দর্শককে প্রস্তুত করার দায়িত্ব আমাদেরই
সিনেমা ওঁদের প্যাশন। প্রতিভা, মেধা, দক্ষতা আর নতুন নতুন ভাবনার আলিঙ্গনে বিচিত্র পথগামী ওঁরা। কেউ পূর্ণদৈর্ঘের ছবি নির্মাণে ব্যস্ত, কেউ তথ্যচিত্র বা ছোট ছবি। কখনও স্বাধীনভাবে, কখনও সামান্য বিনিয়োগ―স্বপ্নের কারিগররা ব্যস্ত তাঁদের নিজের ভুবনে। এইসব সিনেমা পরিচালক ও তাঁদের কাজ নিয়েই এই বিভাগ। পরিচালক রাজাদিত্য বন্দোপাধ্যায়ের মুখোমুখি অজন্তা সিনহা। ধারাবাহিক আলাপচারিতার তৃতীয় পর্ব আজ।
## একের পর এক ভাবনা ও গবেষনালব্ধ তথ্যচিত্র নির্মাণের কাজ তো চলছে। এটা সত্যিই এক অত্যন্ত শুভ লক্ষণ ! কিন্তু এদেশের দর্শক কতটা প্রস্তুত তথ্যচিত্র দেখার ক্ষেত্রে ?
দর্শক কতটা প্রস্তুত তথ্যচিত্র দেখতে, তার থেকে বোধহয় বড় প্রশ্ন আমরা কতটা প্রস্তুত করতে পেরেছি দর্শককে। আমরা যদি অর্থহীন, ভাবনাবিহীন ওয়েবসিরিজ, মশালা ছবি, কনটেন্ট নেই এমন বোধহীন ছবি বানিয়ে দর্শকের সামনে দিই, তাহলে তাদেরও ভালো ছবি দেখার খিদেটা নষ্ট হয়ে যাবে। এই তো, এই রাজ্যেই একদা সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, তপন সিংহ, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের মতো পরিচালকরা কাজ করে গেছেন। এই সমস্ত পরিচালকরাও গল্প বলেছেন। হলে দর্শকদের টানতে পেরেছেন। জীবনের অন্য দিকগুলো দেখিয়েছেন। মানুষ তো সেসব ছবি দেখেছেন !
## এক্ষেত্রে তাহলে করণীয় কী?
আমাদের ফিল্ম মেকারদের বিশাল দায়িত্ব সস্তা কালচার প্রমোশন না করে, জেনুইন কনটেন্ট নিয়ে আসা। এটা তথ্যচিত্র বা ফিচার ছবি যে ক্ষেত্রেই হোক। কমার্শিয়াল ছবিকে ছোট না করেই বলছি, অন্য ধরনের সিনেমা বানাতে হবে। যে সিনেমায় মানুষ ভাষাটা দেখবে না, সিনেমাটা দেখলে মানুষ ভাবতে বাধ্য হবে। অর্থাৎ তিনিই আসল পরিচালক, যিনি দর্শককে ভাবাতে সক্ষম। যদি ভালো তথ্যচিত্র নির্মাণ করতে পারি, দর্শক নিশ্চয়ই দেখবেন। দেখছেনও তো ! আমার মনে হয়, মানুষ এভাবে বিভাজন করেন না। ওটিটি প্ল্যাটফর্মেও তো মানুষ তথ্যচিত্র দেখছেন। আমি তো সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক সময় রিভিউও দেখি। তার মানে মানুষ ভালো সিনেমা দেখতে চান। ভালো গল্প ও মেকিং যদি থাকে, আমরা যদি ওঁদের কানেক্ট করতে পারি, তাঁরা যদি নিজেদের জীবনের সঙ্গে বিষয়কে রিলেট করতে পারেন, তবে তথ্যচিত্রও দেখবেন ওঁরা।
## ফিল্ম মেকাররা নিজেরা কতটা প্রস্তুত এই প্রেক্ষিতে ?
সমস্যা হলো কিছু মানুষ এই পেশায় এসে যান, যাঁদের সিনেমা নিয়ে কোনও লেখাপড়া নেই। সিনেমা বানাতে গেলে যে গবেষণা করতে হয়, তার জন্যে অনেক সময় দিয়ে ছবি নির্মাণ করতে হয়, সেই প্রসেসের মধ্যে দিয়ে তাঁরা যেতে চান না। গেট রিচ কুইক স্কিমের মতো তাঁরা সিনেমাকে খ্যাতির স্প্রিংবোর্ড হিসেবে দেখেন। আমাদের দেশে বিকল্প মিডিয়ার অনুপস্থিতির ফলে স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাণের খবর সেইভাবে মানুষের কাছে পৌঁছয় না। রাজনীতি তো আছেই, সঙ্গে দলবাজি, যার ফলে প্রধান প্ল্যাটফর্মগুলি অধিকাংশ সময় কালচার মাফিয়াদের কাজ তুলে ধরে। বিকল্প পরিবেশনা যতদিন না তৈরি হবে ভারতবর্ষে, ততদিন এই সমস্যা থেকে যাবে। তবে, আশার কথা, যাঁরা সত্যিই ভালো সিনেমা দেখতে চান, তাঁরা ঠিক খোঁজ পেয়ে যান, কোথায় কীভাবে স্বাধীন ভালো কাজ দেখা যাবে।
## এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গ। জানবো তোমার কবিতার বই ‘আমি বাড়ি ফিরিনি‘র বিষয়ে। পরে আবার আমরা সিনেমার কথায় যাব।
বিপন্ন ক্ষতবিক্ষত সময়ে জনহীন হল্ট স্টেশনের কুয়াশা ভেদ করে যে ট্রেন ছুটে চলে, তার সামনে কে…কী…! কে তার খবর রাখে ? আর কাফকায়েস্ক (Kafkaesque) পৃথিবীর অন্ধকার, যেখানে অজান্তেই অপেক্ষা করে শ্যাওলা ধরা সর্বনাশা পুকুরঘাট, ঘন মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়া চাঁদ–সবই যেন সেই না জানা অশনি সঙ্কেত। অপ্রস্তুত মানুষকে বিপর্যস্ত করে দিয়ে যায়। তাদের মনে তখন একটাই প্রশ্ন, কখন সে বাড়ি ফিরবে ? বাড়ি ফেরা আর না ফেরার দূরত্ব ঠিক কতটা ? ‘আমি বাড়ি ফিরিনি’ এই অনুষঙ্গেই লেখা।
## তোমার বাবা দেবাশিস বন্দোপাধ্যায়ের সাহিত্যচর্চার বিষয়ে সকলেই জানেন। ওঁরই ভাবনা ও সম্পাদনায় একটা দীর্ঘ সময় ধরে শিশু–কিশোর মহলে খুবই জনপ্রিয় হয় ‘আনন্দমেলা‘ ম্যাগাজিন। সেই পরম্পরা মেনেই কী তোমারও এই দিকটায় আসা ?
সে তো বটেই। লেখালেখি শুরু কবে, কীভাবে, আজ আর মনে পড়ে না। আমার মা মনীষা বন্দোপাধ্যায়ও ভীষন ভালো কবিতা লেখেন। নিজেকে আড়ালেই রাখতে ভালোবাসেন বলে, মানুষ এই তথ্য সম্পর্কে অনবহিত। সাহিত্যচর্চা আমার পারিবারিক পরিবেশেই ছিল। তবে, এই বইয়ের ভাবনা শুধু এই পরম্পরার কারণে নয়। আমার বোধে, যেভাবে বিষয়টা আসে, তা কবিতার সিনেমা হয়ে ওঠা বা কবিতার মতো সিনেমা। অর্থাৎ, যেভাবেই দেখি না কেন, সবটাই ওই ঘুরপাক খাচ্ছে জীবন নামের ছবি ও কবিতাকে ঘিরে। সাম্প্রতিক করোনা-কালীন সময়ে যে পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা হঠাৎ করেই সংবাদ মাধ্যমের চর্চার বিষয় হয়ে ওঠে, সে তো আসলে দেশ-কালের সীমা বহির্ভূত এক বিষয়। ঠিক কবে থেকে ঠিকানার খোঁজে হাঁটছে বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষ–আমরা ঠিকানাওয়ালা মানুষরা তার খবর রাখি না। জীবন এভাবেই সিনেমা ও কবিতা দুইই হয়ে ওঠে এক সৃজনশীল মানুষের ভাবাবেগ, সৃষ্টির বিষাদ ও উল্লাসে।
## বইটি সম্পর্কে আরও কিছু যদি জানাও !
এই বইয়ের বিভিন্ন কবিতা তুলে ধরে প্রেম-অপ্রেম, নগরসভ্যতার যান্ত্রিকতা, বিশ্বায়ন ও এই অস্থির সময়ে আমাদের অস্তিত্ব সংকট। অনেক কথাই বলে ! অথচ কবিতাগুলি নিশ্চিত করে না কিছুই। অনেকে বলেন আন্দ্রেই তারকোভস্কির সিনেমার ফ্রেমের মত ঋজু ভাষায় লেখা নস্টালজিয়া, বাস্তব ও অবাস্তবতার মিশেল ‘আমি বাড়ি ফিরিনি’। ৬৪ পাতার এই বইয়ের প্রকাশক ধানসিঁড়ি। প্রসঙ্গত, আমার বাবা আমার কবিতার বিরাট ভক্ত ছিলেন। প্রখ্যাত কবি, আমার ও বাবা-মায়ের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারমশাই প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, তাঁর সম্পাদিত ‘অলিন্দ’ কাগজে আমার কবিতা ছাপতে চেয়েছিলেন। ছোট ছিলাম বলে রাজি হইনি।
২০১১ সাল নাগাদ আমার একটি নাটক ‘আমি বাড়ি ফিরিনি’ খুব জনপ্রিয় হয় ইউরোপের মঞ্চে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও সে নাটকটি নিয়ে কিছু কাজ করেছি। সেই নাটকটি অবলম্বনে আমি বেশ কয়েকটি কবিতা লিখেছিলাম, যার অধিকাংশ হারিয়ে গেছে। ফিনল্যান্ডে বাড়ি বদল করতে নোটবুক কোথায় যে পালিয়ে গেল, আজ খুঁজে পেলাম না। চারশোর ওপর কবিতা হারিয়ে কয়েকটি রিকভার করে ভাবলাম, দুই মলাটের মধ্যে এদের আশ্রয় হলে অন্তত হারিয়ে যাবে না। তবে, হারিয়ে যাওয়া কবিতাদের আমি ঈর্ষা করি। হারিয়ে যাবার সৌভাগ্য কি সকলের হয় ? (চলবে)