নতুন ফেলুদার নয়া চ্যালেঞ্জ
হাতে হাতে স্মার্টফোন। তরুণ প্রজন্মের চোখ ইদানীং নিত্যনতুন ওয়েব সিরিজে। সারা বিশ্বের স্ট্রিমিং বিনোদন এখন হাতের মুঠোয়। সেইসব সিরিজ নিয়েই নানাকথা এই বিভাগে। লিখছেন মৃণালিনী ঠাকুর
সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’ সিরিজের সাম্প্রতিক নিবেদন ‘দার্জিলিং জমজমাট’। একটি জনপ্রিয় রেডিও চ্যানেলে এর শ্রুতি নাট্যরূপ আগেই শুনেছেন তামাম ফেলুদা-প্রেমী শ্রোতা। সেখানে ফেলুদা হয়েছেন সব্যসাচী চক্রবর্তী। ততদিনে সিনেমার পর্দায় সন্দীপ রায়ের হাত ধরে ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’ ছবিতে ফেলুদার চরিত্রে উদ্বোধন হয়ে গেছে সব্যসাচীর। অর্থাৎ রেডিও নাটকে যখন অভিনয় করছেন তিনি, তখন ফেলুদার সঙ্গে বাঙালি শ্রোতা তাঁকে সম্পর্কিত করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এহেন সব্যসাচীর সামনেও কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’ মুক্তি পাওয়ার আগে পর্যন্ত। কারণটা স্পষ্ট। সত্যজিতের নিজের সৃষ্টি ‘সোনার কেল্লা’ ও ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’ ছবিতে বাংলার প্রয়াত কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যে বেঞ্চমার্ক তৈরি করেন, সেটা ভেঙে বের হওয়া সহজ ছিল না।
বস্তুত, বাঙালি খুব বেশি মাত্রায় স্মৃতির পূজারী। তাঁরা উত্তমকুমারের জায়গায় আজও রোমান্টিক হিরো রূপে আর কাউকে গ্রহণ করতে পারে না। ফেলুদার ক্ষেত্রেও বারবার এটা হয়েছে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পর সব্যসাচী চক্রবর্তী। তারপর বাংলায় ফেলুদা হয়েছেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, আবীর চট্টোপাধ্যায়, ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত এবং সাম্প্রতিক সময়ে টোটা রায়চৌধুরী। প্রতিবারই নতুন করে তুলনা, সমালোচনা হয়েছে। বিতর্কও দানা বেঁধেছে। আদতে ফেলুদা সিরিজ করার সুবিধা-অসুবিধা দুইই রয়েছে। সুবিধা, এর কাহিনির জনপ্রিয়তা। অসুবিধা, ওই তুলনা। হইচই চ্যানেলে ওয়েব সিরিজ ‘দার্জিলিং জমজমাট’ দেখতে দেখতে একটা কথা বারবারই মনে হচ্ছিল, ফেলুদা চরিত্রের অভিনেতারাই যে শুধু তুলনার মুখোমুখি হন, তা নয়। বিভিন্ন মাধ্যমে এর নির্মাতাদেরও যথেষ্ট সমালোচিত হতে হয় এ বাবদ। সত্যজিৎ পুত্র স্বয়ং সন্দীপ রায়ও ছাড়া পাননি এক্ষেত্রে। সৃজিতের নির্মাণ প্রসঙ্গে এটুকু বলা যায়, তিনি যথেষ্ট শ্রদ্ধা সহ এবং দক্ষ কুশলতায় প্রতিটি দৃশ্যকল্প রচনা করেছেন।
যেটা বলা জরুরি–প্রত্যেক অভিনেতাই কিন্তু আপ্রাণ চেষ্টা করেন ফেলুদা হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে নিজেদের সেরাটা দিতে। প্রথমে ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’, তারপর ‘দার্জিলিং জমজমাট’ প্রসঙ্গেও তুলনার বিষয়টা উঠে এসেছে। সমালোচকদের একাংশ টোটা রায়চৌধুরী সম্পর্কে বলছেন, তাঁর অভিনয় নিয়ে আর একটু ভাবনার অবকাশ রয়েছে। ব্যাক্তিগতভাবে আমার সেটা মনে হয়নি। টোটা টলিউডের শিক্ষিত ও মেধাবী অভিনেতাদের অন্যতম। সৃজিত তাঁকে যে সুযোগ দিয়েছেন, তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন তিনি। এমনকী শীর্ষাসন, যা ফেলুদা চরিত্রকে তার যাপনের সঙ্গে সম্পর্কিত করে, সেটা পর্যন্ত পর্দায় দেখি আমরা এখানে। নিন্দুকেরা অবশ্য এখানেও কোনও ট্রিক বের করতে পারেন। বাকি সংলাপ বলা, অভিব্যক্তি বা বডি ল্যাঙ্গুয়েজের ক্ষেত্রেও ফেলুদার ইমেজ আমি অন্তত পুরোমাত্রায় পেয়েছি। আর একটি কথা, রেডিও নাটকের সঙ্গে ওটিটি ড্রামার তুলনা করাটাও অবশ্যই বাতুলতা। সেক্ষেত্রে সব্যসাচীর সঙ্গে টোটার তুলনা অযৌক্তিক।
থ্রি মাস্কেটিয়ার্সের অন্যতম জটায়ু রূপে অনির্বাণ চক্রবর্তীকে পছন্দ করেছেন দর্শক। এখানেও সন্তোষ দত্তের পর বিভু ভট্টাচার্য, রবি ঘোষ, অনুপ কুমার –সমালোচকদের হাত থেকে কেউ রেহাই পাননি। একটা কথা কেউ মনে রাখে না–সত্যজিতের নিজের কলমে, অঙ্কনে যে ফেলুদা, জটায়ু, তোপসে–সেই নিরিখেই তিনি নিজে কাস্ট করেছিলেন অভিনেতাদের। শুধু সৌমিত্র, সন্তোষ, সিদ্ধার্থ চ্যাটার্জি (তোপসে) কেন, আর একটি উৎপল দত্ত, কামু মুখার্জি, অজয় ব্যানার্জির মতো অভিনেতাদেরই বা পাওয়া যাবে কোথায় ? এবার এই তুলনা বন্ধ হোক। আমরা নতুনদের মন খুলে স্বাগত জানাই। প্রসঙ্গত, টিমের আর একজন তোপসের ভূমিকায় কল্পন মিত্রকে মোটামুটি নম্বর দেওয়া যায়। রাহুল বন্দোপাধ্যায়ের পুলক ঘোষাল তো এককথায় চমৎকার। রাহুল একজন অত্যন্ত শক্তিশালী অভিনেতা। এ সিরিজের প্রতি পর্বের প্রতি দৃশ্যে নিজের অপরিহার্যতার প্রমাণ রাখেন তিনি। সত্যজিতের ছবির একদা নায়ক বরুণ চন্দ এই মুহূর্তে বাংলা ছবির সেরা চরিত্রাভিনেতাদের একজন। সৃজিতের ছবিতে আগেও কাজ করেছেন তিনি। এখানেও তাঁর স্বচ্ছন্দ অভিনয় চোখ টানে।
সৃজিত নিজেই লিখেছেন চিত্রনাট্য। টানটান গল্প বলার প্যাটার্ন সত্যজিৎ ঘরানাকে মনে পড়িয়ে দেয়। তাঁর ছবিতে যেটা মেলে, সেই ঝকঝকে স্মার্ট প্রেজেন্টেশন সৃজিতের ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’ সিরিজের সবগুলিতেই মেলে। এখানেও সেই ব্যাপারটা বিদ্যমান। ছোট ছোট অথচ আকর্ষনীয় ও বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপ আগ্রহ ধরে রাখে আগাগোড়া। দর্শকের অপেক্ষা তীব্র হয় পরের পর্বের জন্য। সিরিজের টাইটেল ট্র্যাকে শ্রীজাতর লেখা ও জয় সরকারের সুরের গানটি দারুন মানানসই হয়েছে। কণ্ঠে আছেন শিলাজিৎ, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় ও সিধু। জমিয়ে দিয়েছেন ওঁরা। ভীষন ভালো রম্যদীপ সাহার সিনেমাটোগ্রাফি। ছয় পর্বের (এক একটি পর্বের সময়সীমা ২৫-৩০ মিনিট) এই সিরিজ বাঙালি দর্শক, বিশেষত নতুন প্রজন্ম নিঃসন্দেহে পছন্দ করবেন। ফেলুদা ম্যাজিক তো আছেই–অভিনয়, নির্মাণ, লোকেশন, সেট, কস্টিউম, মেকআপ, সবকিছুই যথাযথ মাত্রায় পরিকল্পিত।