Monday, February 3, 2025
তবু অনন্ত জাগে

পঞ্চম সুরে আজও মাতোয়ারা জগৎ-সংসার

জীবনমরণের সীমানা ছাড়িয়ে ওঁরা আজ বহু আলোকবর্ষ দূরের এক জগতে। তবু আছেন ওঁরা আমাদের মাঝে। থাকবেন চিরদিন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সিনেমা জগতের সেইসব মানুষ, যাঁদের অবদান ছাড়া অসম্পূর্ণ আমরা–তাঁদের নিয়েই এই বিশেষ কলম। এক ক্ষণজন্মা প্রতিভা ছিলেন সারা ভারতের সঙ্গীতপ্রেমী মানুষের প্রিয় পঞ্চম তথা রাহুল দেব বর্মন। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এই বিশেষ প্রতিবেদন লিখেছেন অভিজিৎ রাহা

“পঞ্চম আরব সাগরের সাইক্লোন। বঙ্গোপসাগরে ঢেউ তুলে, ভারত মহাসাগরকে উত্তুঙ্গ করে আটলান্টিক-প্যাসিফিক ছুটেছিল। ছন্দের জাদুকর, মেলোডি কিং পঞ্চম এক ক্ষণজন্মা প্রতিভা।”– বলেছিলেন সলিল চৌধুরী। রাহুল দেব বর্মন। জন্ম ২৭ জুন ১৯৩৯ । মৃত্যু ৪ জানুয়ারি ১৯৯৪।

কিশোর রাহুলকে বাবা শচীন দেব বর্মন প্রশ্ন করেছিলেন “তুমি বড় হয়ে কী হতে চাও ?” রাহুল জবাব দেন “তোমার চেয়ে বড় সুরকার হতে চাই।” বাবার চেয়ে বড় সুরকার তিনি হতে পেরেছিলেন কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু ‘বাপ কা বেটা’ রাহুল দেব ট্রেন্ড সেটার যে হয়েছিলেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রক্ষণশীল সঙ্গীত পরিচালক নৌশাদকেও এক সময় বলতে হয়েছে–এদেশের ফিল্ম মিউজিকে বিপ্লব এনেছে পঞ্চম। ওঁর পরে যারা কাজ করছে, তারা ওঁরই পথ ধরে বা তাকে খানিকটা বিকৃত করে ছাড়ছে, বেরিয়ে আসার পথ পাচ্ছে না।

220Px Rahul Dev Burman
পঞ্চম সুরে আজও মাতোয়ারা জগৎ-সংসার 7

দিকপাল গায়ক-গায়িকাদের মতে কম্পোজার রাহুল দেব বর্মনই ‘লাস্ট অফ দ্য ওরিজিন্যালস’। গত শতকের ছয়ের দশকে হিন্দি গানের মোড় ঘুরিয়ে নতুন ঢেউ এনেছিলেন রাহুলদেব বর্মণ। সেই সময় লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারেলাল জুটির লক্ষ্মীকান্ত বলেছিলেন–পঞ্চম নে হম সবকো হিলাকে রখ দিয়া। তেত্রিশ বছর সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে সক্রিয় রাহুল দেব বর্মনের মিউজিক-ম্যাজিক, তাঁর প্রয়াণের ত্রিশ বছর পরেও ফুরিয়ে যায়নি। এই একুশ শতকের স্যাটেলাইট শাসিত বিশ্বায়নের যুগে নতুন প্রজন্মের শ্রোতাদের কাছেও রাহুলদেবের অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ। আজও লঘু সঙ্গীতের শ্রোতাদের সিংহভাগই আর ডি-কে সঙ্গীতের ঈশ্বর বলে মনে করেন। মনে করেন তিনিই হলেন ‘মাস্টার অফ মাস্টার্স’।

এক সাক্ষাৎকারে গুলজার সাহেব বলেছিলেন, আমাদের কাজের ধরণ ছিল একদম আলাদা। লং ড্রাইভে ড্রাইভিং হুইলে টোকা দিতে দিতে সুর করে ফেলতে পারতেন পঞ্চম। তাঁর কাছের মানুষরাও জানতেন, কাপ-প্লেট, বোতল বা চিরুনি হাতের কাছে যা পাওয়া যাবে, তাই বাজিয়ে সুর করার ক্ষমতা ছিল পঞ্চমের জন্মগত। মাথায় কোনও সুর এলেই, গুলজারের কাছে শব্দ চাইতেন পঞ্চম। একজন সুরকার একজন শিল্পীর গলায় সুরটি তুলিয়ে রাখলে, সেটা মনে থাকার কথা। কিন্তু পঞ্চমের সব কর্মকান্ডই যে ভিন্নধর্মী। সুরকে শব্দে বসিয়ে রেখে একটা চেহারা দিয়ে রাখতেন গানটির। পরে শব্দ মনে পড়লেই সুরও ভেসে উঠত মনে।

Images 7 2
পঞ্চম সুরে আজও মাতোয়ারা জগৎ-সংসার 8

বিমল রায়ের সেটে কোনও এক ছবির গানের সুর করছিলেন বাবা শচীনদেব। রাহুল তখন তারুণ্যে টগবগ করছেন, প্রাণশক্তিতে ভরপুর। বারবার বাবাকে পরামর্শ দিচ্ছেন–এভাবে না হয়ে যদি ওভাবে, ওভাবে না হয়ে রিদমটা যদি এভাবে হয়। বিরক্ত শচীনকর্তা তাঁকে বাইরে যাওয়ার আদেশ দিলেন। তারপর বললেন, ”গানের চরিত্রটাই ধরতে পারেনি ছেলেটা।” সেই পঞ্চমই তাঁর আজীবনের গানকে দিয়ে গেলেন এক অননুকরণীয় চরিত্র। কখনও রাগ সঙ্গীতের বিস্তারে, কখনও আবার পশ্চিমী সঙ্গীতের ঝঙ্কারে।

আর ডি বর্মন মানে যেমন একটা প্রাণোচ্ছল উচ্ছ্বাস, তেমনই আর ডি বর্মন মানে স্নিগ্ধ-শীতল বাতাস, যা কৃতি সুরকারের অন্যতম পরিচয়। যেমন ‘মুসাফির হুঁ ইয়ারো’ গানটির সুর করছেন যখন, তখন আর ডি সারা রাত গাড়ি করে মুম্বইয়ের পথে পথে ঘুরে বেরিয়েছিলেন। তারপর যে গান হলো, তাতে রিদমের একটাই প্যাটার্ন থাকলো। ইন্টারলিউডে গানের মুখড়া বাজলো। ব্রেক করে অন্য কোনও যন্ত্র এনে গানের মেলোডি নষ্ট করতে চাননি তিনি।

Images 7 4
পঞ্চম সুরে আজও মাতোয়ারা জগৎ-সংসার 9

‘পঞ্চমী’ সুরের এক মেরুতে যদি ‘দম মারো দম’ থাকে, তাহলে অন্য মেরুতে ‘তেরে বিনা জিন্দেগি সে কোই’…! কেউ মাতছে ‘পিয়া তু’ গানে তো কেউ ‘রয়না বিত যায়ে’-তে। কেউ আছন্ন ‘রুবি রায়’-এর মোহে, আবার কারও প্রিয় ‘ফুলে গন্ধ নেই’। এভাবেই কেউ ‘এক চতুর নার’ নিয়ে উচ্ছ্বসিত, তো কেউ মগ্ন ‘ কুছ তো লোগ কহেঙ্গে’ গানে। কেউ নাচেন ‘জয় জয় শিব শঙ্কর’ বা ‘আজা আজা ম্যায় হুঁ প্যার তেরা’ চালিয়ে। কেউ বুঁদ ‘হামে তুমসে প্যার কিতনা’, ‘মেরে নয়না সাওন ভাদো’ বা ‘চিঙ্গারি কোই ভড়কে’র নেশায়। কেউ তাঁর মেলোডিতে আক্রান্ত তো কেউ অর্কেস্ট্রশনে। কেউ সাউন্ড ডিজাইনে বা ছন্দের দোলায়, কেউ আবার যৌবনের উত্তাপ খুঁজে পান রাহুল দেবের যাবতীয় কম্পোজিশনে।

নিশ্চয়ই মনে পড়ে, শোলে ছবিতে গব্বরের সাগরেদরা যখন বাসন্তীকে (হেমা মালিনী) তাড়া করেছে, তখন শুধু তবলা ব্যবহার করে ওই উত্তেজনার সৃষ্টি, ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরের ক্ষেত্রে এটা একমাত্র রাহুল দেব বর্মণের পক্ষেই সম্ভব! সিনেমার গান ও ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে পারকাশনের এমন বিস্তৃত ব্যবহারের ক্ষেত্রে উনি পথিকৃৎ শুধু নন। ওঁর মতো আর কেউ এখনও এটা এই স্তরে করতে পারেননি। আসলে যত এক্সপেরিমেন্টই আর ডি বর্মন করে থাকুন, তার সবটাই মেলোডিকে ঘিরে। মেলোডিকে নিয়ে কোনও কম্প্রোমাইজ তিনি করেননি। 

Images 7 5
পঞ্চম সুরে আজও মাতোয়ারা জগৎ-সংসার 10

শোনা যায়, ‘ছোটে নবাব’ ছবিতে সুর করার সময় এই মেলোডিকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য বাবা শচীন দেব বর্মনকে কিছুই না বলে তিনি লতা মঙ্গেশকরকে ‘ঘর আজা ঘির আই বদরা সাঁওরিয়া’ সেমি-ক্ল্যাসিকাল  নির্ভর গানটি গাইতে বলে দেন। জিজ্ঞেস করার প্রসঙ্গ এই কারণেই উঠেছিল, সে সময়ে বেশ কিছু দিন শচীন দেব বর্মনের সঙ্গে লতা মঙ্গেশকরের সম্পর্ক বেশ তিক্ত। শচীন দেব বর্মন তাঁর কোনও ছবিতেই লতাজিকে দিয়ে গাওয়াচ্ছিলেন না। কিন্তু ওই রকম ঠুমরি অঙ্গের গানের জন্য রাহুল দেব বর্মনের লতা মঙ্গেশকরকেই চাই। ব্যস! উনি ফোন করলেন। লতাজী গানের কম্পোজিশন শুনে আনন্দের সঙ্গে গান রেকর্ড করলেন। শুধু তাই নয়, শচীনকর্তা সেই গান শুনে ‘বন্দিনী’ ছবিতে আবার লতা মঙ্গেশকরকে গাওয়ালেন! মেলোডির জয় হলো!

Images 7 6
পঞ্চম সুরে আজও মাতোয়ারা জগৎ-সংসার 11

আটের দশকের শেষ দিক থেকে সেই  রাহুল দেব বর্মনকেই কোনও কাজ দেওয়া হত না! বলা হত, উনি সুর করলে ছবির গান হিট হবে না! তাঁর শেষ সঙ্গীত পরিচালনায় ‘নাইন্টিন ফরটি টু আ লভ স্টোরি’ ছবিতে তিনি তাঁর উত্তর দিয়ে গেছেন। এমনই ছিলেন রাহুল দেব বর্মন। এক সময়ে বছরে সতেরোটা ছবির জন্যও গান তৈরি করেছেন তিনি। আত্মবিশ্বাস আর সঙ্গীত নিয়ে এক্সপেরিমেন্টের ফলে নিজের মধ্যে যে অলৌকিক ক্ষমতার বলয় তৈরি করেছিলেন, সেই বলয় তাঁকে বরাবর বাজারি নিয়মকে ভেঙে অন্য রাস্তায় গান বাঁধার স্বপ্নকে সুরে ভাসিয়েছিল। সেই পঞ্চমমুখর সুরের সাম্রাজ্য আজও অটুট। থাকবে চিরকাল, যতদিন পৃথিবীতে সঙ্গীত থাকবে !