তাঁর কাজের সম্পূর্ণ মূল্যায়ন করতে এখনও বহু দূর যেতে হবে আমাদের
জীবনমরণের সীমানা ছাড়িয়ে ওঁরা আজ বহু আলোকবর্ষ দূরের এক জগতে। তবু আছেন ওঁরা আমাদের মাঝে। থাকবেন চিরদিন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সিনেমা জগতের সেইসব মানুষ, যাঁদের অবদান ছাড়া অসম্পূর্ণ আমরা, তাঁদের নিয়েই এই বিশেষ কলম। আজ কিংবদন্তি অভিনেতা অজিতেশ বন্দোপাধ্যায়কে নিয়ে লিখেছেন দেবজিৎ সাহা।
“উ বুড়ার কথা বাদ দেন, ডাক্তারবাবু। উ ঠিক করেছে, আমাকে দিয়ে কাজ করাবেকই। আর আমিও ঠিক করেছি শালা কাজ করিবক নাই। ঘরে যখন এতগুলান পয়সা আছে, তখন লতুন করে আর পয়সা করার দরকার কী, আপনিই বলুন। আমি বাবা দুনিয়া ভোগ কইরতে এসেছি। যদ্দিন বাঁইচব, ভোগ করি যাব, বুঝলেন। উ ত্যাগ-ট্যাগ আপনার সাধু-সন্নিসিরা করুক। সবাই যদি দুনিয়ায় সাধু-সন্নিসি হবেক, তবে দুনিয়াটা বাঁইচবেক কী করে, বলুন তো! একি, আপনি হুইস্কি খেইলেন না যে বড়!”
সংলাপটি মনে পড়ে? পশ্চিমের এক ছোট্ট পাহাড়ী গঞ্জের স্থানীয় জমিদার ছবিলালের ছেলে লছমনলাল এই কথাগুলো বলছে গঞ্জের মানুষ যাঁকে ভগবান মানে, সেই ডাক্তার অনাদি মুখার্জিকে। ডাক্তারবাবু মদ খান না শুনে, তার ব্যঙ্গোক্তি ঠিকরে আসে, ‘সবাই শালা সতী রে’! তারপরেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ার পালিশ করা মাস্তানি। জ্বলন্ত চোখ, সঙ্গে এমন চেবানো ডায়লগ থ্রোয়িংয়ের কাল্ট চরিত্রায়ন!
১৯৬৬ সালে তপন সিংহ মনস্থির করলেন বনফুলের ছোটগল্প অবলম্বনে ডাক্তার অনাদি মুখার্জির কাহিনি নিয়ে একটি ছবি করবেন। গল্পের ভিলেন জোতদার ছবিলালের ছেলে লছমনলাল। একে অমন দোর্দণ্ডপ্রতাপ খল চরিত্র, তার উপর অশোককুমার-বৈজয়ন্তীমালার মতো তারকার পাশাপাশি দাপিয়ে অভিনয়, সে কি চাট্টিখানি কথা? কোথায় পাবেন এমন অভিনেতা? হঠাৎ করেই পরিচালকের মনে পড়ে গেল সাড়ে ছ’ফুট লম্বা, রোগাটে গড়ন আর মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুলের মানুষটার কথা। গল্প শুনে তো এককথায় রাজি সাউথ পয়েন্ট স্কুলের ইংরেজির মাস্টারমশাই। কিন্তু শুটিংয়ের চাপে দীর্ঘদিন স্কুল আসতে পারবেন না যে ! এদিকে ঠিকঠাক ক্লাস না পেলে, পাছে ছাত্রদের পড়ার ক্ষতি হয়–সেই আশঙ্কায় সোজা গিয়ে ইস্তফা দিয়ে বসলেন স্কুলের চাকরিতে। তারপর বাকিটা ইতিহাস। ‘হাটে বাজারে’র লছমনলালের ভূমিকায় কাঁপিয়ে দেওয়া সেই অভিনয়-অন্ত প্রাণ মানুষটির নাম অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। জন্ম ১৯৩৩-এর ৩০শে সেপ্টেম্বর। মৃত্যু ১৩ই অক্টোবর, ১৯৮৩।
একটি সাদা পাঞ্জাবি, নৌকার মতো একটি চটি পরে দিল্লিতে অ্যাকাডেমি পুরস্কার নিতে উঠছেন একজন ছিপছিপে রোগাটে, দীর্ঘদেহী, মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুলের মানুষ। তাঁকে পুরস্কার নিতে উঠতে দেখে অনেকেই ভ্রূ কুঁচকেছিলেন। অনেকেরই মনে হয়েছিল চলতি হাওয়ার কাছে তিনি একেবারেই বেমানান। আসলে তিনি সব ধরনের আড়ম্বর থেকে বহুদূরবাসী, নিজের সৃষ্টির মধ্যে ডুবে থাকা একজন সৃষ্টিশীল ব্যক্তিত্ব। কর্মে নিষ্ঠাবান, ভিতরে ভিতরে প্রবল ভাবপ্রবণ এবং শিশুর মতোই আবেগ-সর্বস্ব একজন মানুষ। আবার এরই পাশাপাশি অজিতেশের জেদ এবং নিয়ামানুবর্তিতার কথাও লোকের মুখে মুখে ফেরে তখন। জীবনে সিগারেট ছিল তাঁর সব সময়ের সঙ্গী আর চেতনা ছিল মার্কসীয় তত্ত্বে জারিত।
বাংলা মঞ্চে উৎপল-শম্ভু পরবর্তী যুগে আধুনিকতার নতুন ভগীরথ অজিতেশ ৷ অভিনয় শিল্পের প্রতিটি মাধ্যমেই কাজ করেছেন তিনি। মঞ্চ-নাটকে তিনি অবিসংবাদিত ছিলেনই। পাশাপাশি বাংলা চলচ্চিত্র এবং যাত্রাশিল্পও সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁর অভিনয়ে। প্রসঙ্গত, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় নামে বাংলা নাট্য তথা অভিনয় জগতে পরিচিত হলেও তাঁর প্রকৃত নাম অজিত। তৎকালীন মানভূম, বর্তমান পুরুলিয়া জেলার জয়পুর ব্লকের রোপো গ্রামে মামার বাড়িতে অজিতেশের জন্ম।
তাঁর বাবার বাড়ি ছিল অধুনা পশ্চিম বর্ধমান জেলার রানিগঞ্জ অঞ্চলের অন্তর্গত কেন্দা গ্রামে। বাবার নাম ভুবনমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মায়ের নাম লক্ষীরাণী। গরিব পরিবার–বাবা ভূবনমোহন ছিলেন কয়লা খনির শ্রমিক। তাঁর ছেলে যে বড় হয়ে বাংলা থিয়েটারে আলোড়ন ফেলে দেবে, তা কে জানত! পাঁচ বছর বয়সে পুরুলিয়ার মধুবন স্কুলে ভর্তি হলেও, পরে ঝালদার সত্যভামা হাইস্কুলে পড়াশোনা করেন। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সেখানে পড়াশোনা করে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হলেন কুলটি উচ্চ বিদ্যালয়ে। এর পরে আসানসোল কলেজে (বর্তমানের বিবি কলেজ) ভর্তি হলেন। পরে সুযোগ পেয়ে চলে যান কলকাতার মণীন্দ্র কলেজে। সেখান থেকে ইংরেজিতে স্নাতক। বেশ কিছুদিন শিক্ষকতা করেছেন দমদমের মতিলাল বিদ্যায়তনে এবং পরে বাগুইহাটির হিন্দুবিদ্যাপীঠে।
ছাত্রজীবন থেকে অজিতেশ নাটক রচনা ও অভিনয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। থিয়েটারের সঙ্গে যেন একটা অদ্ভুত আত্মীয়তা ছিল তাঁর। তাই আসানসোলের ছোটঘরের চৌকিকে মঞ্চ বানিয়ে বন্ধু, ভাই-বোনেদের সঙ্গে নাটকের মহড়া দিতেন। ১৯৪৭ সালে মে মাসে শিক্ষক ধীরেন ঘটক অজিতেশকে দিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘খ্যাতির বিড়ম্বনা’-য় ন’কড়ি চরিত্রে অভিনয় করান। এ ছাড়া শিক্ষক আদিত্য মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় ‘রামের সুমতি’ নাটকেও অভিনয় করেন তিনি। আসানসোল কলেজে পড়ার সময়ে তিনি কলেজের সংস্কৃতি বিভাগের সম্পাদক হন। এখানেই তাঁর সংস্কৃতি চেতনা ও অভিনয় ক্ষমতার প্রথম প্রকাশ ঘটে।
কলকাতার কলেজে পড়ার সময় থেকে অজিতেশ জড়িয়ে পড়েন পাতিপুকুর শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে। মূলত কংগ্রেস মনোভাবাপন্ন পরিবারের সদস্য হয়েও তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। এখান থেকেই তাঁর নাটকের সঙ্গে রাজনৈতিক চেতনার সম্মিলন ঘটে। যদিও তিনি কোনও দিনই সে ভাবে মিটিং, মিছিলে অংশ নিয়ে পার্টির আদর্শ প্রচার করেননি। তবে মনে প্রাণে তিনি ছিলেন আদ্যন্ত এক কমিউনিস্ট।
তরুণ বয়সে উপার্জন বলতে কিছু টিউশনি আর গল্প লিখে একটি পত্রিকা থেকে কিছু রোজগার। সেই প্রবল অর্থকষ্টের মধ্যেও অজিতেশের অভিনয়ের খিদে ছিল আকণ্ঠ। ১৯৫৪ সালে লিখেছেন মৌলিক পূর্ণাঙ্গ নাটক ‘সংঘাত । ১৯৫৭ সালে ২৩ বছরের তরুণ অজিতেশ যােগ দিলেন ভারতীয় গণনাট্য সংঘে। তার ঠিক চার বছর পর ১৯৬০ সালের ২৯ জুন প্রতিষ্ঠা পেল নতুন নাটকের দল ‘নান্দীকার’। এই নাট্যদলের ৩৪টি নাটকে রূপান্তর, নির্দেশনা এবং অভিনয়সূত্রে যুক্ত ছিলেন অজিতেশ বন্দোপাধ্যায়।
এই নাটকের মধ্যে ডুবে থাকা অনেকের মতে তাঁর নিবিষ্ট সংস্কৃতি চেতনারই প্রতিফলন। তবে খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায়, অজিতেশ রাজনীতি আর সংস্কৃতিকে কোনও দিনই একাসনে বসাতে পারেননি। বা ইচ্ছা করেই এই দুয়ের মধ্যে সচেতন একটি দূরত্ব রেখে চলতে চেয়েছিলেন। তিনি থিয়েটারে রাজনৈতিক উপাদান প্রয়োগ করেছেন খুবই সচেতনভাবে। উচ্চকিত রাজনৈতিক শ্লোগান দিয়ে তাই অজিতেশের নাটকের পরিসমাপ্তি ঘটে না। বরং তাঁর নাটক এক স্থিরতর রাজনৈতিক এবং মানবিক মূল্যবোধের সামনে দর্শককে দাঁড় করায়। এই কারণেই গণনাট্য সম্পর্কে অজিতেশ অনুৎসাহিত হয়েছিলেন। গণনাট্যের প্রতিটি ধ্যান-ধারণাকে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা তাঁর মতো সৃষ্টিশীল মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল না। আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা থাকা সত্ত্বেও সব বিষয়ে সহমত হতে না পারার জেরে, অনেকে পরের দিকে তাঁকে ‘দক্ষিণপন্থী’ ধ্যান-ধারণার মানুষ বলে ভাবতে শুরু করেছিলেন।
এর জেরে এমন এক অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হয় যে অজিতেশকে বাধ্য হয়ে দল ছেড়ে চলে যেতে হয়। ‘বহুরূপী’ পত্রিকায় ‘ব্রেখটের সঙ্গে পরিচয়ের আদিপর্ব’ প্রবন্ধে তিনি বলেন, আমি লক্ষ্য করেছি, যাঁরা পার্টির সদস্যপদ নেন, তাঁরা পার্টির সুবিধাগুলো ভোগ করেন, কষ্টগুলো নয়। এর থেকে বোঝা যায়, কিছুটা আক্ষেপ তাঁর মধ্যে কাজ করছিল। অজিতেশ মনে করতেন, পার্টিকে ভালবাসলে তার সমালোচনা করতে হবে। প্রয়োজনে নির্ভীক হয়ে সমালোচনা করতে হবে। কিন্তু সমালোচনা করলেই একাংশের কাছে সুবিধাবাদী, বুর্জোয়া ইত্যাদি অভিধা পেতে হয়। পার্টির শৃঙ্খল ছেড়ে অজিতেশ স্বতন্ত্রভাবে নাট্যচর্চা করলেও, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পার্টিকে অন্তর থেকে ভালবেসেছিলেন।
শম্ভু মিত্রের মতোই অজিতেশেরও বিশ্বাস ছিল, বিশ্বের সব জ্ঞান ও শিক্ষণীয় বিষয়ের মেলবন্ধনেই সৃষ্টি হয় থিয়েটার নামক মহৎ শিল্প। তাই তিনি এক দিকে যেমন বিভিন্ন বিদেশি নাটকের অনুবাদ করেছেন, অন্য দিকে, ঠিক তেমনই সেই অনুবাদের মধ্যে নিয়ে এসেছেন বাংলার মাটির গন্ধ। তাই চেকভের ‘দ্য সওয়ান সং’ অবলম্বনে ‘নানা রঙের দিন’ নাটককে তিনি উপস্থাপিত করেন ভারতীয় প্রেক্ষিতে। চেকভের তৈরি ‘চেরি অর্চার্ড’ অবলম্বনে অজিতেশ যখন লিখলেন ‘মঞ্জরী আমের মঞ্জরী’, তখন সেখানে যে মধ্যবিত্ত সমাজের কথা শোনা যায়, তাঁরা কেউই রাশিয়ান নন, বরং ভারতীয় জীবন থেকে তুলে আনা জীবন্ত চরিত্র। এই নাটকে ঝাড়খণ্ডী উপভাষাকে ব্যবহার করে বাঙালি সামন্ততান্ত্রিক জীবনব্যবস্থাকে তুলে ধরতে চাওয়া হয়েছে। ১৯৭০-এ ব্রেখট-এর ‘থ্রি পেনি অপেরা’ অবলম্বনে তিনি যখন ‘তিন পয়সার পালা’ রচনা করলেন তখন বিদেশি কাহিনিতে উঠে এলো আমাদের সমাজের অতীতের বাবু কালচার। ‘সওদাগরের নৌকা’-তে প্রসন্নরূপী অজিতেশ তিন দেওয়ালের একটা ঘর তৈরি করতে চেয়েছিলেন।
এভাবেই কাজ এগিয়ে চলছিল। কিন্তু অনেক কাজ বাকি থাকা সত্ত্বেও, মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে তাঁকে চলে যেতে হয়। আজও বাংলা নাটকের অন্যতম স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সেই প্রয়াত মানুষটি, যাঁর নাম অজিতেশ। চলচ্চিত্রেও তিনি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন, বিশেষত খলনায়ক চরিত্রগুলিতে। বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে মোট ৬৩টি ছবিতে অভিনয় করেছেন অজিতেশ। আবার বেতারেও তুমুল জনপ্রিয় হয়েছে তাঁর তামাকু সেবনের অপকারিতা। বাংলা নাটক, যাত্রা ও সিনেমায় তিনি যে অবদান রেখে গিয়েছেন, তার সম্পূর্ণ মূল্যায়ন করতে এখনও বহু দূর যেতে হবে আমাদের।