জ্বলন্ত সময়ের দলিল : প্রিয় চিনার পাতা, ইতি সেগুন…
সিনেমা ওঁদের প্যাশন। প্রতিভা, মেধা, দক্ষতা আর নতুন নতুন ভাবনার আলিঙ্গনে বিচিত্র পথগামী ওঁরা। কেউ পূর্ণদৈর্ঘের ছবি নির্মাণে ব্যস্ত, কেউ তথ্যচিত্র বা ছোট ছবি। কখনও স্বাধীনভাবে, কখনও সামান্য বিনিয়োগ―স্বপ্নের কারিগররা ব্যস্ত তাঁদের নিজের ভুবনে। এইসব সিনেমা পরিচালক ও তাঁদের কাজ নিয়েই এই বিভাগ। আজ কুমার চৌধুরী । আজ ধারাবাহিক রচনার তৃতীয় ও শেষ পর্ব। সাক্ষাৎকার অজন্তা সিনহা ।
আমরা আগের সপ্তাহে স্বল্প বাজেটের বা independent ছবি নিয়ে কথা বলছিলাম। বিভিন্ন উৎসবে এইসব ছবির প্রদর্শনের ক্ষেত্র আজ অনেকটাই প্রস্তুত। প্রশ্ন হলো, ছবি নির্বাচনের ক্ষেত্রে কতটা স্বচ্ছতা ও সঠিক বিচার এইসব উৎসবের আয়োজকদের পক্ষ থেকে পাওয়া যায় ?
◆ এক একটা উৎসব কমিটির এক এক রকম guideline, policy ও vision থাকে। সেই অনুযায়ী তারা ছবি select করেন। অনেক festival-এ theme থাকে। তাঁরা সেই অনুযায়ী ছবি নেন। যেমন কেউ যদি একটা realistic social drama film বানিয়ে সেটাকে একটা fantastic film festival-এ সাবমিট করেন, তাহলে তো হবে না। ছবিটা rejected হবে। বড় festival, ভাল festival-এ ছবি selection পেলে media-ও তখন সেই ছবির প্রচারে অংশ নেয়। তবে সব festival-ই যে দারুণ কিছু, তা একেবারেই নয়। আর এখন তো ব্যাঙের ছাতার মতো প্রচুর festival আয়োজক গজিয়েছে। অনেকগুলোই ভুলভাল। এসব festival-এ ছবি নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার আশা না করাই ভাল। আর বিগত কয়েক বছর ধরে কয়েকটি বড় festival-এও ছবি নির্বাচনের ক্ষেত্রে mainstream ছবিকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে (sponsorer-দের কাছে হাত পা বাঁধা )–সেটা খুবই ভাবনার বিষয়।
পেশাগত ভাবে যথেষ্ট ঝুঁকি নিতে হয় একজন Independent ছবির নির্মাতা- নির্দেশককে। এক্ষেত্রে সরকারি সহযোগিতা বা sponsor পাওয়ার সম্ভাবনা কতটা থাকে ?
◆ ভারতে ছবি তৈরির জন্য বোধহয় এখন আর সরকারী অনুদান পাওয়া যায় না। আর private sponsor ব্যক্তিগত যোগাযোগ বা সিনেমাটির জন্য যদি কোনও marketing strategy নেওয়া হয় এবং সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা করা হয়, তাহলে আসতে পারে। তবে বিষয়টা অত সরল নয়।
এতসব কঠিনতার বেড়া পার করে দিনের শেষে সৃজনশীলতার জায়গাটায় কতটা তৃপ্তি মেলে ?
◆ মাধ্যম আলাদা হলেও যে কোনও শিল্পই শিল্পীর কাছে সন্তানসম। তবে, সেই শিল্প সৃষ্টির মাধ্যমে যেটা বলতে চাইছিলাম–যে বিষয়টাকে ধরতে চাইছিলাম, সেটা ঠিকঠাক ধরতে পারলাম কিনা আমার কাছে সবচেয়ে জরুরি সেটাই। আর সবসময়ই মনে হয় আরও better ছবি করতে পারতাম। যেসব খামতিগুলো নিজের চোখে ধরা পড়ে, সেগুলোকে শুধরে নিয়ে পরের ছবিটা আরও ভাল করব ভেবে পরের ছবির চিত্রনাট্য তৈরি করতে বসি। এবং এই মুহূর্তেও এটা ভেবে সত্যিই তৃপ্তি পাচ্ছি যে, পরের ছবির চিত্রনাট্য তৈরি করে ফেলেছি।
তোমার ‘প্রিয় চিনার পাতা, ইতি সেগুন…’ ছবিটি ইতিমধ্যেই আলোচিত। ছবিটি সম্পর্কে জানাও।
◆ এ ছবি এক জ্বলন্ত সময়ের দলিল। কলকাতায় এক অনাথ আশ্রমের ঘরে বসে মেয়েটি চিঠি লেখে দেশে থেকে যাওয়া নানিকে। ছেলেটি খুঁজতে থাকে মেয়েটির হারিয়ে যাওয়া পরিবার, বাবা-মাকে। মেয়েটি রোহিঙ্গা। মায়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে ঢুকতে গিয়ে বর্ডারে ধরা পড়ে এখন হোমে। ছেলেটি কাশ্মীরি, ভারতের সবচেয়ে বিতর্ক জায়গা থেকে আগত। এ গল্প দুটো আলাদা দেশের, দুটো আলাদা মানুষের। এ আখ্যান দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া সময়ের। নিবেদনে আর্ক ফিল্মস। প্রযোজক পিয়ালি চৌধুরি। বিশেষ সহায়তায় বিশ্বজিত ঘোষ। পরিচালনা ছাড়াও ‘প্রিয় চিনার পাতা, ইতি সেগুন…’-এর কাহিনি, চিত্রনাট্য, সংলাপ আমারই লেখা। চিত্রগ্রহণ করেছেন প্রসেনজিত কোলে। সম্পাদনায় আছেন প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য। সুজয় দাস শব্দ সংযোজনা। সংগীত পরিচালনা করেছেন মেঘ ব্যানার্জি। কালারিস্ট আমীর। গ্রাফিক্স অরিত্র দত্ত বণিক। অভিনয়ে পিয়ালি সামন্ত, ক্যাপ্টেন আরমান শাহ, ইকবাল সুলতান, রঞ্জিনী চট্টোপাধ্যায়, নীলাঞ্জনা বিশ্বাস, রণজয় ভট্টাচার্য, অভিজিত মুখোপাধ্যায় ও রাশি দত্ত। এখনও পর্যন্ত এ ছবি উনিশটি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অফিসিয়াল সিলেকশন পেয়েছে এবং সাতটি পুরস্কার পেয়েছে।
‘প্রিয় চিনার পাতা, ইতি সেগুন…’ যতদূর বুঝতে পারছি, সম্পূর্ণ স্বাধীন প্রযোজনা।
◆ একেবারেই তাই। আমার এই ছবির জন্য কোনও প্রযোজক অনেক চেষ্টা করেও পাইনি। আমার স্ত্রী পিয়ালি ব্যক্তিগত লোন নিয়ে, গয়না বিক্রি করে ছবিটা শুরু করে। তারপর আমার বন্ধু বিশ্বজিত ঘোষ এবং আরও কয়েকজন ছবিটার শুটিং শেষ করতে আমাদের সাহায্য করেন। আজ ছবিটা কলকাতা, দিল্লী, রাজস্থান, পুনে, লন্ডন, বার্লিন, ওয়াশিংটন ডিসি, মন্ট্রিল, সানফ্রান্সিস্কো, বস্টন, কাঠমাণ্ডু, ঢাকা ইত্যাদি রাজ্য ও শহরের বিভিন্ন Festival-এ Competitive section-এ Officially selected হয়েছে। এখনও অবধি সাতটি পুরস্কার পেয়েছে। এর কোনও কিছুই হতো না যদি পিয়ালি সাহস করে ছবিটার শুটিং শুরু করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে না নিত।
কোন কোন festival-এ এ ছবি প্রদর্শন বা প্রতিযোগিতার জন্য নির্বাচিত হয়েছে ?
◆ ছাব্বিশতম কলকাতা ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ছবিটি এশিয়ান সিলেক্ট নেটপ্যাক অ্যাওয়ার্ড বিভাগে প্রতিযোগিতা করেছে। এছাড়াও, ইন্ডো জার্মান ফিল্ম উইক বার্লিনে, ইউকে এশিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল লন্ডনে, ক্যালাইডোস্কোপ ইন্ডিয়ান ফিল্ম ফেস্টভ্যাল বস্টনে, সাউথ এশিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল মন্ট্রিলে, নিউ জার্সি ইন্ডিয়ান ও ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল নিউ জার্সিতে, ডি সি সাউথ এশিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ওয়াশিংটন ডিসিতে, নেপাল কালচারাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল কাঠমান্ডুতে, পেম ফেস্টিভ্যাল পোখরাতে, রাজস্থান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল জয়পুর ও যোধপুরে, ডায়োরামা ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল দিল্লীতে, সিনেম্যাকিং ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ঢাকাতে, সিক্যুইফ ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল সানফ্রান্সিসকোতে ও আরও কয়েকটি ফেস্টিভ্যালে অফিসিয়ালি সিলেক্টেড হয়েছে।
আর পুরস্কার ?
◆ সিক্যুইফ ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে বেস্ট পিকচার (ক্রিটিকস্ চয়েস)-এর পুরস্কার পেয়েছে ‘প্রিয় চিনার পাতা, ইতি সেগুন…’। আর রাজস্থান ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পেয়েছে বেস্ট ডেবিউ ফিল্মমেকার (ক্রিটিকস্ চয়েস)। নেপাল কালচারাল ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে বেস্ট ইন্টারন্যাশনাল রেকগনেশন ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে এই ছবি। ড্রুক ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ও টেগোর ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টভ্যালেও বেস্ট ডেবিউ ফিল্মমেকারের অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি। এছাড়াও ডিসিস্যাফে স্পেশাল জুরি মেনশান বেস্ট ফিচার ফিল্ম পুরস্কার পেয়েছে আমার ছবি।