নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ রাখুন নিজের হাতে
জীবন নিজেই এক রঙিন জলছবি। চলার পথে কত না বাঁক! প্রতি মুহূর্তে নিজেই সে নিজের রঙ বদলায়। সেই বিচিত্র জীবনের কথা এই বিভাগে। পড়ছেন চয়নিকা বসুর কলমে।
কয়েকদিন আগের কথা, আমার পরিচিত একজন আমায় জানান, তাঁর চেনা এক তরুণী, যার শ্বশুরবাড়ির মানুষজন খুবই রক্ষণশীল। ফলে, সেই তরুণীর দিন যাপন বেশ একটা দমবন্ধকর অবস্থায়। এর থেকে মুক্তি পেতে সে কিছু কাজ করতে চায়। তরুণী শিক্ষিত ও ডিগ্রীপ্রাপ্ত। টাকাপয়সার ব্যাপারটা খুব গুরত্বপূর্ণ নয়। তার শুধু একটা ভালো এনগেজমেন্ট চাই। অর্থাৎ, যা তাকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও তার বর্ণিত দমবন্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি দেবে। প্রসঙ্গত, তরুণীর একটি শিশুসন্তানও আছে। আপাতত সন্তানকে ঘিরেই তার জীবনের গতি প্রবাহিত। সম্ভবত, তার বাইরে তরুণীকে সেভাবে সংসারে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। আমার পরিচিতা ভদ্রমহিলার অনুরোধ, একটি চাকরির খবর যদি দিতে পারি আমি।
আমার পরিচিতা এই ভদ্রমহিলা অত্যন্ত সংবেদনশীল একজন মানুষ। শিক্ষিত, সচেতন, সমাজমনস্ক এবং আবেগপ্রবণ। একা ভালো থাকায় বিশ্বাসী নন তিনি। আশপাশের মানুষরাও যাতে ভালো থাকেন, তার জন্য তাঁর চেষ্টাটা আন্তরিক। একটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হওয়ার ফলে যথেষ্ট ব্যস্ততায় দিন কাটে তাঁর। তবু, তিনি অপরের জন্য ভাবেন। তাঁর এই দরদের জায়গাটায় আঘাত করতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু সঙ্গত কারণেই কিছু জরুরি কথা এই প্রেক্ষিতে বললাম তাঁকে। সেই কথার নির্যাসেই আজকের প্রতিবেদন।
সমাজ-সংসারে মেয়েদের অবস্থান এই একবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছেও যে পরিমাণ সম্মানজনক হওয়ার কথা ছিল, তা যে হয়নি, সে ব্যাপারে আমরা সবাই অবহিত। প্রয়োজনের তুলনায় পরিবর্তন শতাংশের হিসেবে এখনও লজ্জাজনক। এর জন্য কে কতটা দায়ী, তার বিশ্লেষণ এই প্রতিবেদনের বিবেচ্য বিষয় নয়। আমাদের ভাবনাবিন্দু অন্যত্র। যে তরুণীর উল্লেখ করে লেখাটি শুরু করলাম, যাপনের ক্ষেত্রে এভাবেই বেঁচে আছেন, থাকেন এমন মহিলা আজও প্রায় এদেশের ঘরে ঘরে। কে কীভাবে নিজের জীবন কাটাবেন, সেটা তাঁর ব্যাক্তিগত সিদ্ধান্ত। যদি এটা তাঁর নিজের সিদ্ধান্ত না হয়, তাহলে, তিনি সমঝোতা করছেন। সমঝোতা করবেন কিনা, না করলে কী করবেন, বিপ্লব না বশ্যতা–কোনটি তাঁর পথ হবে, সেও তাঁর নিজেরই সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত।
আমার প্রশ্ন, আজকের মহিলাদের কাছে এখানেই। এই নিজের জন্য নিজে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গায় কী আমরা যেতে পেরেছি ? যদি না পারি, তাহলে, অন্য কেউ কী করে আমার জীবনের সব কালো দুর করে আলোকময় করে তুলবে আমার যাপন ? আমি বধূ নির্যাতন বা ওই জাতীয় গুরুতর পরিস্থিতির কথায় যাচ্ছি না। সেটা তো চরম একটা অবস্থা। এটার জন্য আইন-আদালত বা প্রশাসনিক স্তরে যে ব্যবস্থাগুলি নেওয়ার অবশ্যই নিতে হবে। সামাজিকভাবে বৃহত্তর স্বার্থে প্রতিবাদ, আন্দোলনও চালিয়ে যাওয়া জরুরি। সেটার জন্য, যিনি নির্যাতনের শিকার, তাঁর পাশে সবাইকে দাঁড়াতে হবে।
কিন্তু যেখানে অভিযোগগুলো উঠে আসে অন্য এক অভিমুখ থেকে ! স্বামীর প্রতি অভিমান (যার কারণ নানাবিধ হতে পারে), শ্বশুরবাড়ির বাকি সদস্যদের ব্যবহারে তিক্ততা, অশান্তি ইত্যাদি ইত্যাদি। এইসব কারণেও মহিলাদের মনে হতাশা, আক্ষেপ, যন্ত্রনা পুঞ্জীভূত হয়। অর্থাৎ, এই বিষয়গুলিও অভিযোগের ভিত্তি হতে পারে। এটাও বলা জরুরি, কে কতটা স্পর্শকাতর, তার ওপরেও কিছুটা অনুভূতিগুলি কাজ করে। এসব ক্ষেত্রে সমাধানে নিজেকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। বন্ধু বা সমব্যথী যাঁরা, তাঁরা সহানুভূতির হাতটা বাড়িয়ে দিতে পারেন। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বাইরের কারও হস্তক্ষেপ যুক্তিযুক্ত নয়। একদিন-দুদিন কেউ বাইরে থেকে সহানুভূতি দেখাতে পারেন। কিন্তু ওই দমবন্ধকর অবস্থার স্থায়ী সমাধান চাইলে নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে। বারবার প্রশ্ন করতে হবে। কি চাইছি আমি ? কেন চাইছি ? আমার সত্যিকারের অভিযোগটা কী ? আমি এখন যে অবস্থায় আছি, তার পরিবর্তন আমি পরে নিজেই গ্রহণ করতে পারবো তো ? নিজেকে বোঝা, নিজের আকাঙ্খা, চাহিদাকে জানা মানুষের জীবনে সবচেয়ে জরুরি।
এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ভাবে একজন মহিলা কতটা স্বনির্ভর, সেটা নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ। তবে, বহু স্বনির্ভর মহিলাকেও এই পরিস্থিতিতে সমঝোতার পথে যেতে দেখেছি। মনে রাখবেন, সমঝোতা আর বোঝাবুঝি কিন্তু এক নয়। উল্টোদিকে, যাঁরা অর্থনৈতিক ভাবে স্বনির্ভর নন, তাঁদেরও নিজের জন্য বদ্ধঘরের জানালা খুলে দখিনা ফুসফুসে টেনে নেওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু সেই অধিকার নিজেকেই অর্জন করতে হবে। বাইরে থেকে অপরের দাম্পত্যে, অন্যের সংসারে হস্তক্ষেপ কখনোই সমীচীন নয়। আদতে, এই হস্তক্ষেপের ফল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাড়তি অশান্তি, সমস্যা, ঝঞ্ঝাট ডেকে আনে।
লেখা শেষ করবো, বিষয়ের একেবারে শিকড়ে গিয়ে। বাবা-মা বা অভিভাবকদের মধ্যে অধিকাংশই তাঁদের ঘরের মেয়েদের বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চান। বিয়ে, স্বামী, সংসারই মেয়েদের নিরাপদ আশ্রয় ভাবা হয়। নিরাপত্তা তো ঘরের চারটে দেওয়াল বা মাথার ওপরের ছাদটা নয়। আশ্রয় হলো সম্পর্ক। একজন মহিলা বিবাহসূত্রে তাঁর চেনা পরিবেশ ছেড়ে অন্য এক পরিবারে আসে, সেখানে নিরাপত্তার গ্যারান্টি তার নিজেকেই নিজের খুঁজে নিতে হয়। কিন্তু সেই খুঁজে নেওয়ার যে সমীকরণ, সেটা শৈশবেই তার অন্তরে প্রোথিত করে দিতে হবে পরিবারের পক্ষ থেকে।
এরই পাশাপাশি বলা জরুরি, একটি মেয়ে, তার জীবনের লক্ষ্য হবে শুধু বিয়ে করে সংসার করা, এটাও ঠিক নয়। বিয়ে, সংসারে আমার পূর্ণ সমর্থন আছে। কিন্তু কোনও একটি পরিবারের বধূ হওয়াই তার পরিচয় হতে পারে না। তার পরিচয় সে নিজে রচনা করবে। তার ভাবনার জগৎকে সেভাবেই গড়ে দিতে হবে। শিক্ষা, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা শুধু নয়–জরুরি হলো ব্যক্তিত্বের বিকাশ, নিজের জীবনের যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিজে গ্রহণ করবার মতো আত্মবিশ্বাস, যে কোনও পরিস্থিতির সঙ্গে যুঝবার ধৈর্য ও ক্ষমতা। এগুলো পুরুষের দরকার নেই, তা নয়। সব মানুষেরই দরকার। মহিলাদের প্রসঙ্গে পৃথকভাবে বারবার এগুলো উল্লেখের প্রয়োজন। কারণ, তাঁদের জন্য সমাজ–ভাবনা, কাজ বা সিদ্ধান্তকে পুরুষের থেকে আলাদা করে রেখেছে। তাকে এখনও মানসিকভাবে স্বনির্ভর দেখতে চায় না সমাজ।
মানসিকতা–এটাই সবশেষ ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মহিলাদের নিজের জায়গা থেকেও বিষয়টা এভাবে দেখা জরুরি। মানসিক গঠন এমন হবে, যেখান থেকে এক পরিণত দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে জীবনকে পরিচালিত করবে সে। যাবতীয় প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠবে, সেই মন নিয়েই। বোঝার চেষ্টা করবে, সংকটটা আসলে কোথায় ? অন্যায়ের প্রতিবাদ নিশ্চয়ই করতে হবে। কিন্তু সেই বিচারের ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে হবে নিজের বোধ ও চেতনা। আর কিছু না পাওয়া একেবারে একান্তের। সেই অপ্রাপ্তিকে প্রাপ্তিতে ভরিয়ে তোলা বা মেনে নেওয়া দুটোরই ভার নিতে হবে নিজেকে। সেটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। দীর্ঘসুত্রীও হতে পারে। তা সত্ত্বেও এটাই যুক্তিযুক্ত। এতে, আর যাই হোক, নিজের জীবনটা নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখার অভ্যাসটা গড়ে উঠবে। আর সবার আগে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা ছাড়া মেয়েদের শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দায় সারার মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে অভিভাবকদের।