‘নষ্টনীড়’-এ যেমন থাকে অপর্ণারা
হাতে হাতে স্মার্টফোন। তরুণ প্রজন্মের চোখ ইদানীং নিত্যনতুন ওয়েব সিরিজে। সারা বিশ্বের স্ট্রিমিং বিনোদন এখন হাতের মুঠোয়। সেইসব সিরিজ নিয়েই নানাকথা এই বিভাগে। ‘মিটু’ আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা ও গুরুত্বের পাশাপাশি এই জাতীয় অভিযোগ নিয়ে বিতর্কেরও শেষ নেই। ওয়েব পর্দায় এই বিষয়টি নিয়ে এলো হইচই। লিখেছেন মৃণালিনী ঠাকুর।
‘মিটু’ আন্দোলন নিয়ে একটা সময় উত্তাল হয়েছিল সারা বিশ্ব। আমাদের দেশও তার ব্যতিক্রম নয়। রীতিমতো ঝড় উঠেছিল মেনস্ট্রিম মিডিয়া থেকে সোস্যাল মিডিয়ায়। সময়ের নিয়মে বিষয়টি আগের মতো উত্তাল ও উত্তপ্ত আবহে না থাকলেও, এই আন্দোলনের প্রয়োজন, গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা যে এতটুকু কমেনি, তার প্রমাণ আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা। পাশাপাশি এটাও বলা জরুরি, ‘মিটু’ আন্দোলনকে ঘিরে অনেক সময়ই নানা বিতর্ক দানা বেঁধেছে অভিযোগকারিণীর সততা নিয়ে। একথাও প্রকাশ্যে এসেছে, নির্দোষ মানুষকে অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে বিশেষ কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে। সেই উদ্দেশ্য নানা রকম হতে পারে। কে সত্যি, কে মিথ্যে, তা বিচার করা কঠিন হয়ে পড়ে, সামগ্রিকভাবে এতটাই জটিল ও স্পর্শকাতর এই বিষয়টি। এবার ওয়েব সিরিজের কাহিনিতে এসে গেলো তারই ছায়া।
হইচই-এর সাম্প্রতিক বাংলা সিরিজ ‘নষ্টনীড়’ প্রসঙ্গে পরিচালক অদিতি রায় বলেছেন, “বিশ্ব ‘মিটু’ আন্দোলনের বিস্তৃত প্রভাব প্রত্যক্ষ করেছে। সেই প্রভাবের একটি জটিল ও ক্ষুদ্র স্তর থেকে একটি গল্পের চিত্রায়ন তৈরি করা আমার জন্য বেশ আকর্ষণীয় একটা জার্নি ছিল।” যেটা বিশেষ প্রশংসনীয়, ‘নষ্টনীড়’-এ অপর্ণার জীবনকথার মধ্য দিয়ে ‘মিটু’ আন্দোলনের দু’দিকের সমস্যাই তুলে ধরেছেন অদিতি। পরিবেশন গুণেই এই সিরিজ হয়ে উঠেছে আজকের সময়ের গল্প। প্রসঙ্গত, ‘নষ্টনীড়’-এর গল্প তৈরি হচ্ছে এই সময়ের অত্যন্ত প্রতিভাবান ও সৃজনশীল লেখক সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলমে।
অপর্ণার নিটোল সংসারের সব ছন্দ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়, তার স্বামী ঋষভের বিরুদ্ধে একটি ‘মিটু’ অভিযোগ ওঠার পর। সোস্যাল মিডিয়ায় ঋষভের বিরুদ্ধে মলেস্টেসনের অভিযোগ তুলেছে তারই প্রাক্তন ছাত্রী গোধূলি। অভিযুক্ত ঋষভকে পুলিশ গ্রেফতার করে। সত্য উদঘাটন করে, সে সেটাকেই স্বীকার করে নেবে, নাকি, স্বামীর প্রতি আস্থা রেখে সংসারকে তার পুরোনো ছন্দে ফিরিয়ে আনবে–এই টানাপোড়েনে জর্জরিত হতে থাকে অপর্ণা। ক্ষতবিক্ষত অপর্ণা তার উকিলের পরামর্শে হাসপাতালে গোধূলির সঙ্গে দেখা করতে যায়। সেখানে গোধূলি জানায়, সে বিচার চায়! অপর্ণা কলেজের কিছু ছাত্রছাত্রী, যারা গোধূলির অতীত জানে, দেখা করে তাদের সঙ্গে। সে গোধূলির বাড়িতেও যায়।
একটা সময়ের পর জামিনে ছাড়া পায় ঋষভ। বাড়ি ফেরে সে। কিন্তু, স্বাভাবিকভাবেই অপর্ণার সঙ্গে তার সম্পর্ক কিছুতেই আর আগের মতো হতে পারে না। দুজনের মাঝখানে এখন গোধূলির স্মৃতি। গোধূলির সঙ্গে ঋষভের অবৈধ সম্পর্ককে ঘিরে অপর্ণার মনে নানা প্রশ্ন উত্তাল হয়ে ওঠে। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে বিধ্বস্ত তাদের দাম্পত্য, যা বোধহয় কোনওদিনই আর পুরোনো মাধুর্যের সুরে বাজবে না। এইসবের মাঝে তার পিছুটান অপর্ণার শিশুকন্যা, পরিস্থিতির শিকার তো সেও ! এরই পাশাপাশি প্রশ্ন ওঠে, গোধূলির অভিযোগের সত্যতা নিয়েও। টানাপোড়েন চলতে থাকে।
‘নষ্টনীড়’-এর গল্পের শিরদাঁড়া হলো অপর্ণার ভাবনার দোলাচল, তার চূড়ান্ত ও চলমান টেনশন, মানসিক যন্ত্রনা ও অসহায়তা ইত্যাদি। অভিনয়ে সেই বিষয়টিকে দারুণ বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন সন্দীপ্তা সেন। মেগা থেকে ওয়েব সিরিজ–সন্দীপ্তার অভিনয়ের ব্যাপ্তি ও গভীরতা কতদূর, সেটা নতুন করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। অন্যান্য ভূমিকায় আছেন সৌম্য ব্যানার্জি (ঋষভ), অঙ্গনা রায় (গোধূলি), রুকমা রায়, অনিন্দ্য চ্যাটার্জি, রাহুল দেব বোস, লোকনাথ দে, নবনীতা মালাকার প্রমুখ। অভিনয়ে প্রত্যেকেই যথাযথ। আপাতত ৬ পর্বের প্রথম সিজন স্ট্রিমিং হচ্ছে।
সিরিজে অভিনয় প্রসঙ্গে উচ্ছ্বসিত সন্দীপ্তা জানিয়েছেন “একজন অভিনেতা হিসেবে নিজেকে নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করার ক্ষেত্রে সব সময়ই দারুণ উন্মাদনা অনুভব করি আমি। এমন শক্তিশালী এক চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে নিজেকে প্রমাণ করতে পারলে আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়।” সিরিজে সন্দীপ্তার লুকটাও বেশ আলাদা, সচরাচর তাঁর অভিনীত অন্যান্য চরিত্রগুলির ক্ষেত্রে যেমন হয়, তেমন নয়। মোটেই গ্ল্যামারাস নয়–একজন সাদামাটা গৃহবধূ যেমন দেখতে হয় আর কী! তবে লুক তো শুধু বহিরঙ্গ। মুখ্য বিষয়টি হলো অভিনয়। সেখানে নিজের কামাল করা পারফরম্যান্স দেখাবার সুযোগ পেয়ে তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন সন্দীপ্তা। সবশেষে আরও একবার পরিচালক অদিতি রায়ের কথা। জটিল, গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর একটি বিষয়কে তিনি একেবারে যথাযথ মাত্রাতেই হাজির করেছেন ওয়েব পর্দায়।