জুতো : এক বাঙ্ময় নীরবতা
নতুন ছবির মুক্তি হোক বা নির্মাণ। পোস্টার, ট্রেলার রিলিজ। ছবি হিট এবং ফ্লপ। তারকাদের জীবনের ওঠাপড়া। বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে সিনেমার দুনিয়ায় প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলেছে নানা বৈচিত্রপূর্ণ ঘটনা। সেইসবই এই বিভাগে, প্রতি সপ্তাহে।
লিখেছেন অজন্তা সিনহা
নতুন প্রজন্মের সিনেমা নির্মাতাদের যে দিকটা সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে আমার, সেটা হলো, তাঁদের নতুন, অভিনব, জীবনধর্মী ও বিচিত্র বিষয়ভাবনা ! এত বছর সিনেমা সাংবাদিকতা করার ব্যাপারটা কোথাও কাজটার মধ্যে যে গতানুগতিকতা এনে দেয়, তার থেকে মুক্তির পথ আমার জন্য অন্তত এই নতুনদের কাজ নিয়ে লেখা। শুধু বিষয়ভাবনা নয়, নির্মাণ কৌশল থেকে ছবির বিন্যাস, এমনকী প্রচার ও প্রদর্শন–সবেতেই তাঁরা চেনা ছকের বাইরে পা ফেলায় দ্বিধাহীন।
সাম্প্রতিককালের একজন অন্যতম প্রতিভাবান স্বাধীন চিত্র পরিচালক সৌরিশ দে। তাঁর ছবি ‘জুতো’ প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে ওপরের এই ভূমিকাটুকু না করে পারলাম না। পরিচালনার পাশাপাশি সৌরিশ একজন লেখক ও সম্পাদক এবং কালারিস্ট। সম্পাদনার ক্ষেত্রে তাঁর অভিজ্ঞতা সৌরিশের এই স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি ‘জুতো’ নির্মাণে অনেকটাই সাহায্য করেছে। ‘জুতো’ অত্যন্ত অর্থবহ ও স্মার্ট একটি নিবেদন রূপে ইতিমধ্যেই সমাদৃত। সাইলেন্ট ছবি ‘জুতো’ হলো এই বিভাগে দ্বিতীয় প্রচেষ্টা। প্রথম ছবি ‘আসা যাওয়ার মাঝে’। ভাবনার বিন্যাসের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফি ও কালার স্কেপ এবং ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর ছবিটিকে উৎকর্ষতার চরমে পৌঁছে দিয়েছে। এই মুহূর্তে ৪টি উৎসবে মনোনীত ‘জুতো’।
একজন মানুষ, যার বেঁচে থাকার জগৎ আবর্তিত জুতোকে ঘিরে। তার আবেগ ও ভালোবাসার কেন্দ্রে জুতো ছাড়া আর কিছু নেই। দিনরাতের সমস্ত ক্ষণ সে জুতোর সঙ্গেই কাটায়। এই অভিনব বিষয় নিয়েই সৌরিশের প্রথম ছবি ‘জুতো’। ৮০ মিনিট সময়সীমার এই নির্বাক ছবি দর্শকের মনন ও অনুভবের সূক্ষ তার ছুঁয়ে যায় সহজেই। কল্পনার শক্তিকে প্রশ্রয় দেয়। উস্কে দেয় চেতনার আগুনকে। প্রযোজনা সুরজিৎ চন্দ ও স্নিগ্ধা বিশ্বাস। মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন ভাস্কর দত্ত ও চলন্তিকা গঙ্গোপাধ্যায়। এছাড়াও আছেন কুণাল ভৌমিক, গৌতম বসাক, রিয়া পাল, ঋত্বিক রায়, তমোঘ্ন, অর্পণ ও রোহিত। সিনেমাটোগ্রাফার রাজীব সেনগুপ্ত। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক সাহেব চক্রবর্তী। সাউন্ড এফেক্টের ক্ষেত্রে পৃথকভাবে কৃতিত্বের দাবিদার গয়াধর নায়েক। আর্ট ডিরেক্টর সাগর দাশগুপ্ত, উজ্জ্বল দাস। কাহিনি, চিত্রনাট্য, সম্পাদনা, কালারিং পরিচালক স্বয়ং।
আগেই বলেছি, শুধু নির্মাণ নয়, ছবির প্রচার বা প্রদর্শনের ক্ষেত্রেও অভিনবত্বের ছাপ লক্ষ্য করা যায় আজকাল। আর এই নিরিখেও দারুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো ‘জুতো’। কলকাতা নিউ টাউনের নজরুল তীর্থে গত ২৫ নভেম্বর ছবিটির প্রিমিয়ার হয়, যেখানে ছিলেন ৫০ জন বিশেষ দর্শক, যাঁরা সকলেই শ্রবণে প্রতিবন্ধী। এঁরা প্রত্যেকেই দারুণভাবে উপভোগ করেন ছবিটি। নির্বাক ভাবের বিনিময় বাঙ্ময় হয়ে ওঠে অনুভবের পরশে। সিনেমা হলে তখন সবার অগোচরে লেখা হচ্ছে এক অপরূপ গাথাকাব্য। সৌরিশের ভাবনার শব্দহীন ব্যঞ্জনা পৌঁছে যায় শ্রবণে প্রতিবন্ধী মানুষগুলির মরমে। শব্দ ও শ্রুতি গৌণ হয়ে যায়।
‘জুতো’ প্রদর্শনের আর এক ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ ছিল ক্যাফে রিলিজ, যা সিনেমার শহর কলকাতায় এই প্রথম। স্বাধীন চিত্র পরিচালকদের ছবি মুক্তি ঘিরে টালবাহানার শেষ থাকে না। সিনেমার ডিস্ট্রিবিউশন চেন যাঁদের হাতে, বিষয়টা সেই রাঘব বোয়ালদের মনোপলি–এ তত্ব সকলেরই জানা। নতুন পরিচালকরা এ বাবদ প্রচুর প্রতিকূলতার মুখোমুখি হন। সৌরিশের ‘জুতো’ বলা যায় এক নতুন ধারার প্রবর্তন করলো এবার, ছবির ক্যাফে রিলিজের মাধ্যমে। এগিয়ে এসেছিলেন অভিনেতা ও পরিচালক তথাগত মুখার্জি এবং ক্যাফে ওহানা ফিল্ম ক্লাব কর্তৃপক্ষ। টলিউডের একদল নামী দামি মানুষের উপস্থিতিতে ‘জুতো’ প্রদর্শিত হলো হাউসফুল ক্যাফে ওহানার উষ্ণ অভ্যন্তরে। এই উষ্ণতা আন্তরিক ও একত্র পথ চলার। এই উষ্ণতা স্বপ্ন পূরণের।
উপস্থিত ছিলেন দেবলীনা দত্ত, বিক্রম চ্যাটার্জি, শ্রীলেখা মিত্র, মধুরিমা বসাক, পায়েল দে, লামা, দেবপ্রসাদ হালদার, সৌম্য মুখার্জি প্রমুখ। তথাগত যথার্থই বলেছেন, আজকের এত হইচই গোলমালের সময়ে দাঁড়িয়ে একটি নির্বাক চলচ্চিত্র নির্মাণে বুকের পাটা লাগে। সৌরিশ সেটা করে দেখালেন। আমরাও তথাগতর কথার রেশ ধরেই বলবো, প্রথম ছবিতেই নিজের স্বতন্ত্র ভাবনার প্রকাশ ঘটিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন সৌরিশ। তাঁর ছবি আরও মানুষের দরবারে পৌঁছে যাক, দর্শক নতুন ব্যঞ্জনায় অভিষিক্ত হোক। ধন্যবাদ তথাগত ও ক্যাফে ওহানা ফিল্ম ক্লাবকে। তাঁরাও দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন এ ছবির পাশে থেকে।