। এবার আপনি আসুন। ওই কয়েক মিনিটের উপস্থিতি আর দু চারটে সংলাপের মধ্যেই বোঝা যায় কত বড় মাপের অভিনেত্রী ছিলেন তিনি।   

261 Nirjan Saikate 2
ছবি ও ছায়া 8

ভারতীয় সিনেমায় সেরা অভিনেত্রীদের মধ্যে ছায়া দেবী যে অন্যতম সে বিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। বাংলা ছাড়াও হিন্দি, তামিল, অসমীয়া ভাষা মিলিয়ে প্রায় ১৫০টি ছবিতে অভিনয় করেছেন। অভিনয় ছাড়াও তিনি ছিলেন নাচ-গানে সমান পারদর্শী। তাঁর জীবনকথা ছিল রঙিন পর্দার কাহিনির মতোই বৈচিত্রপূর্ণ। জন্ম ১৯১৪ সালে, ভাগলপুরের এক অভিজাত পরিবারে। আসল নাম কনকবালা গাঙ্গুলি। বাবার নাম হারাধন গাঙ্গুলি। ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি প্রবল টান ছিল কনকের। তাই লেখাপড়ার সঙ্গে ভাগলপুরেরই দামোদর মিশ্রের কাছে শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের তালিম নিতে থাকেন। 

সুন্দরভাবেই সেই জীবন কাটছিল কনকের। বাবার চাকরি সূত্রে তাঁদের ভাগলপুর থেকে দিল্লি চলে যেতে হলো। সেখানে তিনি ইন্দ্রপ্রস্থ স্কুলে ভর্তি হলেন। স্কুলে পড়াকালীন, মাত্র ১১ বছর বয়সে রাঁচির অধ্যাপক বুদ্ধদেব চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। যদিও সেই বিয়ের অভিজ্ঞতা একেবারেই সুখকর ছিল না। বিয়ের পরেই তাঁর স্বামী জানিয়ে দেন, তিনি সংসার করতে ইচ্ছুক নন, অধ্যাপনাতেই মন দিতে চান। তাই নতুন বউকে ছেড়ে চলে যান নিজের কর্মক্ষেত্রে। অগত্যা কনকও তাঁর বাবার কাছেই ফিরে যান। বলা যায়, জীবনের লড়াই শুরু একরকম বিয়ের পরপরই।

Images 6 2
ছবি ও ছায়া 9

এরপর তাঁরা চলে আসেন কলকাতায়। উত্তর কলকাতার যেখানে তাঁরা বাড়ি নিয়েছিলেন, তাঁর পাশেই থাকতেন সঙ্গীতাচার্য কৃষ্ণচন্দ্র দে। গানের প্রতি আকর্ষণ ছিল বলে তখন তিনি আবার নতুন করে শাস্ত্রীয়সঙ্গীতে তালিম নেওয়া শুরু করেন কৃষ্ণচন্দ্র দে’র কাছে। এছাড়াও শাস্ত্রীয় নৃত্য শিখতে শুরু করেন শম্ভূ মহারাজের কাছে। এভাবেই তাঁর ভাল থাকার পথ খুঁজে নেন ছায়া দেবী। বলা বাহুল্য, নাচ-গানের এই পারদর্শিতার কারণেই সিনেমায় সুযোগ পান কনক। এ ব্যাপারে সাহায্য করেন তাঁর পিসতুতো দাদা শ্রীশচন্দ্র। ইস্ট ইন্ডিয়া ফিল্ম কোম্পানির ম্যানেজার উপেন গোস্বামী শ্রীশচন্দ্রের বন্ধুস্থানীয় ছিলেন। তাঁরই সহযোগিতায় কনককে ফিল্মে নিয়ে এলেন শ্রীশচন্দ্র। ছবির নাম ‘পথের শেষে’। পরিচালক জ্যোতিষ মুখোপাধ্যায়। কনকবালা নাম বদলে তাঁর সিনেমার নাম হলো ছায়া দেবী। 

‘পথের শেষে’ ছবিতে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেন ছায়া দেবী। পারিশ্রমিক পান সাড়ে সাত টাকা। তবে ওইটুকু সময়ের অভিনয়েই মুগ্ধ করে দেন কিংবদন্তি চলচ্চিত্র পরিচালক দেবকীকুমার বসুকে। ফলস্বরূপ দেবকী বসু পরপর দুটি ছবিতে সাইন করালেন ছায়া দেবীকে। জীবনের দ্বিতীয় ছবি ‘সোনার সংসার’, আর তাতেই একেবারে নায়িকার চরিত্রে। শুধু তাই নয়, ১৯৩৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবিতে অভিনয় করে খ্যাতি তো পেলেনই, সেইসঙ্গে সোনার মেডেলও পেয়েছিলেন ছায়া দেবী। ‘সোনার সংসার’ ছবির পর অভিনয় করেন ‘বিদ্যাপতি’ ছবিতে। দেবকী বসুর দ্বিভাষিক ছবি ‘বিদ্যাপতি’-তে রানি লক্ষ্মীর ভূমিকায় দেখা গেছে তাঁকে। এই ছবিতে তাঁর অভিনয় দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধ করে দেয়। জাতীয় পুরস্কারও পান। 

Images 5 2
ছবি ও ছায়া 10

দেবকীকুমার বসুকে শিক্ষক হিসেবে পাওয়ায়, ছায়া দেবীর অভিনয় প্রতিভার যথার্থ বিচ্ছুরণ ঘটতে থাকল। এরপর থেকে একটার পর একটা ছবিতে অভিনয় করে দর্শকমন জয় করতে থাকেন তিনি। ‘রাঙা বউ’ ছবিতে অভিনয়ের সঙ্গে তাঁর গলার গান অন্য মাত্রায় নিয়ে গেল ছায়া দেবীর অভিনয় যাত্রাকে। ১৯৩৯ সালে সুশীল মজুমদার পরিচালিত ‘রিক্তা’ ছবিতে অহীন্দ্র চৌধুরী-ছায়া দেবী জুটি দারুণ সাড়া ফেলে। সেই ছবিতেও ছায়া দেবীর নিজের গলায় গাওয়া গান ভূয়সী প্রশংসা পায়। তপন সিংহের ‘হারমোনিয়াম’ ছবিতে ‘আহা ছল করে জল আনতে আমি যমুনাতে যাই’ গানটি তো আজও ফিরে ফিরে আসে আলোচনায়। যদিও তিনি ছবিতে প্লেব্যাক করতে ততটা আগ্রহী ছিলেন না। বলতেন, গান আমার গোপন সুখ। 

এভাবে যখন সাফল্যের প্রায় শীর্ষে সে সময় কোনও এক অজ্ঞাত কারণে আচমকাই তিনি অভিনয় জগত থেকে সরে যান। সেই সময় তিনি মূলত রেডিওতে অনুষ্ঠান করতেন। পরিচালক তপন সিংহের মতে, ভারতে ছায়া দেবীর মতো এত প্রতিভাধর অভিনেতা খুব কম দেখা গেছে। তিনি ছিলেন একজন কমপ্লিট আর্টিস্ট। সিনেমায় তাঁর প্রত্যাবর্তন ঘটে ১৯৪০ সালে ‘অভয়ের বিয়ে’-র হাত ধরে। অভিনয় ছিল তাঁর সহজাত। সহজেই চরিত্রের মধ্যে ঢুকে যেতে পারতেন বলে কখনও দর্শককে হাসাতেন, কখনও কাঁদাতেন আবার কখনও বিরাগভাজন হতেন। সিনেমায় ফিরে আসার পর হেমন্ত গুপ্তর পরিচালনায় ‘বন্দিতা’, কালীপ্রসাদ ঘোষের ‘ধাত্রীদেবতা’, হিরণ্ময় সেনের পরিচালনায় ‘বার্মার পথে’, প্রেমেন্দ্র মিত্রের থ্রিলার ছবি ‘কুয়াশা’–এভাবে পরপর নানা ধরনের ছবি করতে থাকেন ছায়া দেবী। 

Images 7 1
ছবি ও ছায়া 11

প্রসঙ্গত, এই সময় থেকেই ভারতীয় সিনেমার প্রেক্ষাপটে বদল ঘটতে শুরু করে। নতুন পদ্ধতিতে ছবি নির্মাণ শুরু হয়। বায়োস্কোপের পর আসে ফিল্ম যুগ। সেই সময়ে নতুন অভিনেত্রীরা আসায় নায়িকা থেকে পার্শ্বচরিত্রে সরে যেতে হয় ছায়া দেবীকে। যদিও অভিনয় গুণে অনেক সময় প্রধান চরিত্রকেও ছাপিয়ে যেতেন তিনি। বিশেষত, তপন সিংহের বেশ কয়েকটি কালজয়ী ছবিতে তাঁর অভিনয় অমর হয়ে আছে। এক্ষেত্রে, নির্জন সৈকতে (১৯৬৩), হাটে বাজারে (১৯৬৭) এবং ‘আপনজন’(১৯৬৮) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিশেষত, ‘আপনজন’, বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এক বৃদ্ধার ভূমিকায় ছায়া দেবীর সংবেদনশীল অভিনয় স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। 

শুধু তপন সিংহ নন, তাঁর সময়ের সমস্ত প্রথম সারির পরিচালকের ছবিতেই অপরিহার্য ছিলেন ছায়া দেবী। উল্লেখ্য মৃণাল সেন পরিচালিত ‘রাত ভোর’(১৯৫৬) এবং ‘অবশেষে’(১৯৬২)। তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে অসমিয়া ভাষায় ভূপেন হাজারিকা পরিচালিত প্রথম ছবি ‘এরা বাটর সুর’(১৯৫৬), বাংলায় ‘সপ্তপদী’(১৯৬১),‘সাত পাকে বাঁধা (১৯৬৩), ‘আরোহী’ (১৯৬৫), ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গী’(১৯৬৭), অরুন্ধতী দেবী পরিচালিত ‘পদি পিসির বর্মি বাক্স’(১৯৭২), হিন্দিতে ‘কোরা কাগজ’(১৯৭৪), অমিতাভ বচ্চন-রেখার সঙ্গে  ‘আলাপ’ (১৯৭৭) ইত্যাদি। এছাড়াও বহু ছবিতে মনে রাখার মতো অভিনয় করেন তিনি। 

Images 8
ছবি ও ছায়া 12

একটু পৃথকভাবে বলতে হয় নীহাররঞ্জন গুপ্তর লেখা ‘উত্তর ফাল্গুনী’ ছবিটির নাম। পরিচালনা করেন অসিত সেন। প্রযোজনায় উত্তমকুমার। ছবিতে জীবনের দুর্বিপাকে পড়ে দেবযানী হয়ে উঠেছিল পান্নাবাঈ। কিন্তু কন্যা সুপর্ণার গায়ে কলঙ্কের আঁচ সে লাগতে দেয়নি। মেয়ের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল, যাতে সুপর্ণা সুস্থ স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে। সেই দেবযানীকে আত্মহত্যার কবল থেকে উদ্ধার করে জীবনের আলো দেখিয়েছিল যে বাঈজি, সেই চরিত্রে ছায়া দেবীর দাপুটে অভিনয় আজও বাংলা ছবির গুণগ্রাহী দর্শকের চোখে লেগে রয়েছে। ‘উত্তর ফাল্গুনী’-র হিন্দি ভার্সন ‘মমতা’-তেও নিখুঁত হিন্দি-উর্দু উচ্চারণে ছায়া দেবী ছিলেন সাবলীল। 

সেসময় তাঁর এই সাফল্য অনেকেরই ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নানাভাবে অপদস্থ করার চেষ্টা করলেও তাঁকে আটকানো যায়নি। নিজের কাজ ছাড়া অন্যদের সঙ্গে খুব একটা মেলামেশা করতেন না। আবার কারও সঙ্গে কখনও খারাপ ব্যবহারও করতেন না। সবসময়ে একটা গাম্ভীর্য বজায় রেখে চলতেন। তাঁর ব্যক্তিত্বের জন্যই কেউ তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চট করে সাহস পেত না। কিন্তু খুব ভাল মনের মানুষ ছিলেন। সবার সঙ্গে সুন্দর করেই কথা বলতেন। বিয়ের খারাপ অভিজ্ঞতার কারণেই হয়তো আর দ্বিতীয়বার বিয়ে করেননি। একাই কাটিয়ে গেছেন।  

Images 9 2
ছবি ও ছায়া 13

শেষের দিকে শরীরের থেকেও মন ভেঙে যাচ্ছিল। মুখে কষ্টের কথা স্বীকার না করলেও চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে একদম কথা বলতে চাইতেন না। এমনকী নিজের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পাওয়া মেডেলগুলোও একসময়ে বিক্রি করে দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন। যদিও মুখে কখনও মন খারাপের কথা স্বীকার করতেন না। ২০০১ সালে তাঁর হার্ট অ্যাটাক হয়। শ্যামবাজারের নার্সিং হোমে ভর্তি হন। আক্ষেপ, সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরা হয় না তাঁর। ওই বছরের ২৭ এপ্রিল অনন্তলোকে যাত্রা করেন সকলের প্রিয় ছায়া দেবী। তবে, সে তো তাঁর নশ্বর দেহের মৃত্যু। ছায়া দেবী তাঁর অভিনীত ছবিগুলির মধ্য দিয়ে চিরকাল থেকে যাবেন ভারতীয় সিনেমার দর্শক-অন্তরে।