Monday, February 3, 2025
দর্পণে জীবনপ্রাণের মানুষ

দুলালবাবু, আপনাকে…

চলার পথে এমন কিছু মানুষের দেখা আমরা সকলেই পাই, যাঁদের কখনও ভুলতে পারি না, ভোলা যায় না, তাঁদের নিয়েই এই সিরিজ। লিখছেন অজন্তা সিনহা

বছর চারেক আগের কথা। কলকাতায় যাব। রিজার্ভেশন হয়েছে পদাতিক এক্সপ্রেসে। সেইমতো সময়ে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে পৌঁছেছি। পৌঁছে একজন কুলি খুঁজছি নির্ধারিত প্ল্যাটফর্মে মালপত্র নেওয়ার জন্য। ব্যস্ত স্টেশন। সকলেই দৌড়চ্ছে। তারই মধ্যে একজন কুলি এসে হঠাৎ বলে, কোন ট্রেন, দার্জিলিং মেল ? প্ল্যাটফর্মে তো কখন থেকে ট্রেন দাঁড়িয়ে। চলুন চলুন। ছাড়ার সময়ও তো হয়ে গেল! বলে সে ব্যাগপত্র হাতে নিয়ে দৌড়োয়। পিছন পিছন সম্মোহিতের মতো আমি, এটা বেমালুম ভুলে যে আমার টিকিট দার্জিলিং মেল নয় পদাতিক এক্সপ্রেসে।

ট্রেনে আমার ব্যাগপত্র সেট করে পয়সা নিযে চলে যায় কুলি। ঠিক তখনই আমার ফোনটা বাজে। আমার এক ভাইয়ের আমাকে ট্রেনে তুলে দিতে আসার কথা ছিল। অফিসে আটকে যাওয়ায় আমি একাই চলে আসি। সে জানায়, এবার ফ্রি হয়ে বেরিয়েছে অফিস থেকে, আসছে স্টেশনে। আমি বললাম, আমি তো ট্রেনে উঠে পড়েছি। তুই আর এসে কী করবি ? সে প্রবল অবাক হয়ে বলে, উঠে পড়েছ মানে ? তোমার তো ন’টায় ট্রেন। তার কথা শুনেই আমার টনক নড়ে ওঠে। যখন ভুলটা বুঝি, ততক্ষণে দার্জিলিং মেল এনজেপি স্টেশন ছেড়ে অনেকটা চলে এসেছে এবং স্পিডও নিয়েছে।

আমার হাতে টিকিটের প্রিন্ট আউট আর কিংকর্তব্যবিমূঢ় দশা দেখে উল্টোদিকের সিটে বসা ছেলেটি প্রথম প্রশ্ন করে। ঢোক গিলে কি কান্ড ঘটিয়েছি, সেটা বলি। শুনে সে আশ্বাস দিয়ে জানায়, কিষেনগঞ্জ স্টেশনে ট্রেন দাঁড়াবে কিছুক্ষণ। আপনি নেমে পদাতিক ধরে নিতে পারবেন। এখানে একটা কথা বলার, আমার নির্দিষ্ট নম্বরের সিটটা খালি না থাকলে এনজেপি স্টেশনে ট্রেন ছাড়ার আগেই ভুলটা ধরা পড়ে যেত। কিন্তু ভোগান্তি ভবিতব্য যে ! ঘন্টাখানেক রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষার পর ট্রেন ঢুকলো কিষেনগঞ্জে। সামনের সিটের ছেলেটি দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল আমার ব্যাগ। ট্রেন থামলে দরজার কাছে দাঁড়ানো আর একটি ছেলে সাহায্য করলো, দরজা খুলে ও ট্রেন থেকে ব্যাগ নামিয়ে দিয়ে। দুজনকেই সকৃতজ্ঞ ধন্যবাদ জানালাম।

নামার পর অবস্থাটা যা দাঁড়ালো, তা বলে বোঝাবার নয়। জায়গাটা স্টেশনের শেড থেকে অনেকটা দূর এবং একেবারে জনমানবশূন্য। কুলিরও দেখা নেই। ভারি দু’দুটো ব্যাগ নিয়ে কীভাবে শেডের নিচ পর্যন্ত যাব ভাবছি। ঠিক তখনই প্রায় দেবদুতের মতো হাজির হলেন একজন প্রবীণ চা বিক্রেতা। দেখেই চিনতে পারলাম, ট্রেনে একটু আগেই চা খেয়েছি ওঁর কাছ থেকে। নির্জন প্ল্যাটফর্মে মানুষটি তখন কুঁজো হয়ে আমার পাশ দিয়ে ওঁর চা-এর সরঞ্জাম নিয়ে যাচ্ছেন। আমার কাতর ডাকে ফিরে দাঁড়ালেন। বললাম, “দাদা আপনি ওদিকে যাচ্ছেন, আমার জন্য একটা কুলি পাঠাবেন দয়া করে ?”

আমার প্রশ্ন শুনে উনি একটু কাছে এগিয়ে এসে বললেন,”কুলি তো পাবেন না এখন এখানে। দাঁড়ান আমিই আপনার ব্যাগদুটো পৌঁছে দিচ্ছি।” বলতে বলতে আর একজন চা বিক্রেতা এসে দাঁড়ায়। তাঁর কাছে নিজের চা বিক্রির সরঞ্জামাদি রেখে, আমি কিছু বলার আগেই আমার ব্যাগ নিয়ে হাঁটা লাগান মানুষটি। আমি অবাক হতেও ভুলে যাই। প্রায় দৌড় প্রতিযোগিতায় শামিল হওয়ার মতো গতিতে তাল মেলাই প্রবীণ মানুষটির দ্রুত চলার সঙ্গে। হাঁফাতে হাঁফাতে প্ল্যাটফর্মের লোহার চেয়ারে বসি। পৌঁছেই সবার আগে জেনে নিই ওঁর নাম–দুলালবাবু–শুনলাম তিনি শিলিগুড়িতেই থাকেন।

ব্যাগপত্র পাশে রেখে হাত দিয়ে মুখের ঘাম মোছেন দুলালবাবু। আমি পয়সার ব্যাগ খুলেছি, টাকা দেব। তখনও মাথায় হিসেব, কুলিকে তো দিতেই হতো। দুলালবাবু ওসবের পাশ দিয়েও গেলেন না। “আরে টাকা কিসের ? আপনি অসুবিধায় পড়েছেন। এটুকু করবো না ? বসুন নিশ্চিন্তে।” আমাকে নিশ্চিন্ত করে, হাজার অনুরোধেও টাকা না নিয়ে চলে যান দুলালবাবু। স্টেশনের এদিকটা জনবহুল। আমার পাশে দুটি ছেলে বসে। আমার এবং দুলালবাবুর কথোপকথন শুনে কিছুটা উৎসুক হয়েই আমার কিষেনগঞ্জে নেমে ট্রেন বদলের কারণ জানতে চাইলে, আদ্যোপান্ত বলি। তারা অবশ্য স্বাভাবিক ভাবেই ঘটনাটা নেয় এবং আশ্বস্ত করে বলে, “নিশ্চিন্তে বসুন। এখানে কোনও ভয় নেই।”

Images 27

ভয় করে লাভও নেই। চিন্তা একটাই, ট্রেন ঢুকলে মালপত্র কি করে তুলবো ? এখনও পর্যন্ত কোনও কুলির চিন্হ তো দেখলাম না। একটা বিষয় বলতেই হবে, এই রুটের লোকজন এই স্টেশন বা এলাকা সম্পর্কে যেমন একটা বিজাতীয় ধারণা পোষণ করে, স্টেশনটি কিন্তু মোটেই সেরকম নয়। সবই খুব স্বাভাবিক। আর পাঁচটা ভারতীয় রেল স্টেশনের মতোই। অনেকক্ষণ টেনশন নিয়ে কাটানোর ফলে গলা শুকিয়ে কাঠ। সামনের স্টলে যাই, জলের বোতলের খোঁজে। হঠাৎ কি মনে হলো, দোকানদার ভদ্রলোককেই বললাম সমস্যার কথা–”কুলি পাচ্ছি না। একটা অল্পবয়সী ছেলে কী পাওয়া যাবে, আমার মালপত্র তুলে দেওয়ার জন্য ?” ভদ্রলোক জবাবে, “এখানে এটা একটা সমস্যা। ট্রেন ঢুকলে ওরা ছুটে আসবে। এখন টিকিও পাবেন না। কিন্তু আপনি চিন্তা করবেন না। আমি একে বলে দিচ্ছি। ও তুলে দেবে।” বলে, দোকানে কর্মরত এক তরুণকে পুরো দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন উনি।

কিছুটা সময় যায়। পাশের ছেলেদুটির সঙ্গে গল্প করছি। এমন সময় হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হন দুলালবাবু। বলেন, “আপনি একা আছেন। ঠিক মতো যদি উঠতে না পারেন ট্রেনে ব্যাগ নিয়ে, তাই এলাম। আমি তুলে দেব, ভাববেন না।” আমি স্টলের ছেলেটির কথা জানাই।  দুলালবাবু তাকে ডেকে বলেন, “সাবধানে তুলে দিবি দিদিকে।” পাশের ছেলেদুটি একটু সরে গিয়ে দুলালবাবুকে বসার জায়গা করে দেয়। পরিবারের গল্প করেন উনি। তিন মেয়েরই বিয়ে দিয়েছেন। “সবাই খেয়েপরে আছে দিদি। ছোট মেয়েটার জন্য খারাপ লাগে শুধু। ওর পড়ার খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু আমার ক্ষমতা কই ? শিলিগুড়িতে পৈত্রিক ছোট একটা ঘর আছে। তারই সামনে চায়ের দোকান। পিছনে আমরা বুড়োবুড়ি থাকি কোনও মতে।” বুঝলাম,অভাব আছে, কিন্তু মর্যাদাবোধ হারাননি। আর বাঁচিয়ে রেখেছেন মনুষ্যত্ব। আরও একবার চেষ্টা করেও কিছুতেই ওঁর হাতে একটি পয়সাও দিতে পারলাম না।

পদাতিক এক্সপ্রেস আসছে, ঘোষণা শোনা গেল। স্টেশনে ব্যস্ততা। দুলালবাবু নমস্কার জানিয়ে চলে যান। স্টলের ছেলেটি আমার ব্যাগ নিয়ে প্লাটফর্মে এগিয়ে যায়। ট্রেন প্লাটফর্মে ঢোকে। ব্যাগ নিয়ে ছেলেটি ওঠে, পিছন পিছন আমি। ছেলেটি ব্যাগ রেখে টাকা নিয়ে নেমে যায়। আমি নির্দিষ্ট সিটে বসতে গেলে একজন বলে, “আপনার এনজেপি থেকে টিকিট ছিল না ? আসলে টিটি ঘুরে গেছে। আপনি তখন ছিলেন না।” আমি আবার একপ্রস্থ আমার ভুলকীর্তন শোনাই। শুনে সবাই  হাসে। আমিও হাসি। ট্রেনে উঠে পড়েছি। আর কি চিন্তা? এরপর এক মজাদার টুইস্ট। একজন মোটাসোটা ভদ্রলোক একগাদা লাগেজ নিয়ে এসে আমায় বলেন, “এই সিটটা আমার।” বুঝলাম আমার অবর্তমানে টিটি এই কাণ্ডটি ঘটিয়েছেন। যাই হোক, আমি ভদ্রলোককে কিছু বলার আগেই টিটি হাজির। তাঁকে সংক্ষেপে বিষয়টা বলা মাত্রই, তিনি আমার টিকিট দেখে ভদ্রলোককে নিয়ে চলে যান।

রাত দশটা বেজে গেছে। কামরার যাত্রীরা শোওয়ার তোড়জোড় করছে। ওষুধপত্র খেয়ে আমিও বিছানা পেতে শুয়ে পড়ি। ধীরে ধীরে কামরার বাতি নেভে। বন্ধ হয় কথাবার্তা। ট্রেনের গতি দ্রুত হয়। ক্লান্তির ঘুম নামে আমার চোখেও। দুলালবাবু থাকেন স্মৃতিতে। থেকেই যান। চিরকালের মতো। শিলিগুড়ির সুভাষপল্লীতে থাকেন দুলালবাবু। ওঁর বাড়িতে একদিন যাব কথা দিয়েছিলাম। কলকাতা থেকে ফেরার পর নানা তাড়নায় ভুলেই গিয়েছিলাম ওঁর কথা। আজ লিখতে গিয়ে মনে পড়লো। খুব শিগগিরই যাব ওঁর বাড়ি। ঋণ তো শোধ হবে না। অন্তত কথাটুকু রাখি।

ছবি : প্রতীকী