Monday, February 3, 2025
কৃষ্টি-Culture

নাট্যোৎসবে বিশ্বরেকর্ড কলকাতায়

কলকাতায় পেশাদারী রঙ্গমঞ্চের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আজ থেকে ৭৫ বছর আগে বহুরূপী নতুন এক নাট্যধারার স্রোত বইয়ে দিয়েছিলেন। দলের প্রাণপুরুষ শম্ভু মিত্রের নেতৃত্বে গঠিত সেই ধারাকে অনুসরণ করে কলকাতা শহরে তো বটেই, সারা বাংলা জুড়ে শুরু হয়েছিল গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন। এই বছর সেই আন্দোলন ৭৫-এ পা রাখল। সেই ঘটনাকে স্মরণ করতে এবং প্রয়াত নাট্যবিদ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতি উস্কে দিতে ‘মুখোমুখি’ নাট্যদল কলকাতার আটটি দলকে নতুন আটটি নাটক করার প্রস্তাব দেয়। দলগুলির সেই প্রস্তাবে সাড়া দেওয়ার ফলস্বরূপ কলকাতাবাসী পেল এমন একটি উৎসব দেখার অভিজ্ঞতা।

গ্রুপ থিয়েটারের জয়ধ্বনি দিয়ে নাট্যোৎসব শুরু হলো বাংলা বছরের শেষদিন অ্যাকাডেমি মঞ্চে। শুরুতেই মুখোমুখির পক্ষ থেকে রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, অশোক মুখোপাধ্যায়, বিভাস চক্রবর্তী, মেঘনাদ ভট্টাচার্য–বাংলা নাটকের এই চার মহীরুহকে সম্বর্ধনা দেওয়া হলো। সম্মাননা জানালেন ‘মুখোমুখি’-র দুই কর্ণধার পৌলমী চট্টোপাধ্যায় ও বিলু দত্ত। প্রথম সন্ধ্যায় ছিল সাত্র’র লেখা অবলম্বনে অংশুমান ভৌমিকের নাটক ‘মণিকর্নিকায় মনিকা’। পটভূমি আজকের বেনারস। এক হিন্দু পরিবারের মেয়ে মনিকা বেনারস স্টেশনে নামতেই তিন-চারজন তরুণ তাঁকে ধর্ষনের চেষ্টা করে। বাঁচায় এক মুসলিম তরুণ। পুলিশের কাছে অভিযোগ জানালে, শুরু হয় মনিকার ওপর মানসিক নির্যাতনের এক হিংস্র বদলা! তার রক্ষাকর্তা মুসলিম তরুণকেই ধর্ষক বানানো হয়।

এরপর মনিকা কী করে, সেই বিস্তারে না গিয়ে বলা যায়, একটি বিশেষ ধর্মীয় সংগঠনের দর্পিত বাহিনী কিভাবে বেনারস শহরটাকে কব্জা করে রেখেছে এবং সেখানকার সংখ্যালঘু মুসলিমদের কেমন ভয়াবহ আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাতে হয়–সেটাই দেখানো ছিল নাট্যকারের উদ্দেশ্য। ‘প্রাচ্য’র প্রযোজনায় বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনায় নাট্যকারের বক্তব্য সুন্দরভাবে প্রকাশিত হয়েছে এখানে। হিরণ মিত্রর শিল্প নির্দেশনায় ব্যাকগ্রাউন্ডের পর্দায় সারাক্ষণ ফুটে উঠতে থাকে তাঁরই তুলিতে আঁকা বিভিন্ন দেবদেবীর স্কেচ, যা ছিল নজর কেড়ে নেওয়ার মতো। তবে, এই প্রযোজনার প্রকৃত আকর্ষণ প্রধান দুই চরিত্রে সুপর্ণা দাশ ও জয়রাজ ভট্টাচার্য’র দুর্দান্ত অভিনয়।

উৎপল দত্তর লেখা ‘আজকের শাহজাহান’ তাঁরই পরিচালনায় দেখেছি। তবু, তুলনা করছি না। পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায় কিছুটা সম্পাদনাও করেছেন। তবে, সঞ্চয়ন ঘোষের মঞ্চভাবনা এক কথায় অনবদ্য। আর প্রবীণ নট কুঞ্জাবিহারী হয়েছেন শংকর চক্রবর্তী, যাঁর সঙ্গে খোদ উৎপল দত্তরও খানিকটা যোগাযোগ ছিল। কুঞ্জবিহারীর পুরনো কিছু নাটকের অভিনয়ের দৃশ্য ফিল্মে তুলে সেগুলিকে মঞ্চে প্রজেক্ট করেছেন বেশ নাটকীয় জায়গায়, যেটা পুরনো প্রযোজনায় ছিল না।সুমনের নিখুঁত নির্দেশনা এবং শংকর ও তরুণ পরিচালকের ভূমিকায় ঋদ্ধি সেনের অভিনয় নাটকটিকে মনোহারী করেছে। হ্যাঁ, আজকের সময়ের ছাপও এনেছেন নাটকে সুমন। আর এখানেই তাঁর নাট্যসৃজন ভাবনার অভিনব আলোকপাত।

Img 20230424 Wa0044
নাট্যোৎসবে বিশ্বরেকর্ড কলকাতায় 7

বাবা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় জীবিত থাকাকালীন একাধিকবার চেষ্টা করেও, নিজের লেখা যে নাটকটি তিনি করে যেতে পারেননি, কন্যা পৌলমী সেই ‘জন্মান্তর’ নাটকটি প্রথম মঞ্চে আনলেন এই নাট্যোৎসবেই। উৎসবের তৃতীয় দিনে রবীন্দ্রসদন মঞ্চে তিনি বাবার স্মৃতিতে উৎসর্গ করলেন নাটকটি। এক চিত্রতারকার (জ্যোতির্ময়) এক নতুন জন্মের কাহিনি বলা হয়েছে এই নাটকে। সৌমিত্র বেঁচে থাকলে জ্যোতির্ময়ের চরিত্রে নিশ্চিতভাবে তিনি নিজেই অভিনয় করতেন। এখানে করেছেন দেবদূত ঘোষ। পৌলমী অভিনয় করেছেন এক সমাজকর্মীর চরিত্রে। প্রতিটি চরিত্রই সুঅভিনীত। পৌলমীর পরিছন্ন পরিচালনা এই প্রযোজনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

চার্বাক-এর প্রযোজনা ‘নীরজাসুন্দরী’, পরিচালনা অরিন্দম গাঙ্গুলি। মহুয়া-সুন্দরী পালার আদলে নীরজাসুন্দরী নামের এক খেমটাওয়ালির জীবন নিয়ে নাচ ও গানের সঙ্গে প্রেম ও খুনের ঘটনা মিলিয়ে নাটক। সুখেন্দুর চরিত্রে অরিন্দম নিজে সুরেলা গলায় গান গেয়ে নীরজার প্রতি প্রেমের অভিনয়ে সফল। নীরজার চরিত্রে শিল্পা মণ্ডলও ভালই সংগত করেছেন। বিলু দত্তর মঞ্চসজ্জা প্রাচীন এবং বর্তমান সময়কে সুন্দর মিলিয়েছে। তবে, সামগ্রিকভাবে নাটক তেমন জমেনি।

Img 20230425 Wa0040
নাট্যোৎসবে বিশ্বরেকর্ড কলকাতায় 8

এই নাট্যোৎসবে চেতনা-র নিবেদন ছিল অজিত দলভির মারাঠি নাটক অবলম্বনে অরুণ মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘মহাত্মা বনাম গান্ধী’! পরিচালনা ছাড়াও গান্ধীজির বড় ছেলে হরিলালের চরিত্রে অভিনয় করেছেন নীল মুখোপাধ্যায়। বাবা ও ছেলের মধ্যে নীতিগতভাবে যে বিরোধ ছিল, সেটা নিয়েই এই নাটক। বাবা চাইতেন ছেলে দেশের জন্য তাঁরই মতো আত্মত্যাগ করে স্বদেশী আন্দোলনে যোগ দিক। কিন্তু ছেলের স্বপ্ন ছিল বিলেত গিয়ে বাবার মতো উকিল হবেন এবং সফল আইন ব্যবসায়ী হবেন। বাকি দুই ছেলে গান্ধীজির সব সিদ্ধান্ত মেনে নিলেও, হরিলাল প্রতিবাদ ক’রে নিজের জীবনে দারিদ্র্য ও হতাশায় ডুবে যান। দীর্ঘ নাটকটির একটু সম্পাদনা প্রয়োজন ছিল। অভিনয়ে অবশ্য মহাত্মার ভূমিকায় অনির্বাণ চক্রবর্তী এবং হরিলালের চরিত্রে নীল মুখোপাধ্যায় লেটার নম্বর পেয়ে যাবেন।

নাট্যরঙ্গ প্রযোজিত ‘মধ্যরাতের চুপকথা’ অনেকটাই কমেডির মোড়কে এক প্রবীণ নাট্যাভিনেতার করুণ কাহিনি বলে। পরিচালক সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় এই নাটকের লেখক এবং প্রধান চরিত্রের শিল্পীও। গ্রামে নাটকের শো করতে গিয়ে নায়িকার অনুপস্থিতির জন্য ঝামেলা হওয়ায় নাটকের চরিত্রের ছদ্মবেশে নায়ক একটা পুরনো বাড়িতে আশ্রয় নেয়, যে বাড়িতে নাটক-অভিনয়-সিনেমা–সবকিছু নিয়েই আলোচনা বারণ। কারণ, কয়েক বছর আগে অভিনয় করবে, এই জেদ নিয়ে বাড়ি ছেড়েছিল এ বাড়ির বড় ছেলে। এবার ধীরে ধীরে কেমন করে ছদ্মবেশ সরিয়ে হারিয়ে যাওয়া ছেলে ফিরে এলো, তাই নিয়ে মজার মজার ঘটনার মধ্য দিয়ে সত্যের উন্মোচন করেছেন সুরজিৎ। অভিনয়ে তিনি বেশ সাবলীল।  এই নাটকটিরও সম্পাদনা প্রয়োজন।

Manikarnikay Monika By Prachyo 3
নাট্যোৎসবে বিশ্বরেকর্ড কলকাতায় 9

দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় সংসৃতির নিবেদন ছিল রুশ নাট্যকার ইউযিনি সোয়ারঝের লেখা আশ্রিত দেবেশেরই রচনা ‘খোক্কস’! তিনি নাটকটিকে আজকের সমাজ ও রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে চেয়েছেন। করেছেনও। কিন্তু তাঁর সৃজনে ঢুকে পড়েছে অ্যাবসার্ড নাটকের চেহারা। ফলে নাটকটি সাধারন দর্শকের কাছে কিঞ্চিৎ শক্ত বাদামের মতো লাগতে পারে। দেবশঙ্কর হালদার এবং অনির্বাণ ভট্টাচার্যের অভিনয় প্রধান আকর্ষণ হলেও এই নাটকের একটু সরলীকরণ প্রয়োজন।

নাট্যোৎসবের সমাপ্তি সন্ধ্যায় দেখা গেলো পঞ্চম বৈদিক-এর নিবেদন অর্পিতা ঘোষের পরিচালনায় ‘তুমি ঠিক যদি ভাবো তুমি ঠিক’ ! পিরান দাল্লোর লেখা থেকে রূপান্তর করেছেন অর্পিতা নিজেই। নাটকের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ‘সত্য’ কী! কোনও মানুষ সম্পর্কে যা শোনা যায়, সেটাই কি শেষ সত্য? নাকি সত্য আপেক্ষিক? একই ঘটনা একজনের কাছে সত্য মনে হলেও অন্যজনের কাছে সত্য নাও হতে পারে! এই তর্কটাকে মেয়ে-জামাই ও শাশুড়ির মধ্যে এনে এক ধাঁধা তৈরি করেছেন নাট্যকার। অর্পিতা বেশ নিপাট ভঙ্গিতে তিনটি পর্বে সাজিয়েছেন নাটকটি। বিবেকের মতো একটি চরিত্রে দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ই নিয়েছেন সত্য নির্ধারণের দায়িত্ব। সবক’টি দলের ক্ষেত্রেই উৎসব উপলক্ষে মঞ্চস্থ হয়েছে নাটকগুলির প্রথম শো। সেই দিক থেকে যতটুকু যা ত্রুটি, ক্রম মঞ্চায়নে, পরিবর্তন ও পরিমার্জনায় নিশ্চয়ই সেইসব কাটিয়ে উঠবেন তাঁরা। সেই নিরিখে উৎসবে তাঁদের সক্রিয় যোগদানটাই একান্তভাবে অভিনন্দনযোগ্য। সবশেষে, মুখোমুখি নাট্যসংস্থা এবং পৌলমী ও বিলু দত্তকে হার্দিক ধন্যবাদ জানাই বাংলা গ্রুপ থিয়েটারের ৭৫তম বার্ষিকী পালন উপলক্ষে এমন একটি বিরল এবং বিশ্বরেকর্ড সৃষ্টিকারী নাট্যোৎসব আয়োজনের জন্য।