Monday, February 3, 2025
তবু অনন্ত জাগে

নাটকই ছিল তাঁর যাপন

জীবনমরণের সীমানা ছাড়িয়ে ওঁরা আজ বহু আলোকবর্ষ দূরের এক জগতে। তবু আছেন ওঁরা আমাদের মাঝে। থাকবেন চিরদিন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সিনেমা জগতের সেইসব মানুষ, যাঁদের অবদান ছাড়া অসম্পূর্ণ আমরা, তাঁদের নিয়েই এই বিশেষ কলম।

অভিনেতা নাসিরউদ্দিন শা বলেছিলেন, বাঙালির ওঁকে নিয়ে গর্ব করা উচিত। বিস্মৃতি-সৌখিন সেই বাঙালি কী মনে রেখেছে অসাধারণ প্রতিভাশালী, নাটক নিবেদিত প্রাণ নীলকন্ঠ সেনগুপ্তকে ? লিখেছেন অদিতি চক্রবর্তী

সরকারি চাকরির নিশ্চিন্ত ঘেরাটোপ ছেড়ে বল্গাহীন উচ্চৈঃশ্রবার মত দুরন্ত গতিতে বাংলা নাট্যজগতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন তিনি। যাঁর নামে আজও শ্রদ্ধায় অবনত হয় তামাম থিয়েটার থেকে অভিনয় দুনিয়া, সেই মানুষটির নাম নীলকন্ঠ সেনগুপ্ত। ১৯৭২ সালে ১লা জুলাই গড়ে তোলেন তাঁর নিজের নাটকের দল ‘থিয়েটার কমিউন’। দেখতে দেখতে ৫০ পেরিয়ে ৫১-য় পা দিল থিয়েটার কমিউন। ‘বিভুর বাঘ’ নাটক দিয়ে যাত্রা শুরু থিয়েটার কমিউনের! তারপর থেকে আজ অবধি প্রতিবছর এই প্রতিষ্ঠা দিবসে একটি একটি করে নাটক মঞ্চস্থ করতে করতে ৫১ বছরে ৫১টি নাটক মঞ্চস্থ করেছে তারা ! নীলকন্ঠ সেনগুপ্ত যতদিন বেঁচেছিলেন, প্রতিবছরই তিনি পয়লা জুলাই একটি নাটক মঞ্চস্থ করতেন একাডেমিতে। পরম শ্রদ্ধেয় নাট্যব্যক্তিত্ব শম্ভু মিত্রের পর তিনিই প্রথম সাহস দেখিয়েছিলেন একাডেমিতে নাটক করার। আজ যে একাডেমিতে ছোট-বড় বিখ্যাত বিভিন্ন দল নাটক মঞ্চস্থ করছে–এর অন্যতম পথিকৃৎ নীলকন্ঠ সেনগুপ্ত। নাটকই যাঁর ধ্যানজ্ঞান, নাটকই স্বপ্ন ভালোবাসা ও প্রেয়সী–সেই মানুষটির সংসারে এমন অনেকদিন গেছে, যে  হাঁড়ি চড়েনি উনুনে। তিনি কিন্তু থেমে থাকেননি। থেমে থাকেনি নাটকের রিহার্সাল! নতুন নতুন নাটকের ভাবনা !

১৯৪৭ সালে বাংলাদেশের ফরিদপুরের কোটালীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন নীলকণ্ঠ সেনগুপ্ত। সঠিক দিনটি জানা যায় না। কেন না, সেই সময়ের আর পাঁচজন সরল সাদাসিধে মায়ের মতোই তাঁর মা-ও বলতেন, তিনি কার্তিক পুজোর আগের দিন জন্মেছেন। ঠিক যেমন সেই সময় যাঁরা জন্মেছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকের মা-ই বলতেন, “ওই যে বছর বন্যা হলো, সে বছর তুই জন্মেছিলি”, বা “যে বছর ওই ধানের গোলায় সব ধান নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, সে বছর তুই জন্মেছিলি” অথবা “অমুক পূজোর দিন তুই জন্মেছিলি”। ঠিক সেই রকমই আর কি ! তিনি কি আর জানতেন, তাঁর পঞ্চমপুত্রটি একদিন বাংলার বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব হয়ে উঠবেন ? এও বোঝেননি, তিনি একজন রত্নগর্ভা, তাঁর ঘরে বেড়ে উঠছে বাংলা নাট্যচর্চার ইতিহাসে মাইল ফলক সৃষ্টিকারী এক ঋজু স্রষ্টা !

নীলকন্ঠ বরাবরই অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন, নিমগ্ন থাকতেন নাটকের পড়াশোনা নিয়ে। একটা নাটক লেখার আগে ছয়মাস সেই নাটকটির বিষয়বস্তু নিয়ে গভীর রিসার্চ করতেন। বিদেশী নাটকের বাংলা অনুবাদ করতে গিয়ে, তিনি সেই নাট্যকারের জীবনীটাও খুব ভালো করে পড়তেন। পাশাপাশি সেই নাটকের প্রেক্ষাপট বোঝার জন্য সেখানকার জনজীবন সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করার চেষ্টা করতেন। শুধু তাই নয়, নাটকটিকে আগে নিজে আত্মস্থ করতেন। তারপর সেই নাটকের অনুবাদ করতেন। নীলকন্ঠ নিজে লিখেছেন বেশ কয়েকটি নাটক। তার মধ্যে বিখ্যাত ‘জুলিয়াস সিজারের শেষ সাতদিন’, ‘পরবর্তী বিমান আক্রমণ’, ‘উপর দিকে তাকান’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

১৯৮৮ সালে বেছে নেন জীবনসঙ্গিনী কাজল সেনগুপ্তকে, যিনি ছিলেন তাঁর যোগ্য শিষ্যা। কাজলও একজন অসম্ভব প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী। পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার! সেই সময়ের সমাজে দাঁড়িয়ে মেয়েদের নাটক করা মোটেও সহজ কাজ ছিল না ! কাজলকেও বাবা-মার অমতেই বিয়ে করতে হয়েছে নীলকণ্ঠ সেনগুপ্তকে। একেবারেই অনাড়ম্বর বাহুল্যবর্জিত ছিল সেই বিবাহবাসর। সেই সময়ের অনেক সাহিত্যিক, শিল্পীর ব্যাক্তিগত জীবনই ছিল এমন আড়ম্বরহীন। জীবনের পাথেয় ছিল তাঁদের যৌথ সংগ্রাম। কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন এইসব শিল্পী-সাহিত্যিকদের সেই সংগ্রামের কথা আজকের শিল্পী-সাহিত্যিকরা ভাবতেও পারবেন না!

পড়াশোনা ছিল নীলকন্ঠ সেনগুপ্তের ধ্যানজ্ঞান। পড়াশুনা এবং নাট্যচর্চা এই নিয়েই চলে যেত সারাদিন।  শোনা যায়, আলিপুরে ন্যাশনাল লাইব্রেরীতে তিনি সকাল ন’টায় ঢুকতেন বের হতেন রাত ন’টায়। জেলায় জেলায় তখন নাট্য আকাদেমির আয়োজনে নাট্য প্রশিক্ষণ শিবির বা ওয়ার্কশপ হতো। ১৯৯০ সালে বর্ধমানে পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির আয়োজনে নাট্য প্রশিক্ষণ শিবির শুরু হয়। সেই প্রশিক্ষণ শিবিরের পরিচালনার ভার ছিল নীলকণ্ঠর ওপর। সকাল ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চলতো শিবিরের কর্মকাণ্ড। সেই শিবিরে শিক্ষক ছিলেন শ্যামল ঘোষ, কুমার রায়, মনোজ মিত্র, অঞ্জন দেব, বিভাস চক্রবর্তী, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়, দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়, মুরারি রায় চৌধুরি, রমাপ্রসাদ বণিক ও নীলকন্ঠ সেনগুপ্ত প্রমুখ। নাট্যজগতের ইতিহাসে এক উজ্জ্বলতম অধ্যায় এই সময়,  যার সম্পর্কে আজকের প্রজন্মের জানা অত্যন্ত জরুরি। তাঁর হাতে সৃষ্টি হয়েছেন বহু বিখ্যাত অভিনেতা ও নাট্যব্যক্তিত্ব। দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায় তেমনই একজন। তাঁর ছাত্র ছিলেন স্বনামধন্য অভিনেতা অভিষেক চট্টোপাধ্যায়, উদয়শঙ্কর পাল প্রমুখ প্রতিভাধর অভিনেতা। !

Img 20220706 Wa0037
নাটকই ছিল তাঁর যাপন 15

শুধু নাটক নয়, চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশনেও তিনি  অভিনয় করেছেন। সেইসব কাজ দর্শকের মনে এখনও উজ্জ্বল হয়ে আছে। এর মধ্যে রয়েছে মৃণাল সেনের ‘আকালের সন্ধানে’, ‘পরশুরাম’, সদ্য প্রয়াত তরুণ মজুমদারের ‘গণদেবতা’,’অরণ্য আমার’, ‘পথভোলা’, উৎপলেন্দু চক্রবর্তীর ‘ময়নাতদন্ত’ ইত্যাদি ছবিতে।  অভিনয় করেছেন জি টিভিতে প্রদর্শিত, ‘তর্কশ’ হিন্দি ধারাবাহিকে, যেখানে তাঁর সহ অভিনেতা ছিলেন নাসিরউদ্দিন শাহ। নীলকন্ঠর উর্দু উচ্চারণ শুনে নাসিরউদ্দিন রীতিমতো বিস্মিত হয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, তিনি অনেক বড় একজন অভিনেতা। বাঙালির গর্ব করা উচিত, এমন একজন অভিনেতা রয়েছে তাদের সংস্কৃতি জগতে !

জীবনের প্রথম দিককার লড়াইয়ের পর যখন সুখের মুখ দেখলেন কিছুটা, তখনও নীলকণ্ঠর যাপনে বিলাসের কোনও ছাপ ছিল না। পাঞ্জাবি-পায়জামা আর কাঁধে ঝোলা ব্যাগ, এই ছিল তাঁর নিত্যদিনের ছবি। আদ্যন্ত প্রচারবিমুখ ছিলেন। যে মানুষটার জন্য তাঁর ছাত্রছাত্রীরা কিছু করতে পারলে নিজেদের ধন্য মনে করতো, সেই মানুষটা কোনও দিন কারোর কাছ থেকে কোনও সুযোগ সুবিধা নিতে চাননি। শোনা যায়,  থিয়েটার কমিউনের রিহার্সালের পর প্রত্যেকে কিছু কিছু টাকা জমা করতো একটা বাক্সতে। সেখান থেকে টাকা নিয়ে জলখাবারের জন্য কেনা হতো চা-সিঙ্গারা। এভাবেই সবাই মিলেমিশে নাটককে ভালোবেসে, এই দল এগিয়ে চলেছিল আগামীর পথে।

থিয়েটার কমিউনের এক জন্মদিনে একটি নাট্ক পাঠ করা হয়েছিল। নাটকটি ছিল মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘কণ্ঠনালিতে সূর্য’। পাঠ করেছিলেন বিভাস চক্রবর্তী, মেঘনাদ ভট্টাচার্য, নীলকণ্ঠ সেনগুপ্ত ও কাজল সেনগুপ্ত। রবীন্দ্রসদনে শোয়ের আগে গ্রিনরুমে রিহার্সাল–সেখানে মোহিত চট্টোপাধ্যায়ও ছিলেন। আসলে সেই সময়টাই ছিল এক উজ্জ্বল নক্ষত্র পরিবেষ্টিত সময়। বিদগ্ধ পণ্ডিত মানুষজন কেমন এক আলোকিত বলয় রচনা করেছিলেন ! তাঁরা প্রকৃত শিল্পী, শিল্প সাধনায় তাঁরা এতটাই নিমগ্ন ছিলেন, যে অন্য কোনও দিকে আগ্রহ ছিল না তাঁদের। কোনও দিন কোনও অন্যায়কে প্রশ্রয় দেননি–এতটাই ঋজু ছিল তাঁদের শিরদাঁড়া !

নীলকন্ঠ সেনগুপ্ত ১৯৮৮-তে পেয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার। বিশিষ্ট পরিচালকের পুরস্কার পান ১৯৮৯ সালে। এছাড়াও ছোট-বড় অনেক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি. তবে,  সব থেকে বড় পুরস্কার অগণিত মানুষের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও সম্মান ! তাঁর প্রতিষ্ঠিত থিয়েটার কমিউন পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি জেলা এবং ভারতের ১১টি রাজ্যে আমন্ত্রিত নাট্যদল হিসেবে নাটক মঞ্চস্থ করেছে। প্রসঙ্গত, সফদর হাসমি স্মরণে ‘৪ঠা জানুয়ারি’ নাট্যাভিনয় করেছিল থিয়েটার কমিউন। এ বছর থিয়েটার কমিউনের ৫০ বছর পূর্তি হলো। সংস্থার পক্ষ থেকে এবারে ‘নীলকন্ঠ সেনগুপ্ত স্মৃতি স্মারক পুরস্কার’ প্রদান করা হয়েছে বিশিষ্ট নাট্যকার  দেবাশিস মজুমদার এবং বিশিষ্ট নট ও নাট্যকার অরুণ মুখোপাধ্যায়কে। দেবাশিস মজুমদার ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল এই ছয় বছর নীলকণ্ঠ সেনগুপ্তের থিয়েটার কমিউন নাট্যদলের সাথে যুক্ত ছিলেন। নাট্যকার অরুণ মুখোপাধ্যায়ও ছিলেন নীলকন্ঠর একজন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিনিও বাংলা নাট্য আকাশে ধ্রুবতারা সম!

থিয়েটার কমিউনের বর্তমান সেক্রেটারি সৌম্য পাল জানাচ্ছিলেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। ১৯৯০ সালের নাট্য একাডেমির নাট্য প্রশিক্ষণ শিবির চলছিল চন্দননগরে। হুগলি, হাওড়া, বর্ধমান থেকে বেছে বেছে চল্লিশ জনকে নেওয়া হয়েছিল সেই প্রশিক্ষণ শিবিরে।  হুগলি থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন সৌম্য পাল! নীলকন্ঠ সেনগুপ্ত তাঁকে দলে যোগ দেওয়ার জন্য বলেন। পরে তিনি থিয়েটার কমিউনে যোগ দেন এবং আজ পর্যন্ত আছেন। তাঁর কথার সূত্র ধরেই বলা যায়, থিয়েটার কমিউনের মতো থিয়েটার দলগুলি স্পন্সরশিপ পায় না। দলের সদস্যদের সদিচ্ছা এবং শিল্পের প্রতি গভীর আনুগত্যে কাজ এগিয়ে চলছে। নাট্যশিল্পের প্রতি অমোঘ টানেই তাঁরা আসেন, নাটক মঞ্চস্থ করেন এবং দর্শকের ভালো লাগাই তাদের একমাত্র পাথেয়! বর্তমানে থিয়েটার কমিউনের পরিচালক ও নির্দেশক হলেন বিখ্যাত অভিনেতা ও নির্দেশক সুব্রতনাথ মুখোপাধ্যায়। ‘মোহর’ নাটকে তিনি অভিনেতা হিসেবে যোগদান করেন থিয়েটার কমিউনে। তারপর তিনি দলের নির্দেশনার ভার গ্রহণ করেন। তাঁদের নবতম প্রযোজনা হলো ‘কাগজের পাখী’, এককথায় যা অসাধারণ !

Img 20220707 Wa0041
নাটকই ছিল তাঁর যাপন 16

বাংলা নাট্যচর্চার ইতিহাসে একটি ব্যতিক্রমী নাম হিসেবে বেঁচে থাকবেন নীলকন্ঠ সেনগুপ্ত। প্রজন্মগত ভাবে সমৃদ্ধ করে গেছেন তিনি বাংলা নাট্য জগতকে। ২০১০ সালে এ পৃথিবীর মায়া ছাড়িয়ে বড় অসময়ে তিনি পাড়ি জমান অন্যলোকে। রেখে যান স্ত্রী কাজল সেনগুপ্ত ও কন্যা কাঞ্চনমালাকে! উত্তরাধিকার সূত্রে কাঞ্চনমালাও অসাধারণ অভিনয় ক্ষমতার অধিকারী হয়েছেন। ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই তাঁকেও আমরা দেখব নাট্যমঞ্চে! নীলকন্ঠ সেনগুপ্তকে সামনে রেখে এ প্রজন্ম জানুক শিল্প আর স্বার্থ কখনও মিশিয়ে ফেলতে নেই। শিল্পের প্রথম শর্তই হচ্ছে সত্যকে জানা, সত্যের পুজো করা। থিয়েটার কমিউন যেন এগিয়ে চলতে পারে আরও দীর্ঘ পথ, এই প্রত্যাশা !

তথ্যসূত্র : কাজল সেনগুপ্ত

ছবি : কাজল সেনগুপ্তের সংগ্রহ থেকে